এ বছরের রমাদ্বানে আহমাদ ইবন হাম্বাল পরীক্ষিত হয়েছেন। তাকে বন্দী করে আল-মু’তাসিমের উপস্থিতিতে চাবুক মারা হয় । ইমাম আহমাদ সত্যের উপর মৃত্যুর ইস্পাতকঠিন সংকল্প করেছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ মৃত্যুর মুখোমুখি হলে কি খালিফাহ যা চাচ্ছেন তার স্বীকৃতি দেবেন?
তিনি জবাবে বলেছিলেন – না।
২১৯ হিজরি।
ইবনুল জাওযী [আল মুনতাযাম, খন্ড ১১, পৃষ্ঠা ৪২]
খালিফাহ মু’তাসিম চাচ্ছিলেন ইমাম আহমাদ যেন আক্বিদার ব্যাপারে, বিশেষ করে ক্বুর’আনের ব্যাপারে মু’তাযিলাদের অবস্থান গ্রহন করেন। তিনি যেন কুরআনকে সৃষ্ট বলে স্বীকার করে নেন। খালিফাহ মু’তাসিমের পূর্বসুরী সপ্তম আব্বাসি খালিফাহ, আল-মামুনের সময় থেকেই “ক্বুর’আন সৃষ্ট” – মু’তাযিলাদের এ কুফরি অবস্থান স্বীকার করে নিয়ে একে সঠিক আক্বিদা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য ইমামগনের উপর রাস্ট্রীয়ভাবে চাপ প্রয়োগ করা শুরু হয়। আল-মামুনের পর, আল-মু’তাসিম এবং আল-ওয়াসিকও এই অবস্থান গ্রহন করেন। ইতিহাসে এ সময়টি পরিচিত মিহ্নাহ বা পরীক্ষা হিসেবে।
সুদীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে চলে মিহ্নাহ।
২১৯ হিজরির দিকে একে একে অধিকাংশ ‘আলিম চাপ, বন্দীত্ব, নির্যাতন, ও প্রাণভয়ে নতি স্বীকার করে নেন। ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল জানতেন এক সময় না এক সময় তাকে এ পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। তার সামনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত। যদি তিনি সত্যের উপর অবিচল থাকেন তাহলে শাসক বন্দি করবেন। তার ওপর নির্যাতন চালানো হবে, হয়তো তাকে হত্যা করা হবে। অন্যদিকে শাসক যা চাচ্ছেন যদি বাহ্যিকভাবে তিনি সেটা স্বীকার করে নেন, তাহলে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারবেন। এক্ষেত্রে তাকিয়্যাহ (নিজের প্রকৃত বিশ্বাস গোপন করা) করা ইমাম আহমাদের জন্য হারাম ছিল না। বরং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছিল এটিই সবচেয়ে হিকমাহপূর্ণ সিদ্ধান্ত।কারন যদি তিনি বেঁচে থাকেন তাহলে হয়তো এক সময় সত্যকে তিনি প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু যদি তিনি মারাই যান, তাহলে ইমাম আহমাদ ছাড়া আর কে আছে যে এই কুফর আক্বিদার পর উম্মাহকে সতর্ক করবে।
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন। আসমানবাসি ফেরেশতা ছিলেন না। তিনি ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন, নির্বোধ ছিলেন না। অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, অর্থ-সম্পদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্ষমতা তার ছিল না। আবার তিনি ছিলেন সুপরিচিত মুখ, আত্বগোপন করা, কিংবা নিজেকে লুকিয়ে রাখার অবস্থাও তার ছিল না। নিশ্চয় প্রতিটি সম্ভাবনা, প্রতিটি সম্ভাব্য পরিস্থিতি ও ফলাফলের কথা বিবেচনা করেই তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
ইমাম আয-যাহাবি বলেন, আব্বাস আদ-দুরি আমাদের বলেছেন আবু জাফার আল-আনবারি আমাদের কাছে বর্ননা করেছেনঃ
“আহমদ ইবন হাম্বালকে আল-মামুনের দরবারে তলব করার খবর পেয়ে আমি তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। আমাকে দেখে ইমাম আহমাদ বললেন –
“আপনি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন” (কষ্ট করে আসার প্রয়োজন ছিল না)
আমি তাঁকে বললামঃ আজ অনেক মানুষ আপনাকে অনুসরণ করে। যদি আপনি খালিফাহর কথামতো সাক্ষ্য দেন যে ক্বুর’আন সৃষ্ট, তাহলে তারা আপনার এ কথার অনুসরণ করবে। আর যদি আপনি খালিফাহকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে মানুষ (মু’তাযিলাদের) এ বিশ্বাস গ্রহণ করবে না। মনে রাখুন, খালিফাহ যদি আপনাকে হত্যা না-ও করে, তবুও একদিন দিন না একদিন আপনাকে মরতেই হবে। মৃত্যু সকলকেই স্পর্শ করবে। সুতরাং মহান আল্লাহকে ভয় করুন, এবং খালিফাহর এ অবস্থানের স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকুন।‘
আমার কথা শুনে ইমাম আহমাদ কাঁদতে শুরু করলেন। এবং বললেন – সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। হে আবু জাফর, আপনি যা বললেন আবার তা আমাকে বলুন।
আমি বললাম। আর ইমাম আহমাদ বার বার বলতে থাকলেন – আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ…”
মুহাম্মাদ বিন ইব্রাহিম আল-বুশানজি বলেন: কিছু লোক আবু আব্দুল্লাহর (ইমাম আহমাদ) সাথে তর্ক করছিল যাতে করে তিনি তাকিয়্যাহ করেন। ইমাম আহমাদ তাদেরকে বলেছিলেন:
খাব্বাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবী ﷺ এর যে হাদিস বর্ননা করেছেন আপনারা তা স্মরণ করুন –
তোমাদের পূর্ববর্তী অনেক লোককে ধরে লোহার চিরুনী দিয়ে তাদের হাড় থেকে গোশত ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তবুও তাদের দ্বীন থেকে তারা বিন্দুমাত্র টলেনি।”
[সিয়ারু আলামিন নুবালা, আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল মিহ্নাহ খন্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৩৮,২৩৯, তাহযীব আল কামাল বাবউল আলিফ, মিন আসমুহ আহমাদ, খন্ড১, পৃষ্ঠা ৪৬০,৪৬১, তাবাক্বাত আল-শাফি’ইয়াহ আল কুবরা, তর্জমা নং ৭, আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাম্বাল, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৬, ৩৭]
ইমাম আহমাদের ছেলে সালিহ বলেছেন – আমার পিতা এবং মুহাম্মাদ ইবন নুহকে শেকলে বেধে বাগদাদ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা আনবার পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করেছিলাম। আবু বাকর আল-আহওয়াল আমার পিতাকে প্রশ্ন করেছিলেন:
হে আবু আব্দুল্লাহ, যদি মাথার উপর তলোয়ারের ছায়া দেখতে পান, তখন কি আপনি খালিফাহ্র মত স্বীকার করে নেবেন”?
আমার পিতা জবাব দিয়েছিলেন – না।
[সিয়ারু আলামিন নুবালা, আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল মিহ্নাহ খন্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৪১, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া খন্ড ১০, সিরাত আহমাদ ইবন হাম্বাল]
মুহাম্মাদ ইবন নুহের ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বলেন –
“আমি মুহাম্মাদ ইবন নুহের মতো দৃঢ়সংকল্প ব্যক্তি আর দেখি নি। যদিও তিনি ছিলেন বয়সে তরুণ, এবং আলিম হিসেবে অত্যন্ত উচ্চমার্গের ছিলেন না। আমি আশা করি তার অন্তিম গন্তব্য কল্যাণময় হয়েছে। একদিন তিনি আমাকে বললেন –
‘আবু আব্দুল্লাহ, আপনি আমার মতো নন। আপনি মানুষের কাছে আদর্শস্বরূপ। আপনি কী করবেন, আপনি কী বলবেন তা জানার জন্য – সবাই তাকিয়ে আছে । আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সত্যের সমর্থনে অবিচল থাকুন।”
[সিয়ারু আলামিন-নুবালা, আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল মিহ্নাহ খন্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৪২]
ইব্রাহিম বিন হারিস আল-আবাদি ইমাম আহমদ ও আবু মুহাম্মাদ আল তাফাউয়ির মধ্যে কথোপকথন বর্ণনা করেছেন। আবু মুহাম্মাদ আল তাফাউয়ি আহমদ ইবন হানবালের সাথে দেখা করেন এবং তার সামনে একটি হাদিস বর্ননা করেন। অতঃপর ইমাম আহমাদ তাকে বলেন –
“আমাদের শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর আমি পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আর-রাহবাহ্তে পৌছানোর পর আমরা কিছু সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি নিলাম। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম একজন বেদুইন এগিয়ে আসছে। বেদুইন আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো:
আপনি কি আহমাদ ইবন হাম্বাল? আমি হ্যা-সূচক জবাব দিলাম। সে কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে অভিভূত। সে আবারো একই প্রশ্ন করলো এবং আবারো চুপ হয়ে গেলো। তারপর সে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে প্রশ্ন করলো – আপনি কি আহমাদ ইবন হাম্বাল? আমি আবারো হ্যা-সূচক জবাব দিলাম। তখন বেদুইন বললো:
“সহ্য করুন, ধৈর্য ধারন করুন এবং সুসংবাদের জন্য অপেক্ষা করুন। একটাই মাত্র আঘাত, তারপর আপনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন।“
তারপর বেদুইনটি চলে গেল।”
আল-তাফাউয়ি প্রশ্ন করলেন- তারা আপনার সাথে কেমন আচরন করেছিল?
ইমাম আহমাদ জবাব দিলেন –
“আমাকে চাবুক মারার সময় বেদুইনের এ কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল। উযাইফ নামের লম্বা দাড়িওয়ালা লোকটি তার তলোয়ারের চওড়া দিক দিয়ে আমাকে আঘাত করলো। আমি নিজেকে বললাম – এই তো, মুক্তি সন্নিকটে! এখন সে আমার গলা কেটে ফেলবে আর আমি বিশ্রাম নিতে পারবো।
এসময় ইবন সামা’আহ বললো – হে আমীরুল মু’মিনীন, আমাকে অনুমতি দিন আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই, এবং আমার হাত তার রক্তে রঞ্জিত হোক। কিন্তু ইবন আবি দু’আদ বললো – না, আমিরুল মু’মিনীন। এমন কাজ করবেন না। যদি আপনি তাকে হত্যা করেন কিংবা আপনার উপস্থিতিতে তার মৃত্যু হয়, মানুষ বলবে সে আমৃত্যু নিজের অবস্থানে অটল ছিল। তারা তাকে ইমাম গণ্য করবে, তাকে অনুসরণ করবে, এবং তাদের বিশ্বাসে অটল থাকবে। বরং উত্তম হল আপনি তাকে এখন ছেড়ে দিন। যদি সে আপনার দরবারের বাইরে মারা যায়, তাহলে মানুষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। কেউ বলবে সে খালিফাহর কথা মেনে নিয়েছিল, কেউ বলবে উল্টোটা।“
আলা-তাফাউয়ি প্রশ্ন করলেন – যদি আপনি খালিফাহ্র কথা মেনেন নিতেন তাহলে কি হতো?
ইমাম আহমাদ জবাব দিলেন – তাহলে আমি কাফিরে পরিণত হতাম।
[সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল মিহ্নাহ খন্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৫৮,২৫৯]
ইবন হিব্বান রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
“আহমাদ ইবন হাম্বাল ক্বুর’আন অন্তঃস্থ করেছিলেন, এবং নির্ভুল ভাবে তিলাওয়াত করতেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ফাক্বীহ, যিনি নির্জনে মুত্তাক্বী ছিলেন…আল্লাহ তাকে উম্মাতে মুহাম্মাদী ﷺ প্রতি সাহায্য হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। নির্যাতনের মুখে তিনি ছিলেন অবিচল। যখন তাকে চাবুক মারা হচ্ছিল তখন (আল্লাহর দ্বীনের জন্য) মৃত্যুবরনের জন্য সম্পূর্ণ ভাবে আল্লাহর প্রতি নিজেকে নিবেদন করেছিলেন। আল্লাহ তাকে কুফর থেকে সুরক্ষিত করেছেন, এবং মু’মিনদের জন্য এক অনুসরনীয় দৃষ্টান্ত তার মাধ্যমে স্থাপন করেছেন।”
[আস সুকাত, মান ইবতাদা’হ আমুহ আলা আল-আলিফ, খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ১৮, তাহযিব আল তাহযিব, হারফুল আলিফ, দ্বিকর মিন আসমুহ আহমাদ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৫]
আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বাল বর্ননা করেন,
আমি প্রায়ই আমার পিতাকে বলতে শুনতাম, আবুল হাইসামের উপর আল্লাহ রহম করুন, তার গুনাহ সমূহ আলাহ মাফ করে দিন। আমি একদিন প্রশ্ন করলাম – বাবা, আবুল হাইসাম কে?
তিনি বললেন – যখন আমাকে চাবুক মারার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, একজন যুবক এসে পেছন থেকে আমার কাপড় টেনে ধরলো, এবং প্রশ্ন করলো – তুমি কি জানো আমি কে?
আমি বললাম – না।
সে বললো – ‘আমি আবুল হাইসাম আল-আইয়্যার। চুরির অপরাধে বিভিন্ন সময়ে আমাকে ১৮,০০০ বার চাবুক মারা হয়েছে। শয়তানের প্রতি আনুগত্য করে, দুনিয়ার লোভে আমি ১৮,০০০ আঘাত সহ্য করতে পেরেছি। সুতরাং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করে, এবং দ্বীনের জন্য সব আঘাত সহ্য করো।‘
অতঃপর আমার পিতা বললেন –
আবুল হাইসামকে ১৮,০০০ বার চাবুক মারা হয়েছিল, আমাকে ১৮ বার চাবুক দ্বারা আঘাত করা হয়েছিল।”
[সাফওয়াত আল-সাফওয়াহ – দ্বিকরুল মুস্তাফিন আহল বাগদাদ –আহমাদ ইবন হাম্বাল, খন্ড ২ পৃষ্ঠা ৩৫১ ]
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আর ইমাম, শায়খুল ইসলাম আবু আবদুল্লাহ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বাল বিন হিলাল বিন আসাদ আশ-শায়বানী সিদ্ধান্ত নেন সাহাবিদের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন জামা’আর বিশ্বাসের অবিচল থাকার। ক্বুর’আন ও সুন্নাহ আমৃত্যু আকড়ে থাকার, বাতিলের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার, দুনিয়াকে তুচ্ছ করে আখিরাতকে গ্রহন করার।
ভূখণ্ডের শাসকের বদলে আসমান ও যমীনের শাসকের সামনে মাথা নত করার। সৃষ্টিকে উপেক্ষা করে স্রষ্টার আনুগত্য করার। রাহিমাহুল্লাহ।
ইমাম আহমাদ নিজের দারিদ্র্যকে অজুহাত বানাননি, নিজের পরিবারকে অজুহাত বানাননি। অজুহাত বানাননি নিজের ব্যক্তিগত জীবন, কিংবা জাগতিক দুর্দশাকে। কারন ‘আলিমগণ নবীদের ওয়ারিশ শুধুমাত্র ‘ইলমের ধারন ও প্রচারণার দিক থেকে না, শুধুমাত্র দাওয়াহ এবং নাসীহাহর দিক থেকে না। বরং হাক্ব ও বাতিলের লড়াইয়ে সত্যকে সুস্পষ্টকে ব্যক্ত করা, সত্যের উপর অবস্থানের কারন পরীক্ষিত হওয়া, কুফফার-ত্বগুত-যালিমের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করা, অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশ্বাসীদের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্বের দিক দিয়েও উলামা নবীদের ওয়ারিশ। জাহিলিয়্যাহর জীবন ছেড়ে দ্বীনে আসা যুবক আর নবীদের একজন ওয়ারিশের কাজকে তাই একই স্কেইলে হিসেব করা হবে না। যদি করা হয় তবে সেটা দুজনের উপরই যুলুম। তারা সাধারণ না, তাদেরকে সাধারণের মানদণ্ডে পরিমাপ করা হবে না। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণরা এ অসাধারন মানুষগুলোর জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেন। যেমন একজন অবিস্মরণীয় ইমাম আহমাদের উপর প্রভাব ফেলেছিলেন একজন আবুল হাইসাম, একজন নাম না জানা বেদুইন।
ইমাম আহমাদ আজ নেই। নেই মু’তাসিম। কিন্তু নতুন এক মিহ্নাহ আজ শুরু হয়েছে। মিম্বার থেকে মিম্বারে তা ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আজ, এখানে কে আছেন যিনি আহমাদ ইবন হানবালের উত্তরসূরী হবার যোগ্য? যিনি অনুসরন করবেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহর ইমামের দৃষ্টান্ত? এ প্রশ্নের কোন সঙ্গত উত্তর দিতে পারছি না। তাহলে কেন এ লেখা? নিজের হতাশা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য?
না। অনেক সময় মাথা নিচু করে থাকতে থাকতে মানুষ আকাশ দেখতে ভুলে যায়। বালুতে মুখ গুজে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে,মানুষ ভুলে যায় ইচ্ছে করলেই আকাশ দেখার ক্ষমতা তার আছে। কূয়োতে আটকা পড়া ব্যাঙ কুয়োকেই সমগ্র বিশ্ব মনে করার কারনে তার চিন্তা কখনো কুয়োর বাইরে যেতে পারে না। কোন জাতির কাছে সর্বোচ্চ সংখ্যা যদি এক হাজার হয় তাহলে এক কোটি কী, এ ধারনাটাই তারা কখনো স্পর্শ করতে পারে না।
আমাদের বর্তমান অবস্থা, বালুতে গুজে রাখা আমাদের লক্ষ লক্ষ মাথা, যেন আমাদের ইতিহাস আমাদেরকে ভুলিয়ে না দেয়। আমাদের আতংক, আমাদের ভীতি যেন আমাদের চিন্তাকে আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে সংকুচিত করে না দেয়। কোনক্রমে টিকে থাকার জন্য না, অনেকের মধ্যে এক হয়ে পরিচিত হবার জন্য না, এই দ্বীন এসেছে বিশ্বের উপর কর্তৃত্ব করার জন্য – এ সত্য যেন আমরা ভুলে না যাই। কুফফার যে এই উম্মাহর পদাবনত হবে এ সত্য প্রতিশ্রুতি যেন আমরা ভুলে না যাই। সে বিজয়ের অংশীদার হবার স্বপ্ন যেন আমরা ছেড়ে না দেই। ভীতি যেন আমাদের জড়তায় না নিয়ে যায়। যুগে যুগে ইমাম আহমাদরা হয়তো আসেন না, কিন্তু একজন মুহাম্মাদ ইবন নুহের রাহিমাহুল্লাহ ব্যাপারে আমরা আশা করা বন্ধ করে দেব, এমন যেন না হয়।