মুক্ত বাতাসের খোঁজে


“If you gaze long into an abyss, the abyss also gazes into you”

কিছু অন্ধকার আতঙ্কিত করে, কিছু অন্ধকার মানুষকে আকর্ষণ করে। আবদ্ধ করে অবোধ্য, অনতিক্রম্য লালসা আর কৌতূহলের জালে। গুটিগুটি পায়ে তন্ময়, মন্ত্রমুগ্ধ দ্রষ্টা যখন কিনারায় এসে দাঁড়ায়, অতল গহ্বর গ্রাস করে নেয়। আমাদের এ বই এমনই এক অন্ধকার নিয়ে। নীল অন্ধকার, পর্নোগ্রাফি।

পর্নোগ্রাফি বা ইরোটিকা নিয়ে কথা বলার সময় সাধারণত আমরা অন্ধকারের কথা চিন্তা করি না। ব্যাপারটার সাথে গোপনীয়তা, লজ্জা, নিষিদ্ধ আনন্দ কিংবা লালসার সম্পর্কটা পরিষ্কার। কিন্তু অন্ধকার? বাস্তবতা হলো পর্নোগ্রাফি নিয়ে আমরা তেমন একটা চিন্তা করি না। এ নিয়ে আলোচনা সমাজে দুর্লভ। আলোচনার আদৌ দরকার আছে, দুর্লভ এমন চিন্তাও। পর্নোগ্রাফি নিয়ে অধিকাংশ কথাবার্তা তাই সীমাবদ্ধ থাকে নানা মাত্রার অশ্লীল, ইঙ্গিতপূর্ণ রসিকতা আর হাসিঠাট্টায়। সমাজের বিশাল এক অংশ সম্পূর্ণভাবে বিষয়টা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন। আর একটু আধটু আলোচনা যা হয়, তাতে পর্নের মাধ্যমে নারীর অবজেক্টিফিকেশান; নিছক বস্তু হিসাবে, মাংসপিণ্ড হিসাবে নারীর উপস্থাপনার কথা উঠে আসে। কিন্তু এটি আংশিক চিত্র মাত্র। আদিম সুখের বিষাক্ত এ চিত্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাবের সত্যিকারের ব্যাপ্তির ছিটেফোঁটাও আমরা অনুধাবন করি না। সত্যি কথা হলো পর্নোগ্রাফি আসলে কতটা ক্ষতিকর আধুনিক মানুষ এখনো পুরোপুরি সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। তবে এখনো পর্যন্ত যা জানা গেছে, চমকে দেয়ার জন্য সেটাই যথেষ্ট।

পর্নোগ্রাফি কোনো “নির্দোষ আনন্দ” না। ছোটখাটো কোনো নৈতিক বিচ্যুতি না। এমন কোনো সমস্যা না, না দেখার ভান করলে থাকলে যার অস্তিত্ব মিলিয়ে যাবে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য পর্নোগ্রাফি আসক্তি মারাত্মক এক হুমকি। কারণ, এর প্রভাব কেবল সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ না; বরং দীর্ঘমেয়াদে পর্নোগ্রাফি মানুষকে বদলে দেয়। পর্নোগ্রাফি আক্ষরিকভাবেই মানুষের মস্তিষ্ককে পাল্টে দেয়। বদলে দেয় মাথার ভেতরের সার্কিটগুলোর গঠন। পর্ন দেখার সময় মাথায় শুরু হয় ডোপামিন আর অক্সিটৌসিনের মতো কেমিক্যালগুলোর বন্যা। এ কেমিক্যালগুলো আমাদের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। প্রতিবার পর্ন দেখার সময় কেমিক্যাল বন্যা তৈরি করে সাময়িক আনন্দের অনুভূতি। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো যা তাকে আনন্দ দেয়, বার বার ওই উৎসে ফিরে যাওয়া। তাই ডোপামিনের নেশায় মানুষ আবার ফিরে যায় পর্নের কাছে। এভাবে একটা লুপ তৈরি হয়। পুনরাবৃত্তির একপর্যায়ে উচ্চমাত্রার ডোপামিনে অভ্যস্ত মস্তিষ্ক আগের মতো আর আনন্দিত হতে পারে না। প্রয়োজন হয় আরও বেশি ডোপামিনের। আরও বেশি, আরও “কড়া” পর্নের। তারপর আরও বেশি, তারপর আরও বেশি। একসময় প্রায় সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবে আনন্দিত হবার ক্ষমতা।

যদি ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হয়, তাহলে পর্নের বদলে হেরোইন বা কোকেইন বসিয়ে ওপরের প্যারাটা আবার পড়ুন। এটা আসক্তির ক্লাসিক মডেল। প্রতিটি মাদকের নেশা এভাবেই মানুষের মধ্যে মুখাপেক্ষিতা (dependence) ও আসক্তি তৈরি করে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে এ আসক্তির ফল হলো ব্যক্তির যৌন-মনস্তত্ত্ব, যৌনচাহিদা ও সক্ষমতা বদলে যাওয়া। ঠিক যেমন মাদকাসক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনে আনন্দ খুঁজে পায় না, পর্ন-আসক্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক যৌনতায় সন্তুষ্টি খুঁজে পায় না। পর্নোগ্রাফি তার ভেতরে তৈরি করে অবাস্তব প্রত্যাশা, অতৃপ্তি, আর অনুকরণের তৃষ্ণা। বাস্তব তার জন্য যথেষ্ট হয় না। সুখের খোঁজে অতৃপ্ত সে প্রবেশ করে নীল অন্ধকার গহ্বরের গভীর থেকে আরও গভীরে।

ব্যক্তির মাধ্যমে শুরু হলেও এর প্রভাব শুধু ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বিষিয়ে তোলে পরিবার ও সম্পর্কগুলোকে। একপর্যায়ে পর্নোগ্রাফি প্রভাব ফেলতে শুরু করে সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর। ইতিমধ্যে মিডিয়াতে ব্যাপারটা ঘটছে। এক সময় পর্ন মূলধারার গল্প-সিনেমার অনুকরণ করত। কিন্তু এখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া অনুকরণ করছে পর্নোগ্রাফিকে। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা লক্ষণীয়, তবে হালের ওয়েস্টার্ন পপ মিউযিক-মিউযিক ভিডিও এবং বলিউড আইটেম সংয়ের ক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে দৃশ্যমান। এ ছাড়াও আছে সামগ্রিকভাবে মিডিয়া ও সমাজের অতি যৌনায়ন। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের জন্য এ ব্যাপারগুলো কতটা ভয়ঙ্কর, এর ব্যাপ্তি কতটা বিস্তৃত সেটা আসলেই প্রথমে বুঝে ওঠা কঠিন।

পর্নোগ্রাফি এমন এক ব্যাধি, যা সবার অগোচরে ছড়িয়ে পড়েছে মেট্রোপলিটান থেকে মফস্বলে। কোনো শ্রেণি, বর্ণ, ভাষা কিংবা জাতীয় পরিচয়ের সীমারেখা এ ব্যাধি মেনে চলে না। নিজ বিষাক্ত কলুষতায় সে চরম সাম্যবাদী। শিশু থেকে বৃদ্ধ, পর্ন সবার হাতের নাগালে। বেডরুম, ক্লাস কিংবা পাবলিক প্লেইসে আঙুলের ডগায় অপেক্ষমাণ আজ একান্ত পিক্সেল ফ্যান্টাসি। এ ব্যাধি বর্তমানের সবচেয়ে চরম স্বাস্থ্য ও সামাজিক ঝুঁকিগুলোর অন্যতম। অগণিত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এটি এমন এক সমস্যা যা অসংখ্য মানুষের জীবনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির না, তার পরিবার ও সমাজেরও। যেকোনো প্রান্তে, যেকোনো ঘরে পর্নের রয়েছে অবাধ অনুপ্রবেশ। অথচ অধিকাংশ মানুষ এ বিপদের তীব্রতা সম্পর্কে জানেই না। পর্নোগ্রাফি এক নীরব মহামারি।

আমাদের সমাজে অপরাধের কমতি নেই, কিন্তু আর কোনো কিছু পর্নোগ্রাফির মতো এতটা সহজলভ্য না। মাদক ব্যবহার, ধর্ষণ, খুন—বা অন্যান্য অপরাধগুলো করার জন্য আপনার ঘর থেকে বের হতে হবে। সামান্য হলেও ঝুঁকি নিতে হবে। ধরা পড়ে গেলে শাস্তি হবে। কিন্তু পর্নের ক্ষেত্রে কোনো বাধা, কোনো বয়সসীমা প্রযোজ্য না। আর কোনো কিছুর দরকার নেই, জাস্ট একটা ফোন, ব্যস। ২০১২ সালে কয়েকটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ওপর চালানো যমুনা টিভির জরিপ অনুযায়ী শতকরা ৭৬ জন শিক্ষার্থীর নিজের ফোন আছে। বাকিরা বাবা-মার ফোন ব্যবহার করে। ৮২% সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্ন দেখে, ক্লাসে বসে পর্ন দেখে ৬২%। বেসরকারি এক হিসাবে দেখা গেছে ফটোকপি আর মোবাইলে ফোনে গান/রিংটোন “লোড” করে দেয়ার দোকানগুলো থেকে দেশে দৈনিক ২.৫ কোটি টাকার পর্ন বিক্রি হয়। এগুলো আজ থেকে প্রায় ছ-বছর আগের তথ্য, যখন অ্যান্ড্রয়েড ফোন এবং মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার এতটা ব্যাপক ছিল না। বর্তমান অবস্থা কী হতে পারে, কল্পনা করুন।

যদিও পর্নোগ্রাফি আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে কিন্তু এখনো পর্নোগ্রাফি নিয়ে কথা বলা আমাদের সমাজে ট্যাবু। পর্নোগ্রাফি নিয়ে কথা বলা “অশোভন”, “অশ্লীল”। হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়া পর্নোগ্রাফি “আকাশ সভ্যতার অংশ” হলেও, পর্নোগ্রাফির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আলোচনা “সভ্য আলাপচারিতার জন্য অনুপযোগী”। অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করে নেয়ার বদলে আধুনিক মানুষ আগ্রহী সত্যকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে। অকপট স্বীকারোক্তির জায়গা দখল করে নিয়েছে বাস্তবতার এমন কোনো সংস্করণ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা, যা স্বীকার করে নিলে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে অপ্রিয়, অস্বস্তিকর, বিপজ্জনক কিংবা মৌলিক প্রশ্ন করতে হয় না। বাস্তবতার এ সংস্করণ আদৌ কতটুকু সত্য, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। চোখ বন্ধ করে হলেও স্থিতাবস্থাকে (staus quo) টিকিয়ে রাখা মুখ্য। চারপাশ ঘিরে আসা জমাটবাঁধা নীল অন্ধকার যখন আমাদের পূত-পবিত্র জীবনে উঁকি দেয়া শুরু করে, দেখেও না দেখার ভান করি। প্রশ্ন করি না, চিন্তা করি না। পরিবর্তনের অস্বাচ্ছন্দ্যকর পথে হাঁটার বদলে মনমতো ব্যাখ্যা খুঁজে নিয়ে অন্ধকারের গহ্বরে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবার নিষ্ক্রিয় অপেক্ষা আমাদের পছন্দ। আর তাই আমরা আত্মপ্রতারণা করি, নিজের সাথে মিথ্যা বলি।

সর্তক-সংকেতগুলোকে অগ্রাহ্য করতে বাধ্য করেছে আমাদের এ ঐচ্ছিক অন্ধত্ব আর পশ্চিমা আধুনিকতার শর্তহীন গ্রহণ। প্রগতির পাঠ ঠোঁটস্থ, মুখস্থ, আত্মস্থ করতে গিয়ে খেয়াল করা হয়নি কখন এ আঁধার ঢুকে পড়েছে আমাদের ঘরে ঘরে। পর্নোগ্রাফির বিষাক্ত ছোবল থেকে আজ আপনি, আমি, আমাদের সন্তান, আমাদের বন্ধু, কেউই নিরাপদ না। সবাই সম্ভাব্য ভিকটিম। পর্নোগ্রাফি আসক্তির ফাঁদে আটকা পড়ে আছে লক্ষ লক্ষ শিশু- কিশোর। ভেঙে গেছে পারস্পরিক বিশ্বাস, অগণিত পরিবার। নষ্ট হয়েছে অনেক পবিত্র আত্মা এবং সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে। অন্ধকার গহ্বরের একেবারে কিনারায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যদি এখনো পর্নোগ্রাফির ভয়াবহতার মাত্রা সম্পর্কে আমাদের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন না আসে, তাহলে অনতিক্রম্য অন্ধকার সমাজকে গ্রাস করে নেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই চুপ করে থাকার, নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই। সত্য যতই অপ্রিয় কিংবা অস্বস্তিকর হোক, প্রকাশ করতেই হবে। কারণ, নীরবতার জন্য যে মূল্য দিতে হবে তা অনেক, অনেক চড়া। আর আল্লাহ্‌ সত্য প্রকাশে কখনো সঙ্কোচবোধ করেন না। মুসলিম হিসাবে আমাদেরও করা উচিত না।

মুক্ত বাতাসের খোঁজে

নীল এ অন্ধকারের স্বরূপ তুলে ধরতে, আসক্তির জালে আটকা পড়া মানুষদের পাশে দাঁড়াতে লস্ট মডেস্টি এগিয়ে এসেছে। সমস্যার ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি, তাদের লেখাগুলোতে উঠে এসেছে উত্তরণের উপায়ও। আমার জানা মতে, বাংলা ভাষায় এ বিষয়ে এটাই প্রথম বই। শত শত বিলিয়ন ডলারের গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রির মোকাবেলায় একটি ব্লগ বা বই যথেষ্ট না। ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রচেষ্টা ছাড়া অবস্থার পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব। তবে পর্নোগ্রাফির মহামারিকে ঘিরে নীরবতার যে প্রাচীর ছিল, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কয়েকজন যুবক তা ভাঙার সাহস দেখিয়েছে। আশা করি তাদের এ দৃষ্টান্ত অন্যান্যদের উদ্বুদ্ধ করবে সামাজিক এ ব্যাধি ও হুমকির মোকাবেলার জন্য। আল্লাহ্‌ তাদের প্রচেষ্টা কবুল করে নিন, উত্তম প্রতিদান দান করুন। অজনপ্রিয় এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে এগিয়ে আসার জন্য ইলমহাউস পাবলিকেশানেরও ধন্যবাদ প্রাপ্য। নানা ব্যস্ততা সত্ত্বেও খুব অল্প সময়ের মধ্যে ডা. শামসুল আরেফীন বইটি দেখে দিয়েছেন, এ আন্তরিকতা ও সাহায্যের জন্য আল্লাহ্‌ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন।

আল্লাহ্‌ তাঁর দুর্বল বান্দাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা কবুল করে নিন, এতে বারাকাহ দান করুন। যারা এ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন ও আছেন আর-রাহমানুর রাহীম এ কাজকে বিচারের দিনে তাদের আমলের পাল্লায় স্থান দিন। নিশ্চয় সাফল্য কেবল আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে এবং সকল প্রশংসাও একমাত্র তাঁরই। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের ওপর।

আসিফ আদনান

জুমাদাল আওয়্যাল ১৪৩৯, জানুয়ারি, ২০১৮

মুক্ত বাতাসের খোঁজে বইটি যেখানে যেখানে পাওয়া যাবেঃ

http://bit.ly/2BB80C7


ওপরের লেখাটি মুক্ত বাতাসের খোঁজে বইতে “সম্পাদকের কথা” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে। বইতে আমার নিজের মৌলিক লেখা বলতে এটুকুই। বাদবাকি লেখা লস্ট মডেস্টি ব্লগের, আমার কাজ ছিল সম্পাদনার। আশা করি , ইন শা আল্লাহ এ বিষয়ে কোন বিভ্রান্তি থাকবে না।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *