“How The Steel Was Tempered” – নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির বিখ্যাত বই। বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে “ইস্পাত” নামে। একটি আদর্শ সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এক যুগলের আত্মত্যাগের গল্প। নিজেদের বিশ্বাস, নিজেদের আদর্শের জন্য গল্পের নায়ক পাভেল আর তার প্রেমিকা তনিয়া বিসর্জন দেয় আরাম-আয়েশ, নিরাপত্তা, চাকরি পরিবার, পরিবার গড়ার স্বপ্ন, আনন্দ, এমনকি এক অর্থে পরস্পরের জন্য ভালোবাসাকেও। নির্ঝঞ্ঝাট, ছকে বাধাঁ জীবনকে ছেড়ে বেছে নেয় অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা, দারিদ্র, আর কঠোর পরিশ্রমের বিপদসংকুল এক জীবনকে।
বইটা পড়ার সময় আদর্শের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে পাভেল আর তনিয়ার নিসংকোচ সদাপ্রস্তুত মনোভাব, ডেডিকেশান মুগ্ধ করেছিল। আর অবাক করেছিল সমাজতন্ত্রের মতো নির্জীব, মানুষের বানানো একটা প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের জন্য দুজনের এতোটা ত্যাগ।
আদর্শের জন্য ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত পাভেল আর তনিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না, আর সীমাবদ্ধ না সমাজতন্ত্রের মধ্যেও। এরকম অনেক উদাহরণই ইতিহাসের আছে। শুধু রাজনৈতিক আদর্শই না ইটালিয়ান মাফিয়া, জাপানিয ইয়াকুজা, কোসানোস্ট্রা সহ বিভিন্ন অপরাধীদের মধ্যেও নিজ অবস্থানের জন্য প্রবল প্রতিকূলতা, প্রচণ্ড নির্যাতন ও শাস্তি সহ্য করার এবং সবশেষে নিজ আদর্শের উপর অটল থাকার অনেক উদাহরণ আছে।
দুঃখজনক বিষয় হল আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের মানসিকতা অধিকাংশ মুসলিমের মধ্যেই অনুপস্থিত। মানুষের বানানো নানা অসামঞ্জস্যপূর্ণ খাপছাড়া আদর্শ আর দর্শনের জন্য আত্মত্যাগের কিংবা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবার মানুষের অভাব না থাকলেও শাশ্বত সত্যের জন্য, অপরিবর্তনীয় ও অমোঘ জীবনবিধানের জন্য ত্যাগ স্বীকার করার মানুষের আজ অভাব।
যে দ্বীনকে অবশ্য পালনীয় ও অপরিবর্তনীয় হিসেবে নাযিল করা হয়েছে, আজ আমরা ব্যস্ত আমাদের সুবিধা মতো সেই দ্বীনের বিভিন্ন বিধি-বিধান পাল্টে নেওয়াতে। ছোটবড় প্রতিটি বিষয়ে আমাদের অধিকাংশের লক্ষ্য হল আমাদের পছন্দমতো আমাদের, ইচ্ছেমতো আল্লাহর দ্বীনকে কাটছাঁট করে নেওয়াতে। অথচ ব্যাপারটা হওয়ার কথা ছিল উল্টো।
আমাদের দায়িত্ব ছিল দ্বীন ইসলামের বক্তব্য অনুসারে আমাদের জীবনকে বদলে নেওয়া। আমাদের চিন্তা ও জীবনধারাকে শারীয়াহর দিকনির্দেশনার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া। কিন্তু আজ আমরা ব্যস্ত শারীয়াহকে, দ্বীনকে এমন ভাবে ব্যাখ্যা করতে যাতে করে তা আমাদের জীবনধারা, আমাদের খেয়ালখুশির সাথে খাপ খায়। যেখানে বাতিলের অনুসারীরা তাদের বাতিলের ব্যাপারে আপোষহীন, সেখানে হক্বের অনুসারী দাবি করেও আমরা হক্বের ব্যাপারে আপোষকামী। ছাড় দিতে, ব্যাখ্যা দিতে, বদলে দিতে উদগ্রীব।
কথাগুলো কেন বলা? কারন প্রতিকূলতা বর্তমানে একটা বাস্তবতা। আপনি দাড়ি রাখতে চান? আপনি সঠিকভাবে হিজাব করতে চান? আপনি ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিতে চান? আপনি নারীপুরুষের ফ্রি মিক্সিংয়ের ব্যাপারে ইসলামের বিধান মেনে চলতে চান? আপনাকে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে।
আপনি উম্মাহকে নিয়ে সেভাবে চিন্তা করতে চান, যেভাবে রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের চিন্তিত হতে বলেছেন? আপনি দ্বীন ইসলাম আংশিক পালনের বদলে, সামাজিক গ্রহনযোগ্যতার মাপাকাঠির বদলে আল্লাহর নির্ধারিত মাপকাঠি অনুযায়ী সামগ্রিক ভাবে ইসলাম পালন করতে চান? আপনাকে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে। আপনি কুফর ও শিরককে, কুফর ও শিরক বলে অভিহিত করতে চান? আপনি সকল মিথ্যা ইলাহকে বর্জন করে একমাত্র সত্য ইলাহ হিসেবে আল্লাহকে গ্রহণ করতে চান? আপনাকে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে।
আপনাকে ব্যাকডেটেড, আনকালচারড, আনসফিস্টিকেইটেড, বর্বর, সাম্প্রদায়িক, উগ্র-চরমপন্থী বলে ডাকা হবে। এটাই বাস্তবতা। আর সত্য হল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর কাজটা কখনোই সহজ না। পদে পদে, প্রতিনিয়ত নিজ বিশ্বাসের জন্য, আদর্শের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ ও আক্রান্ত হবার পর নিজ অবস্থানের উপর অবিচল থাকা কঠিন।
কিন্তু সুখবর হল, প্রত্যেক নবীকেই এ পথেই চলতে হয়েছে, প্রত্যেককেই পরীক্ষিত হতে হয়েছে, প্রত্যেকেই আক্রান্ত হয়েছেন – আলাইহিমুস সালাতু ওয়াস সালাম। তাদের নিয়ে উপহাস করা হয়েছে, তাদের বিরোধিতা করা হয়েছে, তাদের হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে, তাদের বিতাড়িত করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে। এ পথে চলার কারনেই পূর্ববর্তীদের দেহ দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে, লোহার চিরুনি দিয়ে তাদের হাড় থেকে মাংস আলাদা করা হয়েছে।
এই হল সেই একই পথ যে পথকে যুগে যুগে অধিকাংশরা অস্বীকার করেছে, উপেক্ষা করেছে। এই হল সেই পথে যে পথের পথিকরা যুগে যুগে পরীক্ষিত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। এই হল নবীগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের পথ। অগ্রবর্তী ও ধৈর্যশীলদের পথ।
আর তাই সবকিছুর পরও যদি আপনি এপথে চলার, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নেন, যদি আপনি সমাজ, মিডিয়া, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ﷺ স্থান দেন, যদি আপনি অধিকাংশের অনুসরণের বদলে সত্যের অনুসরণ করেন – তাহলে সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন –
আল্লাহ লিখে দিয়েছেনঃ আমি এবং আমার রসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।
যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না, যদিও তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়। তাদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর অদৃশ্য শক্তি দ্বারা। তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। তারা তথায় চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহর দল। জেনে রাখ, আল্লাহর দলই সফলকাম হবে। [আল মুজাদিলাহ, আয়াত ২১ ও ২২]
আল্লাহর প্রতিশ্রুতি কি সত্য নয়? পুরস্কার হিসেবে এ পুরস্কার কি যথেষ্ট নয়?