বনী ইস্রাইলের ইতিহাস এক মহাকাব্যিক ট্র্যাজিডি। সম্মান থেকে লাঞ্ছনা, নিয়ামত থেকে আযাব, আল্লাহর সবচেয়ে পছন্দের জাতি থেকে তাঁকে ক্রোধের কারণ হবার বিচিত্র এক গল্প। ইহুদিরা বারবার সুযোগ পাবার পরও নিজেদের বদলায়নি। আল্লাহর নাযিলকৃত শারীয়াহ বিকৃতি, বর্তমানকে জায়েজ করা জন্য আল্লাহর কালামের অপব্যাখ্যা, পার্থিব স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে আল্লাহর কিতাবকে পেছনে ছুড়ে ফেলা, কিতাবের কিছু অংশগ্রহন আর কিছু অংশ বর্জন, মূর্তিপূজাসহ স্পষ্ট শিরক – এমন কোন প্রতারণা নেই যা বনী ইস্রাইল নিজেদের সাথে ও আলিমুল গ্বাইব আল্লাহ-এর সাথে করার চেষ্টা করেনি। এমনকি ব্যবিলনে বন্দীত্বের সময় জাদু, জ্যোতিষশাস্ত্র, নিউমেরোলজি, ডিমনোলজি, গায়রুল্লাহর কাছে মানুষ উৎসর্গ করা এবং ম্যাজিককেও তারা জায়েজ করার চেষ্টা করেছে ক্বাবালাহ নামে। তাওরাহ এবং যবুরের বদলে নিজেদের হাতে লেখা তালমুদ ও যোহারকে প্রধান ধর্মগ্রন্থ বানিয়েছে। যতোবার ভুল স্বীকার ও সংশোধন করেছে তারচেয়ে দ্বিগুন বেশিবার চেষ্টা করেছে নিজেদের ভুলকে জায়েজ করার । ইহুদি জাতির ইতিহাসকে বিকৃতি আর একগুঁয়ে আত্মপ্রতারণা ইতিহাস বলা মনে হয় ভুল হবে না।
এ বিকৃতির পেছনে অনেকগুলো, অনেকগুলো ক্যাটালিস্ট আছে। তার মধ্যে একটি হল ইহুদি জাতির দীর্ঘদিন ধরে চলা দুর্দশা, পরীক্ষা ও পরাজয়। অনেক আগে থেকেই নিজেদের ক্রমাগত লাঞ্ছিত ও পরাজিত অবস্থায় দেখতে থাকা বনী ইস্রাইল খুব সেক্যুলার এবং প্র্যাগম্যাটিক একটা স্ট্র্যাটিজি গ্রহণ করেছিল। যেকোন মূল্যে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। এখানে “যেকোন মূল্যে” – কথার অর্থ হল “যেকোন ছাড় দিয়ে”, “যেকোন আপস করে”, “দ্বীনের যেকোন ব্যাখ্যা করে”। তাই ইচ্ছেমতো ধর্ম নিয়ে তারা কাটাছেড়া করেছে। সময় অনুযায়ী বদলে ফেলেছে নিজেদের দ্বীনকে।
ইহুদি জাতির প্রতি আমি কখনোই কোন সহানুভূতি অনুভব করিনি। বরং উল্টোটাই তীব্রভাবে সত্য। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন দল, আলিম, দা’ঈ আর চারপাশের সাধারণ মানুষের দিকে তাকালে, বিশেষ করে আমাদের চারপাশের উলামা আর তালিবুল ইলমদের দিকে তাকিয়ে, কিংবা বিশ্বজুড়ে যাদের উম্মাহর দিকনির্দেশনা দানকারী মনে হয় তাদের দিকে তাকিয়ে, আমাদের বর্তমানে আলোকে তুলনা করতে গেলে এখন মাঝেমাঝে মনে হয় ইহুদীদের অধঃপতন আর পাপের পেছনের চিন্তার কাঠামো আর ধাপগুলো অবোধ্য, অযৌক্তিক কিছু না। কখনো কখনো মনে হয়, এক শতাব্দী ধরে চলা দুর্দশার কারণে আজ এভাবেই যদি আমাদের বিকৃতির জন্য আমরা অজুহাত তৈরি করি, তাহলে হাজার হাজার বছর ধরে দাসত্ব, পরাজয় আর নির্বাসনের চক্রে ঘুরপাক ইহুদিদের দোষ দেয়াটা কি ডাবলস্ট্যান্ডার্ড হয়ে যায় না? একশো বছরের মাথায় আজ আমরা যেভাবে মানবরচিত আইনের শিরক থেকে শুরু করে সুদ পর্যন্ত শরীয়াহর অপব্যাখ্যা করে “ইসলামী” বানিয়ে ফেলেছি, সেই তুলনায় হাজার বছরে ইহুদিরা কি খুব বেশি কিছু করেছে? বাস্তবতা তো এই যে আমরা – অধিকাংশরা – “মূলধারা”রা বনী ইস্রাইলের পথেই হাঁটছি।
হতাশ লাগে। ভয় হয়। আল্লাহ আযযা ওয়া জাল আমাদের নাজাতপ্রাপ্ত ফিরকা আর আত-তাইফাতুল মানসুরার কথা জানিয়েছেন। এ উম্মাতের জন্য সুসংবাদের কথাও আমরা শুনেছি। তবে অধিকাংশের নাযাত পাবার কোন নিশ্চয়তা কিন্তু আমরা পাইনি।