পর্ব ১, মুসলিমের রক্ত আজ সস্তা কেন?


মিডিয়ার অন্তহীন প্রপাগ্যান্ডা আমাদের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে। আমাদের অজান্তেই। ম্যাস মিডিয়ার মায়াজালে আটকে পড়ে একসময় অবশ হয়ে আসে আমাদের অনুভূতিগুলো। আমরা অবচেতনভাবে ভাবতে শুরু করি মুসলিমদের রক্ত সস্তা। আর অন্যদের রক্ত দামি।

সিরিয়া, বার্মা, কাশ্মীর, ইরাক, আফগানিস্তান, মিসর, আরাকান, ফিলিস্তিন, পূর্ব তুর্কিস্তান—পৃথিবীর নানা প্রান্তে মুসলিমদের নিয়মমাফিক হত্যা করা হয় প্রতিদিন। অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে, ‘ডজনের বেশি নিহত’ কথাটার বিশেষ কোনো অর্থ আর আজ আমাদের কাছে নেই। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা অবশ হয়ে গেছি। আমাদের বিবেকের পাল্লায় কয়েক ডজন মুসলিম লাশ তেমন একটা ভারী মনে হয় না। কারণ, আমরা প্রতিদিন দেখি ম্যাস মিডিয়া ভাবলেশহীন মুখে মুসলিম নিধনের খবর দিয়ে যাচ্ছে। দিকে দিকে মুসলিমদের খুন করা হলেও, সবাই এটাকে ধরে নিয়েছে স্বাভাবিক হিসেবে। যেন এতে চিন্তিত হবার কিছু নেই। উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই। এটাই রুটিন।

অন্যদিকে একজন কাফির মারা গেলে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে পুরো পৃথিবী। ইস্রাইলি সন্ত্রাসী বাহিনীর সৈনিক গিলাদ শালিত যখন বন্দী হয়েছিল তখন ইস্রাইল কী করেছিল? সেনাবাহিনী আর বিমানবাহিনীর পুরো শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গাযার ওপর। হত্যা করেছিল এক হাজারের বেশি মুসলিমকে। কারাগারে বন্দী মুসলিমদের ওপর চালাচ্ছিল নতুন নতুন সব টর্চার। আর এই টর্চারগুলোর নাম দিয়েছিল, ‘শালিতের জন্য শাস্তি’। শালিতকে নিয়ে বন্দী-বিনিময় চুক্তি হবার আগে ফিলিস্তিনের শত শত মুসলিমদের বন্দী করেছিল ইহুদীরা। এই সবকিছু করা হয়েছিল, শুধু একজন ইহুদী সন্ত্রাসীর জন্য।

ওরা আসলে আমাদের একটা মেসেজ দিচ্ছিল। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে গেঁথে দিচ্ছিল একটা বার্তা—একজন ইহুদী বন্দীর দাম হাজারো মুসলিমের প্রাণের চেয়ে বেশি। তাদের একজন তো পত্রিকায় কলাম লিখে বলেওছিল, ‘অনস্বীকার্য সত্য হলো, আমাদের একজনের দাম ওদের হাজার জনের সমান।’

কোন মূর্খ সেক্যুলারিস্ট কিংবা ‘মুক্তমনা’ যখন ইসলামকে আক্রমণ করে, তখন সে পশ্চিমের চোখের মণি হয়ে যায়। ‘সত্যের মশালধারী’-কে নিয়ে শুরু হয়ে যায় আদিখ্যেতা। তার জন্য চলে আসে ইউরোপের ভিসা। রাতারাতি সে বনে যায় ‘বিজ্ঞানী’ কিংবা মহান চিন্তক। আজ যেকোনো আরব কিংবা বাদামি চামড়ার মুসলিমের জন্য ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ইসলামকে আক্রমণ করা। এটা করে ফিরিঙ্গি বাবুর জাতে ওঠা যায় একেবারে শর্টকাটে।

ধরনের মানুষদের নিয়ে পশ্চিমাদের এত মাথাব্যথা কেন? তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন শুধু এদের নিরাপত্তা নিয়েই উদ্বিগ্ন হয়? অ্যামেরিকান সেনারা যখন আফগানিস্তানে আমাদের মুসলিমদের ভাইদের হাতের আঙুল কেটে নেয়, হত্যা করার পর তাঁদের মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেয়, তাঁদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে, তাঁদের শরীরের গোশত নিজেদের কুকুরদের খেতে দেয়, তখন তো টুঁ শব্দটা শোনা যায় না। তখন কেন পশ্চিমারা কথা বলতে ভুলে যায়? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তখন কোথায় থাকে? মানবতার গালভরা বুলি তখন কোথায় হারিয়ে যায়?

বরং এসব ব্যাপারে অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীর বক্তব্য জানতে চাওয়া হলে তারা ভাবলেশহীন মুখে জবাব দেয়, ‘আমরা বিষয়টা তদন্ত করে দেখছি।‘ প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় অ্যামেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইটকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, এ যুদ্ধে প্রায় ৫ লক্ষ ইরাকি শিশু প্রাণ হারিয়েছে। এই যে পাঁচ লক্ষ শিশুর জীবন দিতে হলো, যুদ্ধের লাভ-ক্ষতির হিসেবে তা কি উপযুক্ত মনে করেন?

জবাবে সে বলেছিল, ‘আমার মতে এটা বেশ কঠিন একটা সিদ্ধান্ত। তবে আমরা মনে করি যে, বিনিময়ে আমরা যা পাচ্ছি তার তুলনায় এই দাম ঠিকই আছে।’

অর্থাৎ অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যের প্রসারের জন্য যদি ৫ লাখ মুসলিম শিশুকে হত্যা করতে হয়, তবে তাই সই। এতে ওদের কোনো সমস্যা নেই। কোনোরকম দ্বিধাদ্বনন্দ্ব ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত ওরা নিতে। এই হলো আমাদের শত্রুর নৈতিকতার অবস্থা। ওরা যুদ্ধ করে এমন নিয়মে। ওরা আমাদের রক্ত নিয়ে তামাশা করে। কারণ, মুসলিমদের রক্ত ওদের কাছে সস্তা। পানির চেয়েও সস্তা।

এ তো গেল ওদের কথা। কিন্তু আমাদের কী অবস্থা? আমাদের কাদেরকে নিয়ে চিন্তা করা উচিত? সিরিয়া, আরাকান, কাশ্মীর কিংবা পূর্ব তুর্কিস্থানে খুন হওয়া মুসলিম শিশু কিংবা ধর্ষিত মুসলিম নারী? নাকি ওইসব পশ্চিমা লোকজন, যাদের নিয়ে চিন্তিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর মিডিয়া? কোন রক্তের মূল্য আমাদের কাছে বেশি?

আবু গ্বুরাইব আর গুয়ানতানামোর ছবিগুলো দেখিয়ে কাফিররা আসলে আমাদের বলছে –

‘ও মুসলিম, এই যে দেখো আমরা তোমাদের ন্যাংটো করে গলায় শেকল দিয়ে ঘোরাচ্ছি। আমাদের এক নারী সৈনিক শেকল ধরে টানছে। আর তোমরা তার পেছনে কুকুরের মতো হামাগুড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছ। এই হলো আমাদের সামনে তোমাদের অবস্থা। উলঙ্গ, অপমানিত। এই হলো আমাদের ক্ষমতা। তোমরা আমাদের কাছে কুকুরেরও অধম।

এখন কী করবে করো। যা পারো করে দেখাও। পারলে আমাদের ঠেকাও।’

দিনের পর দিন মিডিয়া থেকে আমরা যখন এই মেসেজগুলো পাই তখন এর ছাপ পড়ে আমাদের চিন্তার ওপর। দিনের পর দিন আমরা যখন মুসলিমনিধনকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপিত হতে দেখি আর আগ্রাসনের প্রতিরোধকে সন্ত্রাস হিসেবে, তখন ধীরে ধীরে সেটা আমাদের মাথায় গেঁথে যায়। এ বিষয়গুলো আজ আমাদের এতটাই প্রভাবিত করেছে যে, মিসরে যখন শত শত মুসলিমকে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন আমাদের মধ্যে অনেকে সেটাকে সমর্থন করছিল। এর ফলে জনজীবন নাকি আবার ‘স্বাভাবিক’ হবে।

মিডিয়ার চতুর মেসেজিং আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। অবচেতনভাবে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে মুসলিমদের জান সস্তা। মুসলিমদের রক্ত মূল্যহীন। আর কাফিরদের জান-মাল-সম্মান খুব দামি কিছু একটা। আর এভাবে একসময় আমাদের পুরো চিন্তাভাবনা বদলে যায়। হিসেবনিকেশ উল্টো হয়ে যায়। মুসলিমদের রক্ত আমাদের কাছে সস্তা হয়ে যায়, আর কাফিরের রক্ত দামি। মুসলিমদের হত্যা করা হবে, আমাদের মা-বোন-স্ত্রী-কন্যারা ধর্ষিত হবে, আমাদের সন্তানরা পঙ্গু হবে, অনাথ হবে, নিহত হবে—এটাই স্বাভাবিক। কাফির মরলে সেটা অস্বাভাবিক। মুসলিম মার খাবে, এটা স্বাভাবিক। মুসলিম প্রতিরোধ করলে, পালটা আঘাত করলে, সেটা অস্বাভাবিক।

আমাদের নির্যাতিত মুসলিম ভাইবোনদের নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করে দিই আমরা। প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের স্বপ্ন দেখতেও ভুলে যাই। কখন যেন অভিযোগের তির তাক হয় আমাদের দিকে—সব সময় আশঙ্কায় থাকি । যখন একজন কাফিরেরও কোনো ক্ষতি হয় তখন আমরা রক্ষণাত্মক হয়ে যাই। কাফিরের আগে আমরা ছুটে যাই ‘নিন্দা জানানোর’ মুখস্থ স্ক্রিপ্ট নেই। পাছে কাফির কিছু বলে!

আমার ভাই ও বোনেরা, এই মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসন থেকে নিজেদের বাঁচাতে হবে। এই মানসিক বিচ্যুতির ব্যাপার সতর্ক হতে হবে। সামরিক আগ্রাসনের চেয়েও মনস্তাত্ত্বিক এ আগ্রাসন বেশি ভয়ংকর।


মুসলিমের রক্ত আজ সস্তা কেন?
ড. ইয়াদ আল-কুনাইবির
#আয়নাঘর থেকে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *