২২ শে জুলাই, ২০১১। নরওয়ে।
দুপুর সোয়া তিনটার সময় একটা সাদা ভোক্সওয়াগ্যান ক্র্যাফটার এসে দাঁড়াল অসলোর মন্ত্রীপাড়ার প্রধান ফটকের কাছাকাছি। অনিশ্চিতভাবে প্রায় দু-মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষমেশ নো এন্ট্রি সাইনটাকে কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে ভ্যানটা গিয়ে থামল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে পার্কিং লটে। পার্ক করা ভ্যান থেকে বের হয়ে আসার পর দেখা গেল পুরোদস্তুর পুলিশের পোশাক পরে আছে ড্রাইভার। মুখ ঢাকা কালো ফেইস-শিল্ডে, হাতে একটা সেমি-অটোম্যাটিক গ্লক ৩৪। গাড়ি থেকে বের হয়ে ৭ সেকেন্ড অপেক্ষা করল ড্রাইভার, তারপর দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল পার্কি লট থেকে।
ভোক্সওয়াগ্যানের ভেতর রাখা বোমাটা বিস্ফোরিত হলো ঠিক ৩.২৫ মিনিটে। কিছুক্ষণের জন্য সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারপাশ। আশেপাশের রাস্তাগুলো ঢেকে গেল ভাঙা কাচের গুঁড়ো আর বিল্ডিংগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত অংশের ধ্বংসাবশেষে। মারা গেল ৮ জন মানুষ।
ঠিক দেড় ঘণ্টা পর উতায়কায়া নামের ফেরিঘাটে এসে পৌঁছল একটা ফিয়াট ডবলো ভ্যান। ভ্যানথেকে বের হল পুলিশের পোশাক পরা দুপুরের সেই লোকটা। ফেরিতে করে উতায়া দ্বীপে পৌঁছাতে সময় নিল আরও ২৩ মিনিট। দ্বীপটা অসলো থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। প্রতিবছরের মতো তখনো উতায়াতে চলছিল বামপন্থী লেবার পার্টির ছাত্র সংগঠনের গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প। ক্যাম্পে অবস্থান করা ছয় শ’র মতো তরুণ-তরুণীদের মনে তখন চলছে অসলোর বোমা হামলা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা। ৫.২২ মিনিটে ওদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করল আগন্তুক। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা ধরে সেমি অটোম্যাটিক রুগ্যার মিনি হাতে নির্বিকারভাবে ঘুরে ঘুরে গুলি চালাল ও। তাণ্ডব শেষে দেখা গেল দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে ৬৯টা লাশ। শেষমেশ পুলিশ আসার পর যখন ও আত্মসমর্পণ করল তখনও ওর কাছে রয়ে গেছে বেশকিছু অ্যামিউনিশান।
২২শে জুলাই ৭৭ জন মানুষকে খুন করা লোকটার নাম অ্যান্ডার্স বেরিং ব্রেইভিক। বয়স ৩২। জিজ্ঞাসাবাদে ব্রেইভিক জানায় প্রায় ৯ বছর ধরে এ হামলার পরিকল্পনা করছে সে। এর মধ্যে প্রথম ছয় বছর খরচ হয় হামলার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা জমানোয়, পরের ৩ বছর ধরে চলে বাদবাকি প্রস্তুতি। রাইফেল এবং পিস্তল কেনে নরওয়ে থেকেই, বৈধভাবে। তুলনামূলকভাবে কঠিন ছিল বোমার উপকরণ জোগাড় করা। এ জন্য প্রথমে ২০০৯ সালে নিজের নামে একটা ফার্ম খোলে ব্রেইভিক। কাগজে-কলমে এ ফার্মে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি আর ফলমূলের চাষ হবার কথা। তারপর ২০১১-তে বোমা বানানোর উপকরণের জন্য ফার্মের নামে কেনে ছয় টন কৃত্রিম সার। এবারও বৈধভাবে। পোল্যান্ডের এক অনলাইন দোকান থেকে কেনে বোমার প্রাইমারগুলো। সব মালমশলা জোগাড় হয়ে যাবার পর মনোযোগ দেয় প্রশিক্ষণে। শারীরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চলে ‘অপারেশনের’ জন্য টার্গেট প্র্যাকটিস এবং মানসিক প্রস্তুতি। এ জন্য দীর্ঘ সময় নিয়ে নিয়মিত প্লে-স্টেশনে ‘কল অফ ডিউটি : মর্ডান ওয়ারফেয়ার টু’ খেলতো ব্রেইভিক।
হামলার ঘণ্টা তিনেক আগে ১,০০৩টি ইমেইল অ্যাড্রেসে ‘২০৮৩ : ইউরোপীয় স্বাধীনতার ঘোষণা’[1] নামের প্রায় ১,৫০০ পৃষ্ঠার এক ম্যানিফেস্টো পাঠায় ব্রেইভিক। এ ম্যানিফেস্টো ভাষ্য অনুযায়ী এ হামলার পেছনে মূল মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিবাসনের মাধ্যমে চলা ইউরোপের এবং বিশেষভাবে নরওয়ের ‘ইসলামীকরণ’ বন্ধ করা।
মুসলিম অভিবাসীদের ‘আগ্রাসন’ এবং নারীবাদ ও বহুসংস্কৃতিবাদের (মাল্টিকালচারালিযম) বিষাক্ত প্রভাব থেকে ইউরোপকে বাঁচানো। হামলার টার্গেট হিসেবে সরকারি ভবন ও বামপন্থী দলের যুব সংগঠন বেছে নেয়ার কারণ হলো অভিবাসন নীতির জন্য সরকার দায়ী আর পুরো পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে ফেমিনিযম ও মাল্টিকালচারালিযমের মতো দর্শনগুলোর প্রচার ও প্রসারের জন্য দায়ী কালচারাল মার্ক্সিযম এবং বামপন্থীরা। ফেমিনিযমের ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমছে সাদা ইউরোপীয়দের জন্মহার। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ইউরোপের বামঘেঁষা রাজনীতিবিদদের অভিবাসন নীতির কারণে ক্রমশ বাড়ছে মুসলিমদের সংখ্যা।
কমতে থাকা জন্মহার আর বাড়তে থাকা মুসলিম–দুটো স্রোতের মিশেলে হুমকির মুখে পড়ে গেছে শ্বেতাঙ্গদের অস্তিত্ব। সাদা ইউরোপকে দখল করে নিচ্ছে বাদামি চামড়ার আরব আর এশিয়ানরা। চলছে এক নীরব আগ্রাসন। ইউরোপ হারিয়ে ফেলছে নিজের আত্মপরিচয় এবং প্রতিরোধের ন্যূনতম স্পৃহা। কালচারাল মার্ক্সিস্টদের পাল্লায় পড়ে ইউরোপ বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। অতি দ্রুত শ্বেতাঙ্গরা পরিণত হতে যাচ্ছে ইউরোপের সংখ্যালঘুতে।
ব্রেইভিকের চোখে ইসলাম হলো পশ্চিমা সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, আর ফেমিনিযম এবং মাল্টিকালচারালিযম হলো পশ্চিমকে ভেতর থেকে কুড়ে কুড়ে খাওয়া ক্যান্সার। এমন অবস্থায় ইউরোপকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো মুসলিমদের বিদায় করা এবং ফেমিনিযম, মাল্টিকালচারালিয ও এর প্রচারকদের ধ্বংস করা। ব্রেইভিক নিজেকে দেখে বিপর্যয়ের কালে স্রোতের বিপরীতে চলা আত্মোৎসর্গকারী বিপ্লবী হিসেবে। ক্রুসেইডার এবং নাইটস টেম্পলারদের পথে চলা এক নব্য নাইট, ইসলামী আগ্রাসন আর সাংস্কৃতিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে যে ইউরোপকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। যাকে মানুষ আজ ঘৃণা করবে আর ভালোবাসবে আগামীতে। নিষ্ঠুর হলেও এ পতন থামানোর জন্য, এ বক্তব্য ইউরোপের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য এবং সাদা মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য এ হামলার দরকার ছিল। ম্যানিফেস্টোতে এবং বিচার চলাকালীন সময় আদালতে, একাধিকবার ব্রেইভিক আশাব্যক্ত করে যে এ হামলা ও ম্যানিফেস্টো পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার সমমনাদের উদ্বুদ্ধ করবে তারই মতো ‘সক্রিয়’ ভূমিকা গ্রহণ করতে।
ব্রেইভিকের আশা বিফলে যায়নি।
চিন্তাপরাধ বইয়ের ‘শ্বেত সন্ত্রাস’ প্রবন্ধ থেকে।
চলবে ইন শা আল্লাহ্
—
[1] 2083: An European Declaration Of Independence, Anders Behring Breivik