ড. হুমায়ূন আজাদ প্রথাগত প্রথাবিরোধিতার এক মূর্ত প্রতীক। বাঙ্গালী ‘মুক্ত’চিন্তকদের মাঝে মহীরুহসম হিসেবে গন্য হূমায়ূন আজাদের চিন্তা কিংবা দর্শনের ক্ষেত্রে মৌলিক কোন অর্জন বা কৃতিত্ব নেই। তার ব্র্যান্ডের মুক্তচিন্তা হল ভাষার কারুকাজ আর আবেগী কথার আড়ালে উপযোগ আর ভোগবাদকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা। হুমায়ূন আজাদের অবিশ্বাস হল আবেগ, কাম ও ভাষাতাড়িত এক নাস্তিকতা, যার উদ্দেশ্য ‘যা খুশি তাই করার’ ইচ্ছাকে সম্মানজনক পোশাক পরানো – সব সীমা, নৈতিকতা ও অপরাধবোধ থেকে মুক্ত হয়ে ইন্দ্রিয়সুখের পেছনে ছুটে বেড়ানোর বিকারগ্রস্থ আত্মরতির আত্মপক্ষ সমর্থনের দুর্বল প্রচেষ্টা। তার জীবনদর্শন; যদি আদৌ একে জীবনদর্শন বলা যায় – পুরোটাই পশ্চিমাদের কাছ থেকে ধার করা। এবং ধার করা সে চিন্তাগুলোর উপস্থাপনাও অতিরঞ্জিত, অসংলগ্ন এবং অনেক ক্ষেত্রেই অশুদ্ধ।
স্রষ্টার অস্তিত্ব, মানব অস্তিত্ব ও চেতনার সূচনা, নৈতিকতা ও পরকালের মতো বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কোন প্রশ্নগুলোর বিজ্ঞান দিতে পারে আর কোনগুলো বিজ্ঞানের ও আওতার বাইরে পড়ে, সেটুকু বোঝার মত বিজ্ঞানের বুঝ ড. আজাদের ছিল না। আর এ প্রশ্নগুলোকে সৎ ভাবে মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় দার্শনিক বুঝ, উপলব্ধি কিংবা সততা কোনটাই তার লেখায় চোখে পড়ে না। ড. আজাদের লেখা থেকে ভাষার কারুকাজ ও সাহিত্যিক জিমন্যাস্টিক্স সরিয়ে মূল বক্তব্য ও দাবিগুলোর দিকে তাকালে গুণমুগ্ধ ব্যাক্তি ছাড়া বাকি সবার কাছে বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবার কথা। সব অর্থেই ড. আজাদ ছিলেন একজন প্রথাগত প্রথাবিরোধি যার জীবনদর্শনের মূল স্তম্ভগুলো হল ইন্দ্রিয়সুখ, আত্মউপাসনা ও আত্মরতি।
তাই স্রষ্টা, ধর্ম, পরকাল, জীবনের উদ্দেশ্যের মতো মানুষের অস্তিত্বসমন্ধীয় প্রশ্নগুলোর বিতর্কে হুমায়ুন আজাদ বড়জোর একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর নকলনবিশ। এক জলজ্যান্ত ক্লিশে। এমন কোন আলোচনা তার লেখায় আসেনি যা পশ্চিমাদের কাছ থেকে নকল করা না। এবং মজার বিষয় হল ড. আজাদ এসব ধার করা আলোচনার সবচেয়ে সরলীকৃত, সবচেয়ে স্থুল সংস্করনগুলোকে নিজের বৈপ্লবিক চিন্তা ও প্রথাবিরোধিতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এমন কোন কিছু তার লেখায় নেই যা এ বিষয়ে প্রাথমিক স্তরের পড়াশুনা করা মানুষের অজানা। তার যুক্তিতর্ক এবং সেগুলোর উপস্থাপনা এতোটাই দুর্বল যে ভাষার কারুকাজ বাদ দিলে পাঠকের এমন মনে হওয়া অস্বাভাবিক না যে কোন মধ্যবয়স্ক অ্যাকাডেমিক নন বরং এগুলোর লেখক কোন আত্মমুগ্ধ কিশোর। আরেকটু সদয় হলে হয়তো এ প্রসঙ্গে তার আলোচনাকে পশ্চিমা বিভিন্ন লেখক ও দার্শনিকদের রচনা থেকে বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খলভাবে কুড়িয়ে নেয়া চিন্তা-শব্দের অতিসরলীকৃত সংকলন বলা যেতে পারে। তবে এমন সদয় আচরন ড. আজাদের প্রাপ্য কি না তা নিয়ে জোরালো প্রশ্ন থেকে যায়।
হুমায়ূন আজাদ এবং তার মতো অন্যান্যদের চিন্তা ও জীবনের বাস্তবতা আল-কুরআনে আল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল আমাদের জন্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন ,
তুমি কি তাকে দেখনি, যে তার প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহরূপে গ্রহণ করেছে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে? তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশ লোক শোনে অথবা বুঝে? তারা কেবল পশুদের মতো; বরং তারা আরো অধিক পথভ্রষ্ট।
(তর্জমা, সূরা আল ফুরক্বান, ৪৩-৪৪)
এবং তিনি বলেন,
তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই তো শেষ; আমরা মরি ও বাঁচি। মহাকালই আমাদেরকে ধ্বংস করে। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে।
– [তর্জমা, সূরা জাসিয়া: ২৪]
একথাগুলো উপলব্ধি করতে পারলে ড. হুমায়ূন আজাদ এবং তার মতো অন্যান্যদের দিয়ে আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। তবে একটা প্রশ্ন থাকে – মৌলিকত্ব ও বিশেষত্বহীন ড. হুমায়ুন আজাদের রচনা নিয়ে বই লেখার কারন কী? প্রয়োজনই বা কী?
আমার মতে সারবস্তুর দিক দিয়ে মূল্যহীন হলেও ড. হূমায়ুন আজাদের চিন্তা ও লেখা বাংলাদেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ সুশীল-বুদ্ধিজীবিদের বড় একটি অংশের চিন্তা ও চিন্তাগত দেউলিয়াত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। নিজ কামনাবাসনা, খেয়ালখুশি ও অভ্যস্থতাকে জায়েজ করার জন্য ঔদ্ধত্য, তাচ্ছিল্ল্য ও অজ্ঞতাভরে ব্রাহ্মণসুলভ উন্নাসিকতায় স্রষ্টা ও ধর্মের বিরুদ্ধে আবেগী তর্ক করে যাওয়া ড.হুমায়ুন আজাদকে এক অর্থে প্রগতিশীল, সংস্কৃতিমনা, সুশীল বাঙ্গাল নাস্তিকের আর্কেটাইপ (archetype) বলা চলে। মুক্তচিন্তার নামে অনলাইনে ইসলামকে গালাগালি করে চলা মুক্তমনাদের অনেকেই নিজেদের ভেতরে হূমায়ুন আজাদকে ধারন করে। ইসলামবিদ্বেষের ধরন, কারন, প্রেরনা এবং মানের দিক থেকে এসব ব্লগার ও লেখকদের অনেককেই বলা যেতে পারে হুমায়ূন আজাদের মানসসন্তান।
বছরের পর বছর তারা পুনরাবৃত্তি করে যায় সেই একই ধরাবাঁধা কুযুক্তি, রেটরিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাইয়ের। তামাদি হয়ে যাওয়া মুখস্থ চিন্তা উগড়ে দিয়ে, নির্দেশিকা হুবহু অনুসরণ করে ধাপে ধাপে ‘প্রথাবিরোধী’ হয়ে ওঠার আপ্রান চেষ্টা চালায়। আর একারনেই নাস্তিকদের আইডল বনে যাওয়া এ মানুষটির চিন্তার দৈন্য, ভ্রান্তি ও অসংল্গনতা তুলে ধরা দরকার। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া দরকার যাকে বিল্পবী চিন্তাবিদ মনে করা অনুকরণ করা হচ্ছে, বেদীতে বসিয়ে ফুল দেয়া হচ্ছে, যার অনুকরনে প্রথাবিরোধি সাজা হচ্ছে, সে নিজে স্রোতে গা ভাসানো আত্মমুগ্ধ অনুকরনকারী ছাড়া আর কিছু ছিল না।
ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রচার এবং বিশুদ্ধ তাওহিদের আহবানকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ময়দানে নাস্তিকতা সবচেয়ে প্রকাশ্য শত্রু হলেও দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে ক্ষতিকর শত্রু না। বরং এর চেয়েও আরো ক্ষতিকর ও আগ্রাসী আদর্শিক শত্রু আমাদের অলক্ষেই হয়তো আমাদের ভেতর ঢুকে পড়েছে। আশা করি লেখকেরা এ সত্য উপলব্ধি করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করবেন এবং সচেষ্ট হবেনে মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পরাজিত মানসিকতা ও মানসিক দাসত্ব থেকে উত্তরনের রূপরেখা স্পষ্ট করতে।
১৯ শে জুমাদিউল আউয়্যাল, ১৪৪০ হিজরি
২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯
Rafan Ahmed এর ‘অবিশ্বাসী কাঠগড়ায়’ বইয়ের জন্য লেখা ভূমিকা থেকে।