ছোটবেলা থেকেই আমরা একটা দুমুখো সমাজে বেড়ে উঠি। যেভাবে আয়নায় নিজেদের দেখতে পছন্দ করি, আমাদের আসল চেহারা তার সাথে মেলে না। নিজেদের ব্যাপারে আমাদের বলা কথা আর আমাদের কাজ প্রায় বিপরীত, দুটো ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, পরিচয় প্রকাশ করে। সংখ্যাটা দুইয়ের বেশি হতে পারে, তবে কমপক্ষে দুই হবে।
যেমন আমাদের বই, পত্রিকা, বিবৃতি পড়লে যেকারো মনে হবে, আমরা আমাদের ভাষার খুব কদর করি। এটাকে আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় পরিচয়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করি। কিন্তু আমাদের সমাজের ৯০ শতাংশের চেয়েও বেশি মানুষের আচরণের মধ্যে এর কোন বাস্তব প্রমাণ খুজে পাওয়া যায় না। একই কথা খাটে দেশপ্রেমের ব্যাপারে, আমাদের স্বল্পমেয়াদী অতীত ইতিহাস, “হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য” সহ আরো অনেক ব্যাপারে।
আমরা যা বলি, আর আসলে যা করি…মেলে না।
হিপোক্রেসি। নিফাক্ব। আত্মপ্রতারণা…
ওপরের কোন একটা কিংবা সবগুলো শব্দের ব্যবহারই অযৌক্তিক হবার কথা না। তবে পুরো প্রক্রিয়াটাতে আমরা সবাই সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করি, এমনটা মনে হয় না। যতোটুকু উপস্থাপনা; মঞ্চায়ন, অপরের জন্য, তার কিছুটা হলেও বরাদ্দ থাকে নিজেদের জন্য। যে বিশাল দ্বিমুখীতা আমাদের সমাজ ধারণ করে আছে, তার মাঝে নিরেট প্রতারণার পাশাপাশি হয়তোবা কিছুটা আন্তরিক আত্মপ্রতারণার মিশেলও আছে। আমরা অন্যদের সামনে একটা মিথ্যে ছবি তুলে ধরার পাশাপাশি, নিজেদেরকেও বোকা বানাই। অ্যাটলিস্ট কিছুটা হলেও।
চিন্তা ও বাস্তবতা, কথা ও কাজের বৈপরীত্যের ব্যাপকতা আমরা অনুভব করতে পারি না। অন্য সব কিছুর চেয়ে ইসলামের ক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে বেশি হয়। ইসলামকে ভালোবাসলেও আমাদের আচরণ কখন ইসলামের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক হচ্ছে, সেটা জানলেও, আমরা হয়তোবা সঠিক ভাবে উপলব্ধি করি না, এবং/অথবা বুঝেও আড়াল করি।
ভ্যালেন্টাইন্সকে ঘিরে প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা যে বিশাল উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে, সেটার ক্ষেত্রেও, চিন্তা ও কাজের ডিসকানেক্টের ভূমিকা আছে বলে মনে হয়। আল্লাহ যে গুনাহর ধারে কাছে যেতেও আমাদের নিষেধ করেছেন, ভ্যালেন্টাইন, ভালোবাসা দিবস, কাছে আসার গল্প ইত্যাদির নামের আড়ালে আমরা যে সেই যিনার উৎসব উদযাপন করছি এটা কোন একটা কারণে আমরা রেজিস্টার করছি না।
আমি এটা বলছি না যে, যারা ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করে, তারা বোঝে না এটা ইসলামের সাথে সাঙ্ঘর্ষিক। অবশ্যই বোঝেন। আমি বলছি, সমাজ হিসেবে আমরা এটা স্বীকার করতে রাজি না যে, ব্যাপকভাবে আমাদের সমাজে যে উৎসব গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেছে সেটা আসলে যিনা-ব্যভিচারের উৎসব। অবাধ যৌনতার উৎসব। আমরা স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে যিনার উৎসবকে, রোম্যান্টিসাইয করছি, গ্লোরিফাই করছি, এবং এতে অংশগ্রহণ করছি।
মাল্টিন্যাশনাল কর্পোরেইশানগুলো মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি হিসেবে যে “কাছে আসার গল্প বানাচ্ছে” এটা মূল সমস্যা না। সমস্যা হল, আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল যা হারাম করেছেন, সমাজ হিসেবে আমরা সেটাকে হালাল হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি। মিডিয়ার আর কর্পোরেইশানগুলোর মাধ্যমে অপসংস্কৃতির প্রচলন হচ্ছে, এতে তো অবাক হবার কিছু নেই। তাদের কাজই এটা। অবাক করার মতো ব্যাপার হল, আমরা একই সাথে নিজেদের মুসলিম বলছি আবার সামস্টিকভাবে যিনাকে বৈধতা দিচ্ছি। শুধু তাই না, এ নিয়ে সেলিব্রেট করছি। শুধু গুনাহ করাতে আমরা থেমে নেই, আমরা গুনাহকে মহিমান্বিত করছি।
কিভাবে নিজেদের মুসলিম পরিচয় ও বিশ্বাসের সাথে এ ধরণের আচরণকে মেলানো যায়? এধরনের বৈপরীত্য ধারণ করেও নিজেদের সুস্থ, স্বাভাবিক দাবি করা যায়? একজন সিরিয়াল রেইপিস্ট যদি নিজেকে শুদ্ধতম চরিত্রের অধিকারি বলে দাবি করে; না, বরং বিশ্বাস করে – তখন সেটাকে কী বলা যায়? ডিলিউশান? মহাজাগতিক মাত্রার কগনিটিভ ডিসোন্যান্স?
মক্কার ক্বুরাইশরা আল্লাহকে মানতো। আল্লাহ একমাত্র ইলাহ, এটা মানতো না। তাদের চিন্তা ও কাজের মধ্যে যে ডিসকানেক্ট ছিল সেটা দূর করার দরকার ছিল। আর তাই আল্লাহ তাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন তারা যেটাকে ইমান মনে করছে সেটা শিরক। আর যারা এক আল্লাহর ওপর ইমান রাখে, এই বিকৃত বিশ্বাস ও এতে বিশ্বাস স্থাপনকারীদের সাথে তাদের ক্বিয়ামত পর্যন্ত শত্রুতা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক নেই। তাওহিদ আর শিরকের সহাবস্থান সম্ভব না। সেটা ব্যক্তির মধ্যে হোক, সমাজে হোক, কিংবা রাষ্ট্রে।
সমাজ হিসেবে আমাদেরও উচিৎ এই বৈপরীত্য থেকে বের হয়ে আসা। আয়নায় দেখা পশুকে দেবতা বলে চালানোর চেষ্টা বন্ধ করা। যিনাকে যিনা বলা। “বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের” বিরোধিতা না করে বিশ্ব যিনা দিবসের বিরোধিতা করা। “অপসংস্কৃতির” বিরোধিতা না করে, হারাম এবং হারামকে মেনে নেয়ার বিরোধিতা করা।
সুগারকোট করে লাভ কী? প্রতারণা করুন কিন্তু আত্মপ্রতারণার প্রয়োজন কী? অ্যাটলিস্ট এভাবে বোঝা যাবে, আমরা কে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।