দিল্লী পগরম


দাঙ্গা বা রায়টের সাথে পগরম-এর (Pogrom) পার্থক্য কী? পার্থক্য হল, পগরমে সরকার এক পক্ষকে সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন দেয়। রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে নিশ্চিন্তে, নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংস চালানো যায়। আজ ভারতে যা হচ্ছে সেটা পগরম, দাঙ্গা না। There is method to the madness. খুব হিসেব করে বজরঙ দলসহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে আছে দিল্লি পুলিশ। ২০০২ সালে যখন গুজরাটে দাঙ্গা হয়েছিল তখন বজরঙ দলের (আরএসএস-এর গুন্ডা শাখার প্রতিষ্ঠান) নেতাদের কাছে আদমশুমারী থেকে মুসলিমদের তথ্য আলাদা করে প্রিন্ট করে দেয়া হয়েছিল। বেছে বেছে মুসলিমদের আক্রমণ করেছিল ওরা। এখন দিল্লীতে তাই হচ্ছে। তবে এটা বিজেপি কিংবা আরএসএস এর মনোপলি না। এটা সেক্যুলার হিন্দু-স্তানের পুরনো ঐতিহ্য।

ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর শিখদের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল এভাবেই। গোছানো তান্ডব ছিল। আজকের মতো তখনো পুলিশ ছিল কখনো নিস্ক্রিয় দর্শক, কখনো সক্রিয় সমর্থক। হিন্দুত্ববাদীরা যখন বাবরি মসজিদ ভাঙছিলো তখন পুলিশ দাড়িয়েছিল দর্শক হিসেবে। প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ছিল ঘুমে (সত্যি বলছি, ঠাট্টা না।) এ ঘটনার পর হওয়ার মুম্বাই ‘রায়টে’-র চিত্র ছিল একইরকম। একই অবস্থা ছিল ২০১৩ এর মুজাফফারনগর ‘রায়টে’। বারবার রাষ্ট্রযন্ত্র (কংগ্রেস কিংবা বিজেপি) মুসলিমদের (কিংবা অন্য কোন সংখ্যালঘু গোষ্ঠী) বিরুদ্ধে হিন্দুদের সমর্থন এবং প্রটেকশান দিয়েছে। মিডিয়া এসব হত্যাযজ্ঞকে ওয়াইট ওয়াশ করেছে। এবং, আইসিং অন দা কেইক হল, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রীতিমত আদালতের মাধ্যমে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো ঘটনাকে এক অর্থে বৈধতা দিয়েছে। হুকুম দিয়েছে বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর রামমন্দির নির্মানের। এই হল গান্ধী, নেহেরু, আম্বেদকার আর ইন্দিরার ভারতের বাস্তবতা। সাভারকার, গোয়ালকর, মোদি আর অমিতশাহর ভারতের মতোই।

গত ২ দিনে দিল্লীতে ৩৫ জনের বেশি মারা যাবার খবর শোনা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। শতের ওপরে আহত। কেউ স্পষ্ট করে বলছে না, তবে আকারে ইঙ্গিতে যতোটুকু বলছে তাতে বোঝা যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছেন অনেক মুসলিম বোন। আল্লাহুল মুস্তা’আন। গত ক’দিনের হিসেবী তান্ডব হয়তো আর ২/৩ দিনের মধ্যে স্থিমিত হয়ে আসবে। তারপর চলবে স্বভাবসুলভ উপমহাদেশীয় তরিকায় ইতিহাস বদলানোর প্রক্রিয়া। ঠান্ডা মাথার হত্যা, লুটপাট, ধ্বংস আর ধর্ষন হয়ে যাবে ‘দাঙ্গা’। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দুত্ববাদীদের পরিকল্পিত অপারেশনকে বলা হবে ‘দাঙ্গা’, যেখানে ‘দু পক্ষেরই দোষ ছিল’। তার কিছুদিন পর হবে আবার অন্য কোন ‘দাঙ্গা’। সূর্যের চেয়ে বালি গরম হয়। হিন্দুত্ববাদীদের আগেই প্রপাগ্যান্ডা শুরু করে দিয়েছে ওদের দালাল প্রথম কালো। পগরমকে চালিয়ে দিচ্ছে ‘সংঘর্ষ’ বলে। সামনে এমন বলবে আরো অনেকে। যা-ই হোক আমরা যেন মনে রাখি এটা দাঙ্গা না। সংঘর্ষ না। এটা পগরম। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিসেব করা হত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, ধ্বংস। সামনে আগানোর জন্য এই মনে রাখাটা দরকার।

অনেক আগে পড়া একটা বইতে, সম্ভবত হিরোশিমা নিয়ে, একটা কথা পড়েছিলাম, কোন বিপর্যয়ের পর হাসপাতালে যখন একসাথে অনেক আহত মানুষ আসতে থাকে, ডাক্তাররা তখন সবচেয়ে মুমূর্ষু মানুষদের চিকিৎসা প্রথমে করেন না। বরং তুলনামূলকভাবে যারা কম আহত তাদের দিকে মনযোগ দেন (Advanced Triage)। বিষয়টা প্রথমে কাউন্টার ইন্ট্যুইটিভ মনে হয়। কিন্তু এর পেছনে যুক্তি আছে। যদি সবাইকে চিকিৎসা দেয়ার সুযোগ না থাকে, তাহলে বেছে বেছে ঐ মানুষদের চিকিৎসা দেয়া উচিৎ, যাদের বাঁচার সম্ভাবনা আছে। যাদের মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত তাদের পেছনে সময়, শ্রম খরচ করে লাভ নেই। যেহেতু সামর্থ্য সীমিত তাই হিসেব করে সেটা খরচ করতে হবে। হিসেবটা শীতল, নিষ্ঠুর কিন্তু যৌক্তিক। এ কঠিন অবস্থায় এমন অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়ে।

ভারতের আজকের অবস্থাটা আমার কাছে এরকম মনে হয়। নিঃসন্দেহে যা হচ্ছে তা সহ্য করা কঠিন। খুব কঠিন। কিন্তু এটা এমন একটা পর্যায় যার মধ্য দিয়ে অবধারিতভাবে ভারতের মুসলিমদের যেতে হবে। ভারতীয় মুসলিমরা এখনো বিদ্যমানতার ওপর ভরসা করে আছেন। মোদীর ভারতের কাছ থেকে বাঁচতে সাহায্য আশা করছেন গান্ধীর ভারতের কাছ থেকে। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে যে মুসলিমদের প্রশ্নে মৌলিক তেমন কোন পার্থক্য নেই সেটা যেভাবেই হোক, আলটিমেটলি তাদের বুঝতে হবে। কাশ্মীর এ বাস্তবতার জলজ্যান্ত সাক্ষী। আজকে দিল্লিতে যা হচ্ছে দশকের পর দশক ধরে কাশ্মীরে তা হয়েছে। গত কয়েকমাসে দিল্লিতে কিংবা উত্তরপ্রদেশে যা হয়েছে তার চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর ঘটনা গত কয়েক মাসে কাশ্মীরে ঘটে গেছে। কিন্তু কাশ্মীর থেকে ভারতের মুসলিমরা শিক্ষা নেননি। অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের পর একজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘অনেকে একে ভাবছেন কাশ্মীরের ভারতীয়করণ, কিন্তু এটা আসলে ভারতের কাশ্মীরীকরণের সূচনা’। এই মন্তব্য আজ খুব একটা ভুল মনে হচ্ছে না।

আগেকার পগরম-গুলো ছিল ইস্যুকেন্দ্রিক। হত্যাযজ্ঞের ইস্যু ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসার সুযোগ ছিল। সেই সুযোগ এখন নেই। এখনের ইস্যু হল নাগরিকত্ব আইন। ভারতীয় মুসলিমদের হয় নাগরিকত্বের দাবি ছেড়ে দিয়ে রামরাজ্য মেনে নিতে হবে, অথবা আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। যেভাবে পরিস্থিতি আগাচ্ছে তাতে দুটোর কোনটাই দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। যদি দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের দিকে ভারতীয় এবং উপমহাদেশীয় মুসলিমরা যেতে যান তাহলে আজকের এ অসহ্য কষ্টের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প দেখছি না। ভারতীয় সংবিধান, আদালত, রাষ্ট্র আর কাল্পনিক সেক্যুলার চরিত্রের ওপর ভারতীয় মুসলিমদের যে অগাধ আস্থা যতোদিন থাকবে ততোদিন সমস্যার কোন সমাধান হবে না। বিদ্যমানতাকে যদি প্রশ্ন তারা না করেন তাহলে বিদ্যমানতায় তাদের প্রশ্নের দিকে ঠেলে দেবে। কথাগুলো শুনতে হয়তো খুব নিষ্ঠুর, শীতল শোনাবে। কিন্তু কথাগুলো সত্য।

কাশ্মীর আযাদীর কথা বলে, কারণ কাশ্মীর জানে বিকল্পটা কী। বাকি ভারতকেও এই বাস্তবতাটুকু বুঝতে হবে। ভারতীয় সংবিধান, রাষ্ট্র, আদালত, সুশীল সমাজ নিয়ে কোন ফ্যান্টাসি কাশ্মীরের মুসলিমদের নেই। কাশ্মীর বাস্তবতা বোঝে। কাশ্মীর ঠেকে শিখেছে। বাকি ভারতকেও এই বাস্তবতাটুকু বুঝতে হবে।

আল্লাহ্‌ আমাদের ক্ষমা করুন। আমাদের মুসলিম ভাইবোনদের হেফাযত করুন। যারা নিহত হয়েছেন তাদের জান্নাত দান করুন। মুসলিম শিশু এবং নারীদের মুশরিকদের হাত থেকে রক্ষা করুন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *