দাওয়াহ, ভাষা, সহজবোধ্যতা


If you can’t explain something in simple terms, you don’t understand it

যদি তুমি কোন কিছুকে সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করতে না পারো তাহলে তুমি আসলে সেই জিনিসটা বোঝো না।

বলা হয়ে থাকে যে ফিযিক্সে নোবেল প্রাইয বিজয়ী রিচার্ড ফাইনম্যান কথাটা বলেছেন। আমি মনে করি ফাইনম্যানের এ কথাটা সর্বক্ষেত্রে সত্য না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য। যদি ফাইনম্যানের একটা উল্টো উদ্ধৃতিও আছে – “Hell, if I could explain it to the average person, it wouldn’t have been worth the Nobel prize.”

যা হোক ফাইনম্যানের মূল বক্তব্য কিংবা তার বক্তব্যের ব্যাপারে আমার ধারনার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল দাওয়াহর ক্ষেত্রে কোন কিছু সহজে বোঝাতে পারার গুণ থাকা দরকার। এটা প্রায় অপরিহার্য। আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারনা কাজ করে যে ‘জ্ঞানের কথা’ সাদামাটাভাবে বলা যায় না। অনেক পরিভাষা, অনেক এলিগ্যান্টভাবে কোন কিছুকে উপস্থাপন করতে পারাকে আমরা একটা স্কিল মনে করি, বিশেষত্ব মনে করি। কেউ এমন করতে পারলে আমরা ধরে নেই সে অনেক কিছু জানে। কিন্তু এ ব্যাপারটা সবসময় এমন না। তারচেয়েও বড় কথা, আপনি যদি পরিভাষা-বোঝাই কিছু লেখেন সেটা কেবল ঐ মানুষেরাই ঠিকমতো বুঝতে পারবে যারা ইতিমধ্যে সেই পরিভাষাগুলোর সাথে পরিচিত। যে পরিভাষাগুলো জানে না সে আপনার কথার অনেক কিছুই বুঝবে না।

আমি একটা উদাহরন দেই। কেউ অনুগ্রহ করে কথাগুলো অন্যভাবে নেবেন না। এটা কোন ব্যক্তি বা ব্যাক্তিবর্গের সমালোচনা করে বলা কথা না বরং কন্টেন্টের ব্যাপারে সমালোচনা এবং নাসীহাহ ধরতে পারেন। উদাহরনটা হল, আমি অনলাইনে অর্থনীতি, ফাইন্যান্স এসব নিয়ে বাংলায় কিছু লেখা দেখেছি। ইসলামিস্টদেরও লেখা দেখেছি। এগুলোর অধিকাংশ হল অর্থনীতির পরিভাষা দিয়ে বোঝাই। আমি অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরও এ ধরনের লেখা পড়তে আমার বিরক্ত লাগে। কারনটা হল আপনি যখন এরকম পরিভাষা বোঝাই কিছু পড়বেন তখন আপনাকে অ্যাডিশানাল কিছু কাজ করতে হবে। পরিভাষাগুলো নিছক কিছু শব্দ না। এগুলো হল কোন শব্দ বা শব্দাবলীর মাধ্যমে বড় কোন ধারণা বা কনসেপ্টের প্রকাশ। সাধারন শব্দগুলোও এক অর্থে এমনই। তবে পার্থক্য হল ক্রমাগত ব্যবহার ও চর্চার ফলে সাধারন শব্দগুলো উচ্চারিত হবার পর সেটার পেছনের কনসেপ্টটা কী – সেটা আমাদের হাতড়ে বেড়াতে হয় না। সেটা তাৎক্ষনিকভাবে আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু পরিভাষার ক্ষেত্রে এটা হয় না, কারন কোন ডিসিপ্লিন বা শাস্ত্রের পরিভাষা ঐ শাস্ত্র নিয়ে কাজ করা লোকের বাইরে অন্য লোকের চর্চা ও ক্রমাগত ব্যবহার থাকে না। কাজেই বাইরের লোক যখন পড়তে যায় সে হয় অর্থ না বুঝে,অর্ধেক বুঝে বা ভুল বুঝে পড়ে যায়, অথবা সে থেমে থেমে অর্থ বুঝে বুঝে পড়ে। কোনটায় সুখপাঠ্য হবার সংজ্ঞায় পড়ে না। এবং কোনটাই দাওয়াহর ক্ষেত্রে উপযুক্ত না। এই ব্যাপারে ফাইনম্যানের আরেকটা উদ্ধৃতি বেশ সুন্দর –

“I learned very early the difference between knowing the name of something and knowing something.”

কাজেই দাওয়াহর ক্ষেত্রে, এভাবে লেখাটা আমার কাছে একেবারেই অকার্যকরী মনে হয়। অবশ্যই যখন অ্যাকাডেমিক কাজ করবে, সত্যিকার অর্থে অ্যাকাডেমিক কাজ – তখন তাকে পরিভাষা দিয়েই লিখতে হবে। সে প্রতিটা পরিভাষা ব্যাখ্যা করে করে লিখতে পারবে না। আর তার সেটা করার দরকারও নেই, কারন অ্যাকাডেমিক লেখা তৈরি করা হয় অ্যাকাডেমিক লোকজনের জন্য। কাজেই এখানে লেখক ও পাঠকের বুঝের তারতম্য হচ্ছে না। কিন্তু দাওয়াহর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটা ভিন্ন।

ধরুন আলোচ্য বিষয়। পশ্চিমা দর্শন, সভ্যতা, কার্যাবলী ইত্যাদির ভুলগুলো পরিস্কার করা, সমালোচনা আনা। এগুলো একেবারের প্রান্তিক মানুষকে বোঝানো সোজা। সে হুজুরের ওয়াজ থেকেই এটা বুঝবে এবং তার জন্য হয়তো অতোটুক বুঝ ঠিক আছে। কিন্তু অনলাইন ব্যবহারকারী মানুষ, শহুরে/মফস্বলের মধ্য/উচ্চমধ্যবিত কিংবা উচ্চবিত্ত – যারা আসলে শিক্ষিত মূর্খ – তাদেরকে বোঝানো তুলনামূলকভাবে কঠিন। কারন সে যে জানে না এটাই সে জানে না। সে মনে করে সে অনেক কিছু জানে। এখন আপনি তাকে অ্যাকাডেমিকভাবে বোঝালে সে ‘হু হু’ করে মাথা নাড়বে ঠিকই কিন্তু কিছু বুঝতে পারবে না। এবং আমাদের এই প্ল্যাটফর্মে কিংবা বই আকারে, কিংবা ভিডিও আকারের দাওয়াহর টার্গেটের বিশাল একট অংশ হল এই শিক্ষিত মূর্খ শ্রেনী। আর বাস্তবতা হল আমাদের দেশের ইসলামিস্টদের বুঝের মাত্রাও খুব ব্যাপক না। আমাদের পড়াশুনা কম। যাচাই, বোঝা ইত্যাদির প্রবনতা কম।

কাজেই যখন পশ্চিমা সভ্যতা, দর্শন কিংবা অন্য যেকোন কিছু আমরা এই সাধারন মানুষদের সামনে ব্যাখ্যা করবো তখন আমার এমনভাবে বোঝানো উচিৎ যাতে সে জিনিসটা ঠিকঠাক ধরতে পারে। আমার লেখা পড়ে আমি অনেক বুঝি, নাকি আমি আসলে খুব কম বুঝি – মানুষ কী মনে করলো সেটা আসলে গুরুত্বপূর্ণ না। আপনি বোকাদের জন্য লেখেন নাকি বুদ্ধিমানদের জন্য লেখেন, মানুষ এ ব্যাপারে কী মনে করলো সেটা চিন্তা করারও দরকার নেই। আপনার দেখতে আপনার উদ্দেশ্য কী? আর সেটা কী অর্জিত হচ্ছে কি না। আমি যখন স্পেশালিস্টদের জন্য লিখবো, আমি একভাবে লিখবো। কিন্তু যখন দাওয়াহর জন্য লিখবো তখন আমার টার্গেট অডিয়েন্সের বুঝের কথা মাথায় রেখেই আমি লিখবো। অনেক পরিভাষা, দুর্লভ শব্দ মিলিয়ে লিখবো না। এতে আমাকে যতো বিদ্বানই মনে হোক না কেন কারন দিনশেষে এটা কার্যকর না। নিজের ভাষাকে নিজের টার্গেট অডিয়েন্সের উপযুক্ত করে না তোলা হয় অলসতা, অথবা উন্নাসিকতা অথবা অক্ষমতা।

অ্যাকাডেমিক লেখা সবার জন্য না। কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো আরেকজনের অ্যাকাডেমিক, সেমি-অ্যাকাডেমিক কাজ নিজে বুঝে সেটাকে নিজের ভাষায় সাধারনদের জন্য ব্যাখ্যা করতে পারি। এবং আমার মতে এটা অত্যণত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। কারন আমাদের কাজ কিন্তু অ্যাকডেমিকালি পশ্চিমাদের কাছে গিয়ে তাদের দর্শনে খন্ডন তুলে ধরা না। এটা অলরেডি পশ্চিমারা নিজেরাই করেছে। আর পশ্চিমাদের জন্য আমাদের মেসেজও এটা না। আমাদের কাজ হল মুসলিমদের বোঝানো যারা পশ্চিমের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তাদের মধ্যে মুগ্ধতা জন্ম নিয়েছে ইত্যাদি। কাজেই চুড়ান্ত এই অ্যাকাডেমিক, সেমি-অ্যাকডেমিক কাজের উদ্দেশ্য হল যারা আম মানুষকে বোঝাবে তাদেরকে বোঝানো। প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রদের পড়ানোর জন্য হাই স্কুল কিংবা কলেজ কিংবা ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মধ্যে সক্ষমতা তৈরি করা। তো আমাদের এ দিকটাতেও মনোযোগী হওয়া উচিৎ।

বর্তমানে ফেইসবুকে গোছানো দাওয়াতী লেখালেখি হয় না বললেই চলে। যদিও বেশ কয়েক বছর আগে এরকম এধারা চালু ছিল। এই পরিবর্তনের একটা কারন হল অনেকের নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া, অনেকে বিভিন্ন কারনে লেখা বন্ধ করে দেয়া, এবং নতুন লেখক বের হয়ে না আসা। এখানে অনেকে হয়তো দ্বিমত করতে পারেন যে এখন তো অনেক বই বের হয়, অনেক নতুন লেখক, অনুবাদক ইত্যাদি আছে। তবে আমার পর্যবেক্ষন অনুযায়ী ভালোমানের নতুন লেখক দাওয়াহর দিক থেকে (যেহেতু আমাদের ফোকাস আলটিমেটলি দাওয়াহ, সাহিত্য না) তেমন আসেনি। যে হারে পুরনো লেখক কমেছে সে হারে নতুন লেখক তৈরি হয়নি। যদিও ভালো লেখক অবশ্যই এসেছেন।

একইসাথে আমাদের দাওয়াহ অনেকটা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অনেকে মানুষ ‘প্র্যাকটিসিং” হয়েছে। এটা একটা ভালো মার্কেট। আমরা এই মার্কেটের জন্য কন্টেন্ট তৈরি করি। কিন্তু সাধারন মানুষ, যেটা সত্যিকারভাবে বাংলাদেশের মূলধারা, সেক্যুলার আধা-সেক্যুলার মানুষজন – তাদেরকে টার্গেট করে এখন দাওয়াহ খুব কম হচ্ছে।

তাই আমি আহবান করবো ভাইরা এদিকেও যেন গভীরভাবে চিন্তা করেন। লিবারেলিযম, সেক্যুলারিযম, ইউরো-সেন্ট্রিক চিন্তা, ইউটিলিটারিয়ানিযম, ইন্ডিভিযুয়ালিযম, নারীবাদ বিভিন্ন চিন্তার প্রভাব আমাদের সমাজে এখন আছে। মানুষ হয়তো চিন্তাগুলোকে সেগুলোর প্রকৃত নামে চেনে না কিন্তু সেই চিন্তার প্রভাব তার মধ্যে আছে। আমাদের তাদেরকে বোঝাতে হবে। সে বুঝে এমনভাবে বোঝাতে হবে, আমার কাছে যেটা ভালোলাগে সেভাবে বোঝালে হবে না। তাই আপনারা এদিকেও মনযোগী হন ইন শা আল্লাহ। ১ বা ২ বছর মেয়াদী চিন্তা করেন। বা এর চেয়ে কম বা বেশী ধরেন, সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে সাধারন মানুষের সামনে এই লেখাগুলো পৌছে দেয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম মোটামুটি আকারের আমাদের সামনে আছে। সত্যকথন বা এ জাতীয় পেইজ/সাইটগুলো আছে। যেগুলোর নিয়মিত পাঠক আছে। এগুলোর মাধ্যমে, আমাদের নিজেদের লেখালেখির মাধ্যমে, বই-প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ চাইলে সাধারন মানুষের কাছেও এ ব্যাপারগুলো পৌছে দেয়া যায়। তাই আমি অনুরোধ করবো এ বিষয়ে চিন্তা করার।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *