ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাবের শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি হয় পিতার কাছেই। তার পিতা ছিলেন উয়াইনা শহরের একজন নামকরা বিচারক। এটি অবস্থিত বর্তমান রিয়াদ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে। তিনি ইলম অর্জনের পেছনে পরিশ্রম শুরু করেন প্রাথমিক জীবন থেকেই।
প্রায় সকল পথিকৃৎ, সালফে সালেহীনদের জীবনী আলোচনা করলেও আমরা দেখতে পাব ইলমের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা এবং জীবনভর তা আঁকড়ে রাখার চিত্র। আজকাল মানুষ বাছবিচার না করেই কথা বলে যায়, হোক তা উপকারী কিংবা অনুপকারী। আপনারা জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্ব দিন, উপকারী এবং সুদৃঢ় জ্ঞান অন্বেষণ করুন। ইলম অর্জনের পর আপনার আগের বলা কিছু কথা নিয়ে আপনি নিজেই হাসাহাসি করবেন। যদি সম্ভব হয় আরবী শিখুন এবং আরবী বইগুলো পড়ুন। কেননা ইংরেজিতে রেফারেন্স বইয়ের সংখ্যা নেই। হাদীস শিখুন, ফিকহ শিখুন। কেন শিখবেন না?
ইমাম বুখারী হাদীস সংগ্রহের জন্য শাম থেকে ইরাকে, সেখান থেকে আরব উপদ্বীপ তারপর বসরা, সমরখন্দে গিয়েছিলেন। আপনি ২০ মিনিট কিংবা ৩০ মিনিট ভ্রমন করতে পারবেন না! আমাদের পূর্বপুরুষ এই মহামনীষী সাধকগণ জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁদের জীবনে এত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, আর আপনি এই সামান্য প্রচেষ্টাটুকু করতে পারবেন না? দ্বীন শেখার হালাকায় বসতে পারবেন না?
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব তার পিতৃগৃহে জ্ঞানার্জন শুরু করেছিলেন। বাবার কাছে শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর তিনি গেলেন মক্কায়, এবং সেখানকার প্রায় বিভিন্ন আলিমদের কাছে থেকে শিখলেন। তারপর গেলেন মদীনায় সেখানেও আলিমদের সোহবতে ইলম শেখার পর তিনি ইরাকে গেলেন। তার জন্মভূমি ও পরিবারক এবং অন্য সবকিছু ত্যাগ করে তিনি ইলম অর্জনের জন্য ইরাকে যান। তিনি ছিলেন সঠিক আকীদার দৃঢ়প্রতিষ্ঠ। তিনি প্রথমে ইলম অর্জন করলেন এবং বাতিল আকীদা থেকে সঠিক আকীদা পৃথক করলেন। তিনি কোন সুফী শায়খে পরিণত হলেন না, যেটা সেসময় খুব জনপ্রিয় এবং লাভজনক ছিল। অনেক সময় মানুষ আল্লাহকে ছেড়ে বিভিন্নভাবে ঐসব সুফীদের ইবাদত করত।
ইরাকে তিনি তাঁর দাওয়াতী মিশন শুরু করলেন। তখন কী হল?
সাধারণ মানুষদের অনেকে তাঁর অনুসরণ করল, আলিমদের মধ্যে যারা হক্বপন্থী ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে সমর্থন দিলেন। যখন গভর্নর ব্যাপারটা লক্ষ করল তখন বিভ্রান্তি বা সমস্যা সৃষ্টির অভিযোগে তাঁকে বের করে দেয়া হল। ফরমান জারি হল দেশত্যাগের। অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে তিনি পরিস্থিতির মোকাবেলা করলেন।
মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব! ইনিই সেই মানুষ যার নামের সাথে জড়িত ‘ওয়াহাবী/ওহাবী’ শব্দটি। যদি তাঁর যে মতাদর্শ ও জীবনযাপনের পদ্ধতি, সেটার নাম ওহাবী হয়, তাহলে সবার আগে আমি বলবো, আমি একজন ওয়াহাবী। আমি জানিনা তারা ওয়াহাবী বলতে কী বোঝাতে চায়। তারা একে একটা গালি হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু যারা ওয়াহাবী বলে গালি দেয় তাদের ৯৯% লোক জানেইনা ওয়াহাবী কী।
ওয়াল্লাহি! শতকরা ৯৯ জনই জানেনা। আর যারা দাবী করে যে তারা জানে ওয়াহাবী কী, তারাও সঠিক ওয়াহাবী কী তা জানেনা।। ওয়াহাবী কী- আজ আমরা এসব জানার চেষ্টা করব। যেমন দাবী করা হয় মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব কি আসলেই তেমন মন্দ লোক ছিলেন? নাকি তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক যিনি পুনর্জীবিত করেছিলেন মুসলিম উম্মাহকে?
ইরাক থেকে ফিরে এসে তিনি আহসাতে যেতে চাইলেন। এটা বর্তমানে সৌদি আরবের একটি শহর। তার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় সেখানে না গিয়ে তিনি জন্মস্থান উয়াইনাতে গেলেন। গিয়ে জানতে পারলেন গভর্নরের সাথে বিরোধ হওয়ায় তাঁর পিতা; যিনি শহরের ক্বাজী ছিলেন, উয়াইনা ছেড়ে চলে গেছেন। এখন বসবাস করছেন উয়াইনার কাছাকাছি একটি জায়গায়। তিনি পিতার কাছে অবস্থান করতে লাগলেন এবং ইরাকের মতো এখানেও শুরু করলেন তাঁর দাওয়াতী মিশন। অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক সমর্থক তৈরি হল। সেই শহরের প্রশাসক কিছুটা নিরপেক্ষ প্রকৃতির ছিলেন তাই প্রথমদিকে তেমন বাঁধা আসলোনা। কিন্তু সমস্যা দেখা গেল যখন কিছু দুর্বৃত্ত মুহাম্মাদ ইবনুল ওয়াহ্হাবকে হত্যার ষড়যন্ত্র করলো। তিনি তখনও হাতে অস্ত্র নেননি। কেবলই শান্তিপূর্ন দাওয়াহ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর দাওয়াহর উদ্দেশ্য ছিল এই – আমি মানুষকে শিরক থেকে বিরত রাখতে চাই, এবং চাই যে তারা কেবল এক আল্লাহর ইবাদত করুক। মানুষ যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যেন তারা শপথ না করে। সুফীবাদের নামে বিদআতি কার্যকলাপ বন্ধ করতে চাই।
সেই সময় আকীদাহই একমাত্র সমস্যা ছিলোনা বরং চরম অবনতি ঘটেছিল আইন শৃংখলা পরিস্থিতিরও। মানুষের জান মালের কোন নিরাপত্তা ছিলনা বললেই চলে। নিহত বা আক্রান্ত না হয়ে কেউ মরুভূমিতে অল্প কয়েক মাইলও সফর করতে পারতোনা। মহিলারা ধর্ষিত হচ্ছিল। তাঁর কার্যক্রমের মাধ্যমে কিভাবে এই পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল সেটা নিয়েও অনেক কথা বলা যেতে পারে, তবে আমিঃ এখানে শুধু আক্বীদা নিয়ে তাঁর কাজের কথা আলোচনা করছি।
তিনি জানতেন লোকেরা তাকে হত্যা করতে পারে। এমন অবস্থায় তাকে পরামর্শ দেয়া হল দেশত্যাগের। লক্ষ করুন আবারও তাকে বের করে দেয়া হল। তিনি তার পিঠে বোঝা নিয়ে দেশান্তরী হলেন। সেই লোকদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন তিনি তাদের উপর দয়া করলেন এবং ক্ষমা করে দিলেন। বললেন, আমাকে বের করে দিতে চাও; ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। তারপর তিনি জন্মভূমি উয়াইনাতে ফিরে আসলেন এবং দেখা করলেন গভর্নর উসমান ইবনু মুহাম্মাদ এর সাথে। গভর্নর তাঁকে বললেন, আমরা সাধ্যমত আপনাকে সাহায্য করব। কেননা আপনি সঠিক পথের ওপরেই আছেন।
[শায়খ আহমাদ মুসা জিব্রিল হাফিযাহুল্লাহ এর ‘Heroes Of Islam – Muhammad Ibn Abdul Wahhab থেকে অনূদিত।]