আল মাহদী, গ্বাইব এবং সেনসেশানালিসম


ইসলামের কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে মাযহাব-মানহাজ-মাসলাকভেদে, প্র্যাকটিস-ননপ্র্যাক্টিসিং সব ধরনের মানুষ আগ্রহ বোধ করে। যেমন – জ্বিন, দাজ্জাল, কিয়ামতের নিদর্শন, খিযর, আসহাবে কাহফ, সামিরি, সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর অধীনস্ত জ্বিন, যুলক্বারনাইনের প্রাচীর ইত্যাদি। এসব নিয়ে আগ্রহ থাকা দোষের কিছু না। কিন্তু বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনার (কিংবা অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটির) ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিৎ এগুলো মোটাদাগে গ্বাইবের বিষয়। কুরআন এবং সহিহ সুন্নাহতে যা এসেছে তার বাইরে এসব নিয়ে নতুন কিছু নিশ্চিতভাবে জানার সুযোগ আমাদের নেই। নিজস্ব বিচারবুদ্ধি, সাইন্টিফিক থিওরি কিংবা হাইপোথিসিস, কনস্পিরেসি থিওরি কিংবা ফ্যাক্ট – কোন কিছুই আলটিমেটলি এখানে নিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে না। মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হল কুরআন এবং সহিহ সুন্নাহতে যা এসেছে তা গ্রহণ করা, এবং অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন এবং কল্পনা বাদ দেয়া।

এখন এধরণের সবচেয়ে ‘হিট’ টপিক হল ‘আল-মাহদী’ বা ‘ইমাম মাহদী’। ফেইসবুক এবং ইউটিউব খুললেই আল-মাহদীকে নিয়ে নানানধরণের তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে। কেউ বলছেন আল-মাহদী চলে এসেছেন, কেউ দিনক্ষণসহ বলছেন তিনি ২০২১ এ আসবেন, কেউ বলছেন ২০২৪ এ আসবেন। কেউ কেউ বলছেন তিনি অমুক জায়গায় বন্দী আছেন। কেউ বলছেন তিনি অমুক দলের সাথে আছেন। তত্ত্ব আছে বিভিন্ন। তবে সবগুলোর একটা জায়গাতে মিল আছে। গ্বাইবের ব্যাপারে, বিশেষ করে কিয়ামতের নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে স্ট্রিক্টলি কুরআন ও সহিহ সুন্নাহ অনুসরণের যে নীতি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহর আলিমগণের কাছ থেকে পাওয়া যায়, সেটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। তার বদলে এসব তত্ত্বের ভিত্তি হল শিআ ও সুফিদের নানা ধরনের কিচ্ছাকাহিনী, বিভিন্ন বানোয়াট মওদূ কিংবা শায বর্ণনা, সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, কাশফ-ইলহাম, স্বপ্ন কিংবা ইন্টারনেটে পাওয়া বিভিন্ন ডকুমেন্টারি। এসব ‘সোর্স’ থেকে ইচ্ছেমতো তথ্য নিয়ে এক ধরনের পাচমিশেলী বুঝ তৈরি হয়েছে। গ্বাইবের ব্যাপারগুলো নিয়ে এধরণের অ্যাপ্রোচ যুগে যুগে অনেক মানুষকে সীরাতুল মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত করেছে। আজো করছে।

রিসেন্টলি দেখলাম বাংলাদেশের একজন লোক, আকারে ইঙ্গিতে নিজেকে আল-মাহদী দাবি করছে। বিভিন্ন জাল ও বিচিত্র বর্ণনা, সংখ্যাতাত্ত্বিক হাবিজাবি হিসেব, নিজের স্বপ্নের ব্যাখা, ম্যাপে আকিবুকি টানা টাইপের নানান আজগুবি কাজ করে এই ব্যক্তি প্রমাণ করতে চাইছে যে ২০২০ সালেই মাহদী আসবেন। আর তিনিই সেই মাহদী। নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া, আপাদমস্তক বাঙালি, সাবেক ইউনিভার্সিটি প্রফেসর যখন নিজেকে কুরাইশী এবং হাশেমী মাহদী বলে দাবি করে তখন সেটা সাধারনত সিরিয়াসলি নেয়ার মতো কিছু না। বাংলাদেশে এরকম দাবিদার অনেক আছে। কয়েক বছর আগে ইমাম মাহদীর এক সেনাপতি দাবিদারও ছিল। এদেশে সহি সালামাতে আছে দেওয়ানবাগীর মতো ভয়ঙ্কর দাজ্জালও।কিন্তু গুরুতর বিষয়টা হল এই ব্যক্তি এবং তার অনুসারীরা এখন মক্কাতে আছে। যেহেতু এই ব্যক্তি এবং তাদর অনুসারীদের বিশ্বাস হল মাহদী ২০২০-এই আসবেন তাই ধরে নেয়া যায় যে রমাদ্বান থেকে হাজ্জের মধ্যে সে ‘আত্মপ্রকাশ করা’র চেষ্টা করবে। আল্লাহ্‌ মুসলিমদের ফিতনাহ থেকে রক্ষা করুন।

আমরা আজ অনেক বড় ফিতনাহর এক সময় বসবাস করছি। আমরা বাঁধা পড়ে গেছি মিথ্যা, বিভ্রান্তি, প্রতারণার একের পর এক আস্তরণের নিচে। এমন অবস্থায় বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ অনেক। এই সময়ে হক্বের ওপর থাকতে পারাটাই একটা কারামাত। নেত্রকোনার এই ভদ্রলোক আল-মাহদী হবার প্রথম মিথ্যা দাবিদার না। সম্ভবত শেষ জনও না। যাতোই দিন যাবে ফিতনাহ ততো বাড়বে। তাই ঈমান ও দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য আমাদের দায়িত্ব হল কুরআন ও সহিহ সুন্নাহকে আকড়ে ধরা। বিশেষ করে শেষ যুগের নিদর্শন এবং আল-মাহদীর ব্যাপারে কুরআন ও সহিহ সুন্নাহর বেঁধে দেয়া রাস্তার বাইরে না যাওয়া। আর এটা করার প্রথম ধাপ হল এই ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহর অবস্থান জানা এবং সহিহ সুন্নাহ থেকে আল-মাহদীর ব্যাপারে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায় সেগুলো মাথায় গেঁথে রাখা।

শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন –

“আমি এ যুগের একাধিক শায়েখকে চিনি, যারা আবেদ ও যাহেদ। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে মাহদি মনে করে। অনেক সময় তাদের কাউকে এই নামে সম্বোধন করা হয়। আর সে নামে সম্বোধনকারী হল শয়তান। কিন্তু সে (সম্বোধিত ব্যক্তি) মনে করে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্বোধন। তাদের একজনের নাম আহমদ বিন ইবরাহীম। তাকে বলা হয়, ‘আহমাদ আর মুহাম্মাদ তো একই, আর ইবরাহীম খলিল হচ্ছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরদাদা। তোমার বাবার নামও ইবরাহীম। অতএব তোমার নাম রাসূলের নামের সাথে মিলে গেল এবং তোমার বাবার নামও তাঁর বাবার নামের সাথে মিলে গেল’।” -মিনহাজুস সুন্নাহ ৮/২৫৯

শায়খ সুলাইমান আল-উলওয়ান ফাকাল্লাহু আসরাহ বলেন –

“তাদের যদি দূরদর্শী অন্তর্দৃষ্টি থাকত, ইতিহাস জানা থাকত, তাহলেই যথেষ্ট হত। খুব সুন্দরভাবেই তারা এই ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি ও গোমরাহি থেকে বের হয়ে আসতে পারত। জ্ঞানীরা চলার আগে দেখে, আর অজ্ঞরা দেখার আগে চলে। তারা যদি ইতিহাসের পাতা খুলে দেখত, সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারত। মুমিন কখনো এক গর্তে দুইবার দংশিত হয় না। কিন্তু কোথায় তাদের সেই শিক্ষা!

‘আল্লাহ যাকে ফিতনায় নিপতিত করতে চান, আল্লাহর মোকাবেলায় তুমি তার কিছুই করতে পারবে না।’ সূরা মায়েদা: ৪১”। -আননাযাআত, পৃ. ১২

আল্লাহ্‌ আমাদের ফিতনাহ থেকে হেফাযত করুন। আমাদের মিথ্যাবাদীর মিথ্যা আর বিভ্রান্তদের বিভ্রান্তি থেকে হেফাযত করুন। আল্লাহ আমাদের আল-মাহদীর বিজয়ী বাহিনীর সদস্য হবার তাউফিক দান করুন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *