ধরুন আপনাকে বলা হল – সমাজের নৈতিকতার ধারনাকে নষ্ট করে দিয়ে আমার ঠিক করে দেওয়া একটি নতুন মানদন্ডকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ জন্য খরচ, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক সহায়তা, যা কিছু দরকার, আমি দেবো। আপনাকে শুধু একটা কার্যকরী স্ট্র্যাটিজি তৈরি করে দিতে হবে…
কী মনে হয়? কাজটা কি সহজ?
একটা সমাজের এক্সিস্টিং নৈতিকতার মানদন্ডকে ভেঙ্গে দিয়ে নিজের পছন্দনীয় নৈতিকতা সেট করে নেওয়ার কাজটা আসলে বেশ কঠিন। সৌশাল এঞ্জিনিয়ারিং হল মানুষের চিন্তা নিয়ে কারিকুরির কাজ। মানুষ নিয়ে কারুকাজ। অনেক দিক দিয়ে অস্থির বিস্ফোরক নিয়ে নাড়াচাড়ার চেয়েও বিপদজন।
আচ্ছা বলুন তো এই ক্ষেত্রে কোন কোন মিডিয়াম ব্যবহার করা যায়? কিছু উত্তর একটু মাথা খাটালেই বের করতে পারবেন।
মিডিয়া একটি সমাজের চিন্তাচেতনাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। কাব্য, সাহিত্য, নাটক, সিনেমার মত সাংস্কৃতিক উপকরনগুলোকে ঐতিহাসিকভাবে এধরণের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ভাবে বিশেষ কোন সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাও বেশ কার্যকরী। কার্যকরী হতে পারে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির পাঠ্যনীতির মাঝে বিশেষ কিছু কথা, কিছু ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়া, এবং অন্য কিছু বিষয়কে বাদ দেওয়া।
এসবই সমাজের মানুষের চিন্তাকে পরিবর্তন করতে ভূমিকা রাখবে।
কিন্তু সম্পূর্ণভাবে প্রশাসনিক, এবং রাষ্ট্রীয় সহায়তাও যদি আপনাকে দেওয়া হয়, যদি বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানে আপনার আপনার লোক বসিয়ে নিতে পারেন তবুও আপনাকে একটা শক্ত বিরোধিতার মুখোমুখিও হতে হবে। আর সে বিরোধিতাটা আসবে পরিবারের পক্ষ থেকে। মানুষ তার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলো পরিবার থেকেই পেয়ে থাকে। তাই আপনি যতই ঘরের বাইরে একজন মানুষকে কিছু শেখান না কেন, যদি বাসা থেকে তাকে উল্টো শেখানো তা হলে আপনার পরিশ্রম খুব একটা কাজে আসবে না।
সমাধান?
প্রথমত সন্তানের সাথে পিতামাতার একটা ব্যাপক চিন্তাগত পার্থক্য তৈরি করা। আর দ্বিতীয়ত, একটি সামাজিক ইউনিট হিসেবে পরিবারকে দুর্বল করতে। আর একাজটা করার জন্য আপনাকে বদলে দিতে হবে নারীকে। আমার বাংলাতে বলে থাকি পুরুষরা পরিবারের হাল ধরেন। যদিও পরিবারের নারী ও পুরুষের ভূমিকা এভাবে সিম্পলিফাইডভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, তবে আমার মতে শাব্দিক ভাবে হাল ধরার অর্থটা পরিবারে নারীদের ভূমিকার সাথেই বেশি যায়। হালের কাজ হল নৌকা বা জাহাজ কোন দিকে যাবে তা ঠিক করা। ইঞ্জিন কিংবা দাঁড় টানা মাঝির কাজ হল নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
আমার মনে হয় পরিবারের শিশুদের বিকাশের গতিপথ প্রাথমিক ভাবে মা-র ওপরই নির্ভর করে। যদি হালকে বিগড়ে দিতে পারেন, কিংবা ইচ্ছেমতো কোন একটি দিকে ঘুরিয়ে নিতে পারেন তাহলে আপনার কাজটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়। চাইলে নেপোলিয়নের বিখ্যাত উক্তির আলোকে ওপরের কথাগুলোকে একটু বিবেচনা করে দেখতে পারেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে দেখবেন ঠিক এ জিনিসটাই ঘটেছে। মিডিয়া, কালচার-কাউন্টার কালচার, পপ-রক আইকনস, সেলিব্রিটি কাল্ট – এসবের মাধ্যমে একটা জেনারেশানাল ডিভাইড বা প্রজন্মগত দূরত্ব তৈরি করা হয়েছে। ফলে প্রতি প্রজন্মের সন্তানেরা তাদের পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তার অবস্থান থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গেছে। আর একই সাথে নারীর চিরন্তন প্রাকৃতিক, পারিবারিক ও সামাজিক ভূমিকাকে ক্রমাগত আক্রমন করা হয়েছে।
সাধারণত মানুষ এধরনের কোন পরিকল্পনাকে মেনে নিতে চাইবে না। বিরোধিতা করবে। তাই বিষয়টা এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে করে মানুষ স্বেচ্ছায় আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ করে। আপনার চিন্তাগুলোকে নিজের চিন্তা মনে করে। মানুষের চিন্তা হাইজ্যাক করতে হবে। আমাদের পৃথিবীতে কাজটা করা হয়েছে নারী স্বাধীনতা এবং নারীবাদের নাম দিয়ে।
নারীমুক্তি আর নারীবাদের নামে নারীকে (এবং পুরুষকেও) বোঝানো হয়েছে পুরুষের অনুকরন করার মাঝেই, পুরুষ যা করতে পারে তার করতে পারার মাঝেই নারীজন্মের সার্থকতা নিহিত। আমাদের বোঝানো হয়েছে ঘরের ভেতরে নারী যে ভূমিকা পালন করে তা আসলে তুচ্ছ, এবং এটা এক ধরণের বন্দীত্ব। আর তাই ঘরের বাইরে নারীকে নিয়ে আসা এবং ঘরের বাইরে রাখার মাঝেই নিহিত প্রগতি, উন্নতি, সার্থকতা।
ঘরের বাইরে থাকা, পুরুষের সাথে পাল্লা দেওয়া, শরীর প্রদর্শন আর যথেচ্ছ যৌনতার মতো বিষয়গুলো কোন এক ভাবে আমাদের চিন্তার জগতে স্বাধীনতা ও অধিকারের সমার্থক শব্দ হিসেবে চালু হয়েছে গেছে। ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন এসেছে আমাদের চিন্তায়। নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আস্তে আস্তে আমাদের কাছে গুরুত্ব হারিয়েছে। সামাজিক ইউনিট হিসেবে পরিবার দুর্বল হয়েছে। পরিবার যতো দুর্বল হয়েছে, ততোই দুর্বল হয়েছে পারিবারিক শিক্ষা ততোই দুর্বল হয়েছে নৈতিকতার কাঠামো, ততোই কমেছে সৌশাল এঞ্জিনিয়ারিং প্রতিরোধের ক্ষমতা।