দুবাইওয়ালা কমপ্লেক্স


পরাজিত মানসিকতার মুসলিমদের অনেক অসুখের মধ্যে একটা অসুখ হল “দুবাই কমপ্লেক্স”। ব্যাখ্যা করছি। আধুনিক মুসলিমদের ওপর জেঁকে বসা বিভ্রান্তির বাস্তব প্রতিফলন হল দুবাই। আধুনিক বিশ্বে জায়গা করে নিতে উদগ্রীব – বাইরে থেকে চাকচিক্যময়, ভেতরে ফাঁপা, প্লাস্টিক একটা জায়গা। জাতে ওঠার জন্য বেপরোয়া দুবাই নিজের শেকড়, আদর্শ ও মূল্যবোধকে নিজের হাতেই পুরোপুরি ধ্বংস করেছে।

বাইরে থেকে দুবাই হল সব “হালাল” এর হাব। হালাল ব্যাঙ্ক, হালাল বিনোদন, হালাদ ম্যাকডনাল্ডস, হালাল ফ্যাশন – ইসলামিযেইশানের সাকসেস স্টোরি। কিন্তু ফ্যান্সি কর্পোরেট লোগো, ডিযাইনার আবায়াহ আর “হালাল ফানের” পাতলা সারফেসের নিচে পাবেন সেই একই পশ্চিমা প্রক্রিয়া, একই পশ্চিমা আক্বিদা। বাইরে ইসলামাইযেইশানের মেকাপ, ভেতরে নিরেট পশ্চিম।

পশ্চিমের ইসলামীকরনের যে পদ্ধতি ইসলামপন্থিদের অনেকে গ্রহণ করা ইসলামিস্টরা এতোটাই বিভ্রান্ত যে পশ্চিমের মোকাবেলার তাদের একমাত্র রেসপন্স হল সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমকে গ্রহণ করা। আর সারফেস লেভেলে কিছু পার্থক্য ধরে রাখার জন্য একধরণের কসমেটিক ইসলামাইযেইশান করা। সিথিটা একটু অন্যদিকে করা, দাড়ি একটু অন্যভাবে ট্রিম করা – সুপারফিশিয়াল কিছু পরিবর্তন আনা। [১]

চট্টগ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে, দুবাইওয়ালা। গ্রামের লোক দুবাইয়ে গিয়ে প্রচুর টাকা রোজগার করেছে। কিন্তু অর্থ তাকে তৃপ্ত করেনি, সে এখন জাতে উঠতে চায়। টাকা পাবার পর তার মনে হচ্ছে, এখন সামাজিক স্ট্যাটাস দরকার। টাকা দিয়ে সে স্ট্যাটাস কিনতে চায়। হুলুস্থুল খরচ করে। পোশাক পরে উগ্র, চটকদার রুচির। বাজারে গেলে সবচেয়ে চকচকে, রংচঙে, জাকজমকপূর্ণ জিনিশগুলোই তার চোখে ধরা পড়ে। অর্থ, সচ্ছলতা – থাকার পরও নিজের “গ্রামের লোক” পরিচয় – নিজের অতীতের কারণে, নিজেকে অপূর্ণ মনে হয়। কিন্তু বাইরেবাইরে তার অবয়ব থেকে চকচকে সাদা জুতো,সোনালি চেইনের আর সবুজ রঙের ব্লেযার পরার মতো কঠিন আত্মবিশ্বাস ঠিকরে বের হয়। তার “ক্লাস” নেই, তাই সে “ক্লাস” এর অনুকরনের চেষ্টা করে। ব্যার্থ, কমিকাল চেষ্টা।

দুবাই কমপ্লেক্সকে এই অর্থে দুবাইওয়ালা কমপ্লেক্সও বলা যায়। মুখে যাই বলুক না কেন – ইসলামাইযেইশানের পথিকরা ১৪০০ বছর আগের ইসলাম ফেরত চায় না। তারা আধুনিক পশ্চিমের সাথে কম্প্যাটিবল ইসলাম চায়। মুখে সালাফদের প্রশংসা করে, তাঁদের মতো “শুদ্ধ মানুষ” তৈরি করার কথা বলে। কিন্তু তাঁদের পদ্ধতি চায় না, তাঁদের “রুক্ষতা” চায় না, সালাফদের “আনসফিস্টিকেইটেড”, “ইন্টেলেকচুয়ালি আনফুলফিলিং” দৃষ্টিভঙ্গি চায় না। তাই সালাফদের ইসলাম ফেরত আনার বদলে এদের সব চিন্তা, শ্রম, সময় ব্যয় হয় পশ্চিমের সাথে সহাবস্থানের ইসলাম তৈরি করতে – সেটা ফিকহ দিয়ে হোক, গলাবাজি করে হোক, কিংবা গজদন্ত মিনারে বসে উম্মাহকে জ্ঞান দিয়ে হোক।

ক্লাসহীন সে, ক্লাস চায় – জাতে উঠতে চায়। তাই গণতন্ত্র হয়ে যায় ইসলামী গণতন্ত্র, ব্যাঙ্কিং হয় ইসলামী ব্যাঙ্কিং, গানের জায়গায় আসে ইসলামী সংগীত, ফেমিনিযমের জায়গায় আসে ইসলামি ফেমিনিযম, এন্টারেটেইনমেন্টের জায়গায় আসে “হালাল বিনোদন”, হালাল ফান, হালাল সিনেমা, হালাল হ্যাপি মুসলিম – এইতো। ইসলামীকরনের উৎসাহী কর্মী-সমর্থকরা মনে করেন এতে বি-শা-ল অগ্রগতি হচ্ছে। সূচনা হচ্ছে উম্মাহর নবজাগরণের পথে নতুন দিগন্তের। পশ্চিমে ভালো পড়াশুনা, ভালো লাইফস্টাইল আর থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির ঝুটঝামেলা মুক্ত জীবনযাপনের জন্য অবস্থান তাই তাদের কাছে “ইবাদত” মনে হয়।

অথবা পশ্চিমে না থেকেও পশ্চিমের নানা অকেজো দার্শনিক স্কুল অফ থট থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে নেয়া, অনুবাদ করা কিছু কনসেপ্ট নিয়ে, জোড়াতালি দিয়ে, ওপরে আরবি-উর্দু শব্দ লাগিয়ে পুনঃজাগরন আর “ইসলামি বিল্পবের” সিলেবাস বানানো হয়। যে যতো ভালোভাবে পশ্চিমের ইসলামিকরন করতে পারে, সে ততো বড় মুফাক্কির, ততো বড় ফকিহ, স্কলার – আল্লামা।

একদল মুসলিম কেন তাদের মতো করে পশ্চিমকে আলিঙ্গন করতে পারছে না – কেন “আক্ষরিক”, “অগভীর” বুঝ নিয়ে আছে, মানুষকে এসবের দিকে ডেকে উম্মাহর দুর্দশা আরো বাড়াচ্ছে – এ নিয়ে বিরক্ত, নাখোশ হন। কেউ চিন্তিত হন, দরদী বুকের ভেতরে দরদ মোচর দেয়, কেউ কেউ খেপেও যান। সহজ, রহস্যহীন রাগকে কঠিন কঠিন ভাষায় প্রকাশ করেন।

দুবাইওয়ালা টাকার গরম দেখান। কিন্তু দুবাইওয়ালার ট্র্যাজেডি হল সে যার মতো হতে চায়, আর যাকে নিজের চেয়ে নিচু মনে করে – দু দলই তাকে তাচ্ছিল্য করে। আরেকজনের ছাঁচে নিজেকে তৈরি করতে চাওয়া লোকটার আত্মপরিয়ের সংকট, ঐতিহ্যের দাবি, আর নিজে নিজে নেতাগিরির হাস্যকর পর্যায়ের অসামঞ্জস্য সবার চোখে ধরা পরে। ধরা পরে না কেবল দুবাইওয়ালার ঘোরালাগা চোখে।


[১] এই অংশটি টুইটার থেকে নেয়া একটি লেখা অবলম্বনে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *