হাকলবেরি এবং গণতন্ত্র


ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর মধ্যে ছিল ম্যাক্সিম গোর্কির ‘আমার ছেলেবেলা’ আর মার্ক টোয়েনের ‘হাকলবেরি ফিনের দুঃসাহসী অভিযান’। দুটো দুই দুনিয়ার বই, কিন্তু আমার কাছে বেশ লাগতো, চোখে পড়তো দুটোর মাঝে কিছু সাদৃশ্যও। বইগুলো পড়া হতো বারবার করে। গোর্কির ছেলেবেলা নিয়ে যতো নিঝনি নভগোরোদ; বইয়ের গন্ধমাখা তুষারঢাকা এক পৃথিবীতে। মিসিসিপি নদীর তীর ঘেষে দুশ্চিন্তাহীন ভেসে চলার আনন্দ, অদ্ভূত সব অ্যাডভেঞ্চার, আর পাতায় পাতায় টোয়েনের বিখ্যাত স্যাটায়ার আর ড্রাই হিউমারের স্বাদ পেতাম হাকলবেরির অভিযানে। যদিও স্যাটায়ারের অনেকটুকুই তখন মাথার ওপর দিয়ে যেতো। যা হোক, বই রিভিউ, কিংবা বইদুটো নিয়ে আদিখ্যেতা এ লেখার উদ্দেশ্য না। উদ্দেশ্য হল হাকলবেরি ফিনের দুঃসাহসী অভিযান বইয়ের ছোট্ট একটা অংশ শেয়ার করা। কেন করা, সেটা পড়ে বলছি।

বন্ধু জিমের সাথে কথোপকথনের বর্ণনা দিচ্ছে হাকলবেরি। দুজনেরই পলাতক। হাক বাড়িপালানো কিশোর আর জিম হল পলাতক দাস। ডিঙ্গিতে করে মিসিসিপির ওপর ভাসতে ভাসতে এক অলস সকাল কিংবা দুপুরের কথা।

“জিম – …কী বলো হাক! ফরাসীরা কি আমাদের মতো করে কথা বলে না?

হাকলবেরি – না, জিম। তুমি ওদের কোন কথা বুঝবা না। একটা শব্দও না।

জিম – আজিব ব্যাপার! এটা কিভাবে সম্ভব!

হাকলবেরি – জানি না, তবে ওদের কিছু কথাবার্তা আমি একটা বইতে দেখসি। ধরো একজন ফরাসি লোক এসে যদি তোমাকে বলে, ‘পলিভুঁ ফ্রাঞ্জি’ – তাহলে তুমি কী ভাববা?

জিম –কিছুই ভাববো না। শুধু একটা পটকান দিয়া মাটিতে ফালায় দিবো। আমাকে এসব বলে কোন ব্যাটা পাড় পাবে না!

হাকলবেরি – আরে! সে তো তোমাকে গালি দিচ্ছে না। এটা কোন গালি না! সে আসলে বলতেসে, ‘তুমি কি ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারো?’

জিম – তাহলে সেটা বললেই হয়

হাক – লোকটা সেটাই বলতেসে। ফরাসিতে এভাবেই বলে

জিম – তাহলে সে লোকটা আজিব কিসিমের এবং তার কথা বলার ধরণও আজিব। এতো ঢং না করে কথাটা সোজাসুজি বললেই হয়।

হাক – আচ্ছা জিম শুন, একটা বিড়াল কি আমাদের মতো কথা বলে?
জিম – না, বলে না

হাক – একটা গরু কি আমাদের মতো করে কথা বলে?
জিম – না, গরুও আমাদের মতো করে কথা বলে না

হাক – বিড়াল কি গরুর মতো করে কথা বলে? কিংবা গরু কি বিড়ালের মতো করে কথা বলে?
জিম – না, কেউ কারো মতো করে কথা বলে না

হাক – এটাই কি স্বাভাবিক না যে বিড়াল আর গরুর কথা বলার ধরণ আলাদা?
জিম – অবশ্যই

হাক – আর এটাও কি স্বাভাবিক না যে বিড়াল আর গরু, মানুষের মতো করে কথা বলে না?
জিম – হ্যাঁ, অবশ্যই

হাক – ঠিক! তাহলে একজন ফরাসী আমাদের মতো করে কথা বলবে না, এটা কেন স্বাভাবিক না? বলো দেখি?

জিম – হাক, একটা বিড়াল কি একটা মানুষ?
হাক – না

জিম – তাহলে বিড়ালের মানুষের মতো করে কথা বলার কোন কারণও নাই, তাই না? আচ্ছা একটা গরু কি একটা মানুষ? কিংবা একটা গরু কি একটা বিড়াল?
হাক – না, বিড়াল গরুও না, মানুষও না

জিম – তাহলে একটা গরুরও বিড়াল কিংবা মানুষের মতো করে কথা বলার কোন কারণ নাই। তাইলে হাক এখন আমারে বলো, একটা ফরাসী লোক কি একটা মানুষ?
হাক – হ্যাঁ

জিম – সেইটাই! তাইলে একটা ফরাসী লোক কেন মানুষের মতো করে কথা না বলে এতো নকশা করবে? জবাব দাও!”

আমি তখন বুঝতে পারলাম কথা বাড়ানোর কোন অর্থ হয় না। একটা নিগারকে আপনি তর্ক করতে শেখাতে পারবেন না। তাই আমি ক্ষান্ত দিলাম।”[১]

অভিয়াস হিউমারের বাইরেও এ কথোপকথনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। আছে বিভিন্ন স্তর। দুটোর ভাষার পার্থক্য বোঝায় জিমের হাস্যকর সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটা পাঠক ধরতে পারলেও চিন্তার অন্য কিছু সীমাবদ্ধতা অতোটা সহজে ধরা যায় না। ছোট থাকতে এতো শত না বুঝেই এটুকু পড়ে খুব হেসেছিলাম। জিমের নাছোড়বান্দা যুক্তির বাহার দেখে না হাসাটা মুশকিল।

২.

গণতন্ত্রের প্রতি আপত্তির ব্যাপারে গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থীদের আলোচনা দেখলে আমার ওপরের কথোপকথনের কথা মনে পড়ে। যাই বলুন না কেন, যতো সংক্ষিপ্ত অথবা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, উনাদের নাছোড়বান্দা যুক্তি আর মুখস্থ উত্তরের বাইরে যেতে দেখবেন না। আন্তরিকভাবে কী বলা হচ্ছে, সেটা অনুধাবন করে তারপর সেটাকে অ্যাড্রেস করা, আপত্তি ও প্রশ্নগুলো সাথে দালীলিক, যৌক্তিক কিংবা আদর্শিকভাবে এনগেইজ করা, এমন কিছুর আশাই তাদের কাছ থেকে করা দুরূহ। পলিভুঁ ফ্রাঞ্জির অর্থ কী হতে পারে সেটা নিয়ে তারা চিন্তিত না। উনারা উৎসাহী পটকান দিয়ে মাটিতে আছড়ে ফেলতে।

ঘুরেফিরে সেই একই আলাপ –

“গণতন্ত্র মানে শূরা আর শূরা ইসলামে আছে

গণতন্ত্র নাহলে কি তাহলে রাজতন্ত্র?

আর কতোদিন সৌদির দালালী করবেন?

গণতন্ত্র কোন পদ্ধতি না, গণতন্ত্র একটা টুল, একটা উপকরণ

পশ্চিমা গণতন্ত্র খারাপ হলে পশ্চিমা ফেইসবুক ব্যবহার করেন ক্যান?

পশ্চিমা গণতন্ত্র হারাম, কিন্তু ইসলামী গণতন্ত্র সঠিক

পশ্চিমা গণতন্ত্র জনগণকে সার্বভৌম বলে, ইসলামী গণতন্ত্র আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করে

ইসলাম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি কী হবে তা নিয়ে অনেক মত থাকতে পারে, তাই বলে নিজের মতের সাথে না মিললেই আরেকজনকে গোমরাহ বলা উচিৎ না। ভিন্ন পদ্ধতিকে কুফর শিরক বলা উচিৎ না।

ভাই গণতন্ত্র যদি বাতিল হয় তাহলে আপনি ভিন্ন একটা পদ্ধতি বলেন”

সেই একই নাছোড়বান্দা ‘যুক্তি’র সমাহার। অংকের নিয়ম মিলছে কি না সেটার দেখার টাইম নাই, আমি উত্তর মেলাবোই। জোর করে হলেও মেলাবো। এ যুক্তিগুলোতে প্রভাবিত হয়ে যান অনেকেই। শুনতে ভালোই লাগে। আফটার অল বিড়াল তো গরু না আর গরু তো মানুষ না। কিন্তু সমস্যা হল এগুলোর কোনটাই বিরোধীপক্ষের মূল আপত্তির জায়গাটা অ্যাড্রেস করে না। গণতন্ত্রের পক্ষে তর্ক করা ইসলামপন্থীরা হয় আপত্তিগুলো বোঝেন না, অথবা বুঝেও এড়িয়ে যান।

দেখুন গণতন্ত্রের ব্যাপারে আপত্তিটা রাজতন্ত্র, আলে-সৌদ কিংবা নিছক পশ্চিমা আদর্শ কিংবা সিস্টেম হওয়া নিয়ে না। গণতন্ত্রকে যে অনেকে আসলেই উপকরণ হিসেবে দেখেন, কিংবা তারা সেক্যুলার গণতন্ত্রকে কিছুটা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, সেটাও বোঝা খুব কঠিন কিছু, এমন না। কিন্তু সমস্যাটা হল ভিন্ন ব্যাখ্যা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে যে কাজগুলো ইসলামী গণতান্ত্রিকদের করতে হচ্ছে, তা নিয়ে। একটা ইসলামী গণতান্ত্রিক দল বা রাজনৈতিক যখন সংসদে যাচ্ছে তখন তাকে কী কী করতে হচ্ছে লক্ষ্য করুন –

১) আল্লাহর আইন ব্যাতীত অন্য আইন দিয়ে শাসন করতে হচ্ছে

২) এমন এক সংবিধান সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য শপথ নিতে হচ্ছে যা এক্সপ্লিসিট আল্লাহর আইনের চেয়ে উত্তম হবার দাবি করে

৩) এমন এক সত্ত্বার (সংসদ) সদস্য হতে হচ্ছে যা আল্লাহর আইনকে অকার্যকর করে এবং তার বদলে মানবরচিত দর্শনের আলোকে নতুন বিধান প্রণয়ন করে

৪) এমন এক সত্ত্বার সদস্য হতে হচ্ছে যা আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হারাম করে এবং আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করে

৫) এমন এক সত্ত্বার সদস্য হতে হচ্ছে যা শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এমন সবাইকে দমন করে যারা ইসলামী শরীয়াহর বাস্তবায়ন চায় (সেটা যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন)

৬) শুধু এটুকুই না, এর পাশাপাশি তারা সাধারণ মুসিলম জনগণকে বিভিন্ন মাত্রায় এ পুরো পদ্ধতির সাথে সম্পৃক্ত হবার দাওয়াহ করছে

এ কাজগুলোর কুফর আকবর যা মানুষকে ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং এর মধ্যে কিছু হল শিরক আকবর। এটা কোন নির্দিষ্ট দল, সংগঠনে, গোষ্ঠী কিংবা মাসলাকের কথা না, বরং কুরআন, সুন্নাহ আসার দ্বারা প্রমাণিত অবস্থান। এ অবস্থানের ওপর আলিমগণের শত শত বছরের সিলসিলা আছে মাসলাক-মাযহাব নির্বিশেষে। কাজেই এখানে বিষয়টা ঈমান-কুফর, তাওহিদ ও শিরকের। নিছক মতের অমিল হবার কারণে কাউকে গোমরাহ বলা, তাকফির করা কিংবা কারো বিরোধিতা করা এখানে উদ্দেশ্য না। ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করুন –

চাকরি করাকে ঢালাওভাবে কেউ হারাম বলে না। কিন্তু আপনি ঠিক করলেন মন্দিরে পুরোহিতের চাকরি নিয়ে সেটাকে মসজিদ বানাবেন। ধীরে ধীরে মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে সেখানে সালাত শুরু করবেন। এ উদ্দেশ্য আপনি পুরোহিতের চাকরি নিলেন, প্রতিদিন দুই বেলা করে মূর্তির সামনে আরতি দিলেন, প্রণাম করলেন, পূজা করলেন। তবে মনে মনে আপনি বিশ্বাস করেন আল্লাহকেই। আপনার উদ্দেশ্য হল আস্তে আস্তে মন্দিরকে মসজিদ বানানো। এখন কেউ যদি এসে আপনাকে বলে, তুমি যে কাজটা করছো সেটা শিরক। তোমার জন্য এ চাকরি হারাম। তখন নিজেকে সঠিক সাব্যস্ত করতে হলে ইসলাম প্রতিষ্ঠার নিয়্যাতে সাময়িকভাবে শিরক ও কুফরে লিপ্ত হবার বৈধতার পক্ষে আপনাকে প্রমাণ দিতে হবে।

সেটা না করে, আলে সৌদ, রাজতন্ত্র, আপনার নিয়্যাত ভালো, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার প্রয়োজনীয়তা এসব গল্প শুনিয়ে লাভ নেই। সেই সাথে ‘তুমি পারলে একটা ভিন্ন পথ দেখাও’ এমন বলাটা অনর্থক। কারণ এক, গণতন্ত্র দিয়ে কিভাবে ইসলাম কায়েম হবে, এটা নিয়ে গণতান্ত্রিক ইসলামপন্থীরা নিজেরাই কনফিউযড। যে প্রশ্ন করে তারা অন্যের মুখ বন্ধের চেষ্টা করছেন সেটার উত্তর তাদের নিজেদেরই জানা নেই। দ্বিতীয়ত, ঈমানের প্রথম শর্ত হল শিরক ও কুফর বর্জন করা। প্রত্যেকের জন্য। অন্যদিকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইক্বামতে দ্বীন প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর ফরযে আইন না। কাজেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলে শিরক কিংবা কুফরে লিপ্ত হওয়াকে জায়েজ করা যায় না। আর কিছু না পারলে – পুরো কুরআন, সুন্নাহ, সীরাহ, মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, উলামায়ে কেরামের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও দৃষ্টান্ত থাকার পরও যদি কারো কাছে মনে হয় কোত্থাও সে কোন বিকল্প পদ্ধতি খুঁজে পাচ্ছে না – তাহলে সে বাসায় বসে থাকুক। নিদেনপক্ষে সে কুফর ও শিরক বর্জন করার দায়িত্ব এভাবে পালন করতে পারবে।

প্রথমত এ বিরোধিতা ইমান ও তাওহিদের জায়গা থেকে। পদ্ধতিগত মতপার্থক্য কিংবা ফলাফলের হিসেবেনিকেশের জায়গা থেকে তর্কটা সেকেন্ডারি। কাজেই সত্যিকার অর্থে এ বিরোধিতার মোকাবেলা করতে হলে হয় প্রমাণ করতে হবে ইসলামী গণতান্ত্রিক দলগুলো (বা তাদের রৌলমডেলরা) এ অপরাধগুলো থেকে মুক্ত অথবা প্রমাণ করতে হবে এ কাজগুলো শিরক না, কুফর না এবং হারামও না (কেননা হারামের পদ্ধতিই ইসলাম কায়েমের সঠিক বা শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি, এমনি বৈধ পদ্ধতি এটা দাবি করা যায় না)। যদি এ আলোচনাগুলো না করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পক্ষালম্বনকারী ভাইরা কেবল মুখস্থ জবাব আওড়ে যান, তাহলে হাকলবেরির মতো বলতেই হয়, হাউস নিগারদের [২] আপনি তর্ক করতে শেখাতে পারবেন না।


[১] অনুবাদটা ইংলিশ দেখে করা। সেবা প্রকাশনীর একটা জঘন্য অনুবাদ আছে, নেটে পাওয়া যায়। ডায়ালগের কিছুই সেখানে আসেনি। আমি যেটা পড়েছিলাম সেটা বেশ বড় সাইযের বই। সাউদার্ন আঞ্চলিক ইংলিশকে ময়মনসিং আর ঢাকার আশেপাশের কিছু এলাকার আনচলিক বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছিল। প্রকাশনীর নাম মনে পড়ছে না।

[২] হাউস নিগার – https://tinyurl.com/y6okz4wh
Malcolm X – The House Negro and the Field Negro – https://www.youtube.com/watch?v=7kf7fujM4ag


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *