‘হিজাব পড়ে সব করা যায়’


পশ্চিমাদের ইসলামকে আক্রমণ করার এক অন্যতম প্রধান পয়েন্ট সবসময়ই ছিল-মুসলিম নারীদের অবস্থা। যেকোন যুগের সমসাময়িক চিন্তাধারা অনুসারে পশ্চিমারা ইসলামে নারীর অবস্থানকে আক্রমণ করেছে। ভিক্টোরিয়ান যুগে অরিয়েন্টালিস্টরা মুসলিম নারীদের তুলে ধরেছে পুরুষদের মনোরঞ্জনে হারেমে বন্দী থাকা নর্তকী হিসেবে। আধুনিক সময়ে তাদের কাছে মুসলিম নারী মাত্রই ঘরের বন্দী আর নির্যাতিত। আর মুসলিম নারীদের ড্রেসকোড হল নিষ্পেষণের প্রতীক।

বিশের দশকে খিলাফতের অবস্থা দুর্বল হবার সাথে সাথে মুসলিমদের মাঝে গেড়ে বসতে শুরু করে পরাজিত মানসিকতা। এই পরাজিত মানসিকতা তাদেরকে পশ্চিমা মূল্যবোধ থেকে শুরু করে পশ্চিমা পোষাক গ্রহণ করার পথে চালিত করে। মুসলিম দেশগুলোতে বয়ে যাওয়া আধুনিকতার জোয়ারে মুসলিম নারীরা তাদের খিমার হিজাব নিকাব ছেড়ে দেয়। নিজেদেরকে শার্ট, প্যান্ট, ব্লাউজ, মিনি স্কার্টে মুড়িয়ে নেয়।সে সময়কার ইরান ইরাক তুরুস্ক সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের নারীদের ছবির দিকে তাকালেই এর প্রমাণ মেলে।

৯/১১ এর পুর্ববর্তী সময় পর্যন্ত ‘হিজাব মানেই নিষ্পেষণ’ এই ন্যারেটিভই বজায় ছিল।সম্পূর্ণ পর্দা করে চলা মুসলিম নারীরা ছিল সমাজের চোখের আড়ালে। ৯/১১ পরবর্তী সময়ে ইসলাম আবারও মেইন্সট্রীম মিডিয়ার আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। এই সময়ে প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মুসলিমদেরকে ডেমোনাইয করার পাশাপাশি RAND কর্পোরেশানের মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগানো হয় এক ‘মর্ডান ইসলাম’ তৈরি করতে।

হিজাবের কন্সেপ্টকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে শুরু করা হল। যে হিজাব ছিল মডেস্টি বা হায়ার প্রতীক, তাকে invert করে দেয়া হল। যে হিজাব ছিল নারীকে সমাজের নোংরামি থেকে আড়াল করার হাতিয়ার ছিল, সেই হিজাবকেই তারা ব্যবহার করছে মুসলিম নারীদের সেক্সুয়ালাইজেশানের হাতিয়ার হিসেবে।

হিজাবকে তুলে ধরা হল নারীর empowerment বা ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে। নারীর নিষ্পেষণর প্রতীক হিজাব’ এই ন্যারেশনের বদলে গ্রহণ করা হল “নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিজাব” এই ন্যারেশন।

এভাবে আমরা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় দেখতে পাই প্রথম হিজাবী প্লেবয় মডেলের প্রশংসা। টিভি শোতে পাই লেসবিয়ান হিজাবী। Empowered Hijabi আইডিওলোজিকে লুফে নিতে শুরু করল অসংখ্য মুসলিম মহিলা। বাড়তে লাগলো ‘প্রথম হিজাবী অমুক’ ‘প্রথম হিজাবী তমুক’ লিস্ট। আর এদেরকেই আজ বিশ্বজুড়ে মুসলিম নারীদের জন্য রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। এদেরকে নিজেদের আইডল হিসেবে গ্রহণ করছে হাজার হাজার হিজাবী নারী।

সবচেয়ে ভয়াবহ (এবং এফেক্টিভ) যে কাজটা পশ্চিমারা করলো তা হল কিছু মুসলিম স্কলারকে তাদের এই এজেন্ডায় ইনক্লুড করলো। আর তাই আমরা এমন ইমাম, এমন স্কলার দেখতে পাই যারা মুসলিম নারীদের এই নির্লজ্জ অধঃপতনকে সাপোর্ট করেন।

অবস্থা এখন এমন দাড়িয়েছে যে, কোন মহিলার বেসুরে গলায় গান বের করার ঘটনাও ফলাও করে খবরে চলে আসবে; যদি সেই মহিলার মাথা হিজাবে ঢাকা থাকে। মাথা ঢেকে ফাহিশা এই মহিলারাই যেন মুসলিম মহিলাদের empowerment এর ব্র্যান্ড এম্বাসেডর।

(কিন্ত পশ্চিমাদের এই empowerment তত্ত্ব কেবল খাটে Hijabi Stereotype Breaking Fashionista দের জন্য। পর্দা করা নিক্বাবী বোনদের জন্য নয়। দেশে দেশে নিক্বাব ব্যানের আইন তৈরী করা তাই স্পষ্টতই তাদের শয়তানী চাল আর নির্লজ্জ দ্বিমুখিতার বহিঃপ্রকাশ।)

এই হিজাবীরা নিজেদের empowerment তার প্রমান হিসেবে বলতে শুরু করলো যে হিজাব সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব চয়েস। সুবহান আল্লাহ! আল্লাহর নির্ধারিত ফরযকে তারা তুলে ধরতে চায় একজন মানুষের ব্যক্তিগত চয়েস হিসেবে, যা চাইলে কেউ পড়তে পারে, না চাইলে নাও পড়তে পারে। হিজাব তাদের কাছে ইবাদাত নয়, বরং ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতীক!

অথচ ইসলামে যে কোন ইবাদাতের ক্ষেত্রে দুইটা বিষয় ঠিক থাকতে হবেঃ কিভাবে করা হচ্ছে এবং কিসের নিয়তে করা হচ্ছে

হিজাব হতে হবে আল্লাহ ঠিক যেভাবে বলেছেন সেভাবেই। পর্দার আটটি শর্তের কোনোটি বাদ পড়লে তা আর পর্দা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না।
অন্যদিকে একজন মুসলিম নারী নিক্বাবসহ আপাদমস্তক নিজেকে কালো কাপড়ে ঢেকে রাখলে তাও গ্রহণযোগ্য না হতে পারে- যদি তার নিয়ত থাকে আল্লাহ ইবাদাত ব্যতীত অন্য কোনো কিছু।

বস্তুত ফেমেন আন্দোলনের টপলেস মহিলাদের সাথে একজন হিজাবীর কোন পার্থক্যই থাকবে না যদি সে হিজাবকে সমাজে ফেমিনিন এম্পাওয়ারমেন্টের একটি ব্যাজ হিসেবে ব্যবহার করে।

কারণ হিজাব কোন এম্পাওয়ারমেন্টের আইডেন্টিটি কার্ড না, হিজাব আল্লাহর জন্য করা একটি ফরয ইবাদাত।

আজ মুসলিম মেয়েদের জন্য আল্লাহর দেয়া ড্রেসকোডকে নামিয়ে আনা হয়েছে কেবলমাত্র এক টুকরো চুল ঢাকার কাপড়ে। যে কাপড় বিশ্বজুড়ে সেকুলারিজম ও লিবেরলিজমের পথে কোন বাধা নয়, বরং সহায়ক। কেননা তাদের মতানুসারে এই হিজাব একটি পার্সোনাল চয়েজ মাত্র, এটি নারীকে কোনভাবেই রেস্ট্রিক্ট করে না। হিজাব পড়েই তারা সব ধর্মীয় প্রথার বিধিনিষেধ ভেঙ্গে দিতে পারে, পুরুষতান্ত্রিকতার হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে।

হিজাব পড়ে সব করা যায়- এই স্লোগান সবার মুখে মুখে। এমনকি বাংলাদেশেও চলছে এই স্লোগানের জয়গান। বামপন্থী, প্রগতিশীল থেকে শুরু করে হিজাবী ফেমেনিস্ট- সবার মুখেই এই স্লোগানের প্রোমোশন। আর কেনই বা তা হবে না? একজন মহিলা যদি শুধুমাত্র চুল ঢেকেই সব বেহায়াপনায় অংশ নিতে পারে তাহলে তাকে প্রমোট করতে বাধা কোথায়?

আধুনিকতা মুসলিম নারীকে নিজেদের রবের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে।ভুলিয়ে দিয়েছে যে কাফির নারী আর মুসলিম নারীর পার্থক্য কেবলমাত্র এক টুকরো মাথার কাপড়ে নয়, বরং তাদের মধ্যকার পার্থক্য আল্লাহর প্রতি আনুগত্যে। আজ আধুনিক সভ্যতা মুসলিমাদেরকে হিজাব থেকে বের করে আনেনি বরং তাদেরকে হিজাবসহই নোংরা বেহায়াপণায় বের করে এনেছে।

বিস্তারিত পড়ুন – Footsteps of the Sahabiyaat


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *