দিন কয়েক আগে ‘স্টিভ জবসের শেষ চিঠি’ জাতীয় একটা লেখা নিউযফিডে দেখলাম। মৃত্যুর আগে স্টিভ জবসের জীবন নিয়ে উপলব্ধি কী ছিল, সেটা নিয়ে লম্বা চওড়া পোষ্ট। লেখার শিরোনাম – The most expensive bed is sick bed. মৃত্যুশয্যাই সবচেয়ে দামী, কারণ টাকা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়, কিন্তু টাকা দিয়ে মৃত্যুশয্যায় নিজের জায়গাটা অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়া যায় না। সাথে জবসের শেষ দিকের কিছু ছবি। ভাঙ্গাচোরা শরীর। গর্তে বসে যাওয়া চোখ। ভেঙ্গে যাওয়া গাল।
এই চিঠিতে মানবজাতির জন্য পলিসি সাজেশান হিসেবে বলা জবসের কথার নির্যাস হল – অর্থই সব না। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে পৃথিবী ভর্তি সম্পদ মূল্যহীন। বৈষয়িক সাফল্য ছাড়াও জীবনের গভীর অন্য কোন অর্থ আছে। আর সবার উচিৎ এর খোঁজ করা। হয় পরিবারের মাঝে, অথবা ভালোবাসার মাঝে, অথবা আর্টের মধ্যে, অথবা ঈশ্বরের মাঝে…
এই চিঠি আসলেই জবসের কি না, সেটা জানি না। তবে বিশাল সংখ্যক মানুষ এই কথাগুলোকে জবসের কথা বলে বিশ্বাস করবে বলেই মনে হয়। একই কথা জবসের জায়গায় আবদুল জব্বার বললে সম্ভবত এই লেখা ভাইরাল হত না। কিন্তু যেহেতু বিলিয়েনেয়ার জবসের কথা, মানুষ এই কথাগুলোকে খুব সিরিয়াসলি নেবে। দেখা যাবে চরম পর্যায়ের ক্যারিয়ারিস্টিক ছেলেমেয়েরা ফেইসবুকের About Me কিংবা Favorite Quote অংশে এই চিঠির কিছু কথা কপি-পেস্ট করে দেওয়া শুরু করেছে, The most expensive bed is sick bed – লেখা টি-শার্ট, মগ ইত্যাদি বের হচ্ছে। হাজার হোক বিলিয়েনেয়ারের শেষ কথা বলে কথা! মরা হাতির দাম লাখ টাকা।
কিন্তু এতো কাহিনী করার প্রয়োজন হয় না। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার জীবন অর্থের পেছনে ছুটে কাটিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ অর্থহীন, এই কথাটা তিনটা লাইনে বোঝানো যায়। সাইয়্যেদিনা আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন –
হে দামাস্কাসের লোক সকল ! ‘আদ জাতির এমন এক সেনাবাহিনী ছিল যা ছিল আদন থেকে ওমান পর্যন্ত বিস্তৃত। আজ কে আছে, আমার কাছ থেকে দুই দিরহামে ‘আদের ধ্বংসাবশেষ কিনবে?”
[তাফসির আল ক্বুরতুবি, তাফসির ইবন কাসির]
সমস্যা হল আমাদের প্রকৃতিটা এখন এমন হয়ে গেছে যে আমরা সহজ কথা সহজ ভাবে বুঝতে পারি না। আমরা সহজ সমাধান, সহজ উত্তর গ্রহন করতে পারি না। আমরা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে চাই না। সবকিছুর মাঝে জোর করে গ্রে-এরিয়া বের করতে চাই। তাই স্টিভ জবসের কথা আমাদের যতোটা প্রভাবিত করে, একজন সাহাবীর কথা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আমাদের ততোটা প্রভাবিত করে না। আর ব্যাপক আকারের ঝামেলা বেঁধে যায় যখন আমরা জবসের মতো ফ্রি-স্টাইলে জীবনের অর্থ খুজতে যাই।
সম্পদ, সাফল্য, সম্মান, খ্যাতি, ক্ষমতা – কোন কিছুই মানবজীবনকে অর্থ দিতে পারে না। শিল্প, শিক্ষা, দর্শন কিংবা সাধনা, পরিবার কিংবা ভালোবাসা – কোন কিছুই আপনার কিংবা আমার অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ করতে পারে না। হয়তো সাময়িকভাবে এগুলো আমাদেরকে ভুলিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু কখনোই জীবনকে অর্থ দিতে পারে না। এসবই দুনিয়ার প্রলোভনের অন্তর্ভুক্ত এক-একটি প্রলোভন। কোনটা হয়তো অন্যগুলোর চাইতে ভালো, কিন্তু দিনশেষে এ সবই এক। এ সবই দুনিয়া।
অথচ আমরা প্রতিনিয়ত এই দুনিয়ার মধ্যেই জীবনের সাফল্য, জীবনের অর্থ খুঁজে ফিরি। অধিকাংশ মানুষ সম্পদ, স্বাচ্ছল্য, প্রতিষ্ঠা আর সম্মানকে নিজের লক্ষ্য বানিয়ে নেয়। রাতে চোখ বন্ধ করে আর সকালে চোখ খুলে দুনিয়ার গতির সাথে তাল মিলিয়ে, দুনিয়ার হিসেবে মেলানোকে মাথায় রেখে। দুনিয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে ভুলে যায় স্ত্রী, সন্তান, পিতামাতার হক্বের কথা। দুনিয়া অর্জন করতে ভুলে যায় হালাল-হারামের কথা। তার মালিকের কথা। দুনিয়ার উপরে ওঠার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে আপোষ করে দ্বীনের সাথে। আস্তে আস্তে দ্বীনের ব্যাপারগুলো গৌণ হয়ে যায়। তারপর একসময় হয়ে যায় বিস্মৃত।
আর যারা সম্পদের পেছনে, ক্যারিয়ার আর সাফল্যের পেছনে, অথবা সম্মান ও খ্যাতির পেছনে ঘোরে না, তারা ঘুরপাক খেতে থাকে নানা কাছে আসার গল্পে, কিংবা তুচ্ছাতিতুচ্ছ খেলাধূলায় অথবা গানবাজনায় অথবা আধুনিক যাত্রাপালায়। কেউ ডুবে থাকে মাদকের নেশায়। কেউ জাস্ট অটো পাইলটে বেঁচে থাকে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মাস, প্রতিটি বছর মিশে যেতে থাকে পরেরটির সাথে। মানুষটা সেই একই জায়গায় পশুর মতো খাওয়া, ঘুম, বেডরুম আর বাথরুমের মাঝে আধা-জাগরনে জীবন কাটিয়ে দেয়। কেউ বিভ্রান্ত হয়ে আটকে থাকে মানবরচিত দর্শনের গোলকধাধায়।
আর সবাই এভাবে ভুলে থাকে মুল লক্ষ্য, মূল উদ্দেশ্যকে। মানব অস্তিত্বের সত্যিকারের গন্তব্য আখিরাতকে।
আর আমরা যতোক্ষন দুনিয়ার মধ্যে আমাদের জীবনের অর্থকে খুঁজে বেড়াবো ততোক্ষণ সাময়িক আত্মতৃপ্তির পর অবধারিত তীব্র হতাশা ছাড়া আর কিছুই আমরা খুঁজে পাবো না। আমাদের গন্তব্য আখিরাত। আমাদের বানানো হয়েছে আখিরাতের জন্য। এই দুনিয়াতে আমাদের অবস্থান একটা ছোট্ট যাত্রাবিরতির মতো। দুনিয়া হল মূল গন্তব্য পৌছানোর আগে এমন একটা স্টপেজ যা এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই। কিন্তু এই দুনিয়া কোন ভাবেই আমাদের মূল জীবন না। আর এই স্টপেজ পার হয়ে সঠিক গন্তব্য পৌছানোর উপায় হল আসমান ও যমীনের একচ্ছত্র অধিপতির জানিয়ে দেওয়া গাইডলাইন ফলো করা যা হল – আল-ইসলাম। সিরাতুল মুস্তাক্বিম। ইসলামী শারীয়াহ হল এমন একমাত্র ম্যাপ, এমন একমাত্র গাইডলাইন যা আমাদের সঠিক গন্তব্য পৌছে দিতে পারে।
কিন্তু আজ আমরা প্রতি পদে পদে, প্রতিটি তুচ্ছাতিতুচ্ছ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দুনিয়াকে দ্বীনের উপর প্রাধান্য দেই। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাপ্তির জন্য আমরা দ্বীনকে বিক্রি করে দেই। দুনিয়ার আবর্জনার জন্য আমরা আখিরাতের সাম্রাজ্যকে ভুলে থাকি।
জবসের কথার প্রভাব আমাদের উপর বেশি হবার কারণও এই একই। জবসের কথাকে আমরা মূল্য দেই কারন সে তা পেয়েছিল যা আমরা সবাই চাই। দুনিয়া। কিন্তু যদি আমরা আখিরাতকে পেতে চাই, তাহলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার কিতাবের অনুসরণ ছাড়া আর কোন অপশান মানবজাতির নেই।
আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন –
তোমরা জেনে রেখ যে, পার্থিব জীবনতো ক্রীড়া কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক অহংকার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়; ওর উপমা বৃষ্টি, যার দ্বারা উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। (আর আখেরাতের চিত্র অন্যরকম, পাপাচারীদের জন্য), আখেরাতে আছে কঠিন শাস্তি, (আর নেককারদের জন্য আছে) আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়। [আল হাদিদ, ২০]
সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপনার হাতে…
দ্বীন না দুনিয়া?