‘বহুবিবাহের বিধানগুলো নতুন করে পর্যালোচনা দরকার’ শিরোনামের লেখাটা পড়ার পর কিছু প্রশ্ন মাথায় আসলো –
১। সব ধরণের সম্পর্কের বৈধতার একমাত্র শর্ত নাকি সম্মতি -consent. লিবারেল-সেক্যুলার ওয়ার্ল্ডভিউ এটা ধ্রুব, অমোঘ সত্য মনে করে। দেশীয় লিবারেল মিশনারীরাও খুব ঘটা করে একথা প্রচার করে। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ যদি বহুবিবাহ করে, সেটা ঐ পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা বিশতম- এখানে লিবারেল আপত্তি কোথায়? যেটা অটোনমি, এবং কনসেন্টের ‘ধ্রুব’ ও ‘অমোঘ’ নীতি দুটোর সাথে সাংঘর্ষিক না?
২। এ লেখার শুরুতে ব্রিটেনের ইন্ডিপেন্ডেন্টের বরাতে বলা হয়েছে –
“২০১৯ সালে মিসরের শীর্ষ ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আল-আজহারের প্রধান ইমাম ফতোয়া দেন যে বহুবিবাহ নারীর প্রতি ন্যায়বিচার করে না। যাঁরা বহুবিবাহকে সমর্থন করেন, তাঁরা ইসলামের ভুল অনুশীলন করছেন। তিনি বলেন যে ইসলামে একাধিক নারীকে বিয়ে করা যাবে তখনই, যখন তাঁদের সবার প্রতি ন্যায্যতা দেখানো সম্ভব হবে। কিন্তু বহুবিবাহের মাধ্যমে তা করা সম্ভব নয় (দ্য ইনডিপেনডেন্ট, ৩ মার্চ ২০১৯)”।
কিন্তু আমি খুঁজে দেখলাম ইন্ডিপেন্ডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-আযহারের আহমাদ তাইয়েব বলেছেন,
‘যারা মনে করে বিয়ে মাত্রই বহুবিবাহ হতে হবে তারা ভুল করছে’। ‘স্ত্রী দের মধ্যে ইনসাফ করতে না পারলে বহুবিবাহ যুলুম’।
প্রতিবেদনের শেষে আরো বলা হয়েছে যে আল-আযহার এ বক্তব্যের পরে অবস্থান স্পষ্ট করেছে যে আহমাদ তাইয়েব বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার কথা বলেনি।
আরো কিছু পশ্চিমা নিউয সোর্স থেকে জানলাম, আহমাদ তাইয়েবের বক্তব্য হল,
‘বহুবিবাহ একটি শর্তসাপেক্ষ অধিকার, অথবা বলা যায় যে এটি শর্তসাপেক্ষে অনুমোদিত এবং এর জন্য যথাযথ কারণ প্রয়োজন। যদি কারণ না থাকে তাহলে অনুমোদন অপসারিত হবে। এবং বহুবিবাহ যেভাবে প্র্যাকটিস করা হচ্ছে তা অনেক সময় ‘নারী ও সন্তানদের জন্য যুলুম হয়ে দাড়ায়’ এবং ‘স্বামীদের অবশ্যই ইনসাফ বজায় রাখতে হবে। ইনসাফ বজায় না একাধিক স্ত্রী রাখা হারাম’।
প্রথম কালোর লেখায় বলা নিচের কথা দুটো খেয়াল করুন –
‘যাঁরা বহুবিবাহকে সমর্থন করেন, তাঁরা ইসলামের ভুল অনুশীলন করছেন… ‘ইসলামে একাধিক নারীকে বিয়ে করা যাবে তখনই, যখন তাঁদের সবার প্রতি ন্যায্যতা দেখানো সম্ভব হবে। কিন্তু বহুবিবাহের মাধ্যমে তা করা সম্ভব নয়’
ইন্ডিপেন্ডেন্টের রিপোর্টে কিংবা অন্য পশ্চিমা মিডিয়ার রিপোর্টে – ‘বহুবিবাহ সমর্থন ইসলামের ভুল অনুশীলন’ – এই বক্তব্য দেখলাম না। ‘বহুবিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীদের প্রতি ন্যায্যতা দেখানো সম্ভব না’ – এটাও পেলাম না। বরং আল-আযহারের পরবর্তী বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তারা বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার কথা বলছে না।।
৩। আল-আযহারের বক্তব্য আনাটা বেশ ইন্ট্রেস্টিং। আল-আযহার একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। তাদের অথোরিটি ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে। আপাতত এটুকুও ধরে নেয়া যায় যে তারা তাদের মতামত পেশ করে ইসলামী নুসুস এবং ফিকহের সাপেক্ষে। সেক্যুলার রাষ্ট্রের আইন সংশোধনের ব্যাপারে আল-আযহারের বক্তব্য আনার মানে কী? সেক্যুলার রাষ্ট্র কি শরীয়াহর জ্ঞানতত্ত্বকে গ্রহণ করবে?
কথাটা সহজ করে বলা যায়। এখানে কি আলিমের বক্তব্য আনা হয়েছে কারণ এই আইন সংশোধনের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াহর অবস্থান কী, সেটা জানা জরুরী মনে করা হচ্ছে? নাকি এই আলিমের বক্তব্য লিবারেল অবস্থানের সাথে মিলে যাওয়ার কারণে তার বক্তব্য আনা হচ্ছে?
যদি ইসলামী শরীয়াহর অবস্থান আসলে জরুরী মনে করা হয়, তাহলে শুধু আল-আযহারের বক্তব্য কেন? মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সাউদির গ্র্যান্ড মুফতি, দারুল উলুম দেওবন্দের বক্তব্য, মৌরিতানিয়ার মুফতিদের বক্তব্য কোথায়? কেন তাঁদের বক্তব্য দেখা হবে না, শুধু আযহারের বক্তব্য দেখা হবে?
যদি ইসলামী জ্ঞানতত্ত্বকে আমলে নেয়া হয় তাহলে হিজাব কিংবা যিনা (ডেইটিং) এর ব্যাপারেও কি নেয়া হবে? বাকিদের কথা বাদ দিলাম শুধু আল-আযহারের বক্তব্যও কি এসব ক্ষেত্রে আমলে নেয়া হবে? নাকি এটা শুধু অপুরটুনিস্টিক কৌট মাইনিং? আবারো, একে কি জার্নালিস্টিক এবং অ্যাকাডেমিক ইন্ট্রেগ্রিটি বলা যায়?
৪। লেখায় বলা হয়েছে –
‘বহুবিবাহ ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ কি না, এ বিষয়ে বিতর্ক আছে। তবে ইসলাম যে বহুবিবাহকে নিরুৎসাহিত করে, এ বিষয়ে অনেকেই একমত। ইসলামি আইনের বেশির ভাগ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, ইসলাম একগামিতাকে আদর্শ বিবেচনা করে, বহুবিবাহ ব্যতিক্রম।’
এই ‘অনেকে কারা’? ইসলামী আইনের এই পর্যালোচনাকারীরা কারা? তাদের ক্রেডেনশিয়াল কী? তাদের অবস্থান শরয়ী আলোচনার ক্ষেত্রে কী গুরুত্ব রাখে? আর সেক্যুলার রাষ্ট্র চাইলে বহুবিবাহ কেন, ঢালাও ভাবে বিয়েকেও নিষিদ্ধ করতে পারে। এর জন্য ‘ইসলাম কী বলে’ সেটাকে টানতে হবে কেন?
আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, একদিকে এভাবে ‘ইসলামের অবস্থান কী’ – সেটা বলার চেষ্টায় যথেষ্ট অস্পষ্টতা আছে।ইসলামের অবস্থান সম্পর্কে বলার অথোরিটি কার, সেই প্রশ্নের উত্তর আসছে না।
অন্যদিকে নিরেট সেক্যুলার দৃষ্টি থেকে এমন জোড়াতালির ‘ধর্মীয় বৈধতা’ (কিংবা অবৈধতা) তালাশ করাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কপটতাপূর্ণ মনে হয়।
৫। লেখায়, পাকিস্তানের একটি আইনের আলোচনায় বলা হয়েছে -‘এ আইনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বহুবিবাহের মতো বৈষম্যমূলক একটি প্রথাকে রোধ করা।’
বহুবিবাহ বৈষম্যমূলক, এই উপসংহারে কীসের ভিত্তিতে টানা হল? বৈষম্যের কোন মাপকাঠি অনুযায়ী? তাইয়েব এবং আযহার যে অর্থে বলেছে সেই অর্থে? নাকি নারীবাদীরা যে অর্থে বলে সে অর্থে? নাকি ক্রিশ্চিয়ানিটির রেলিক বয়ে বেড়ানো পশ্চিম যে অর্থে বহুবিবাহকে কালচারালি ‘খারাপ’ মনে করে সেই অর্থে? এ বিষয়টা স্পষ্ট করা কি জরুরী না? বহুবিবাহ বৈষম্যমূলক – এই উপসংহার মুখস্থ চালিয়ে দেয়ার কারণ কী?
৬। লেখায় বলা হয়েছে – .’ প্রগতিশীল জ্ঞানচর্চার সুযোগ তৈরি করতে না পারলে ধর্মের অপব্যাখ্যাগুলোই আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।’
সেক্যুলার আইনের অধ্যাপক? সেক্যুলার রাষ্ট্র? জাতিসঙ্ঘ? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা? আল-আযহার? তিউনিশিয়া কিংবা তুরস্কের সরকার?
যদি সেক্যুলার রাষ্ট্র, বুদ্ধিজীবি, অ্যাকডেমিক কিংবা সংস্থা সেক্যুলার জ্ঞানতত্ত্ব এবং মূল্যবোধ অনুযায়ী উপসংহার টেনে সেটাকে ইসলামের ওপর চাপিয়ে দেয়, এবং বলে ‘এটাই ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা আর বাকি সব ব্যাখ্যা হল অপব্যাখ্যা’ – তাহলে সেটাকে আসলে কী বলে? ধর্মীয় স্বাধীনতার চর্চা বলে? ধর্মব্যবসা বলে? নাকি অন্য কিছু?
এমন আরো কয়েক হালি প্রশ্ন করা যায়। তবে সেক্যুলার ব্যবস্থা এবং ধর্ম নিয়ে, বিশেষ করে ইসলাম নিয়ে সেক্যুলারদের আলোচনার প্রতারণাপূর্ণ ধরন বোঝার জন্য এটুকু যথেষ্ট। .সোজাসুজি বললেই হয়, ‘আমাদের কাছে ভালো লাগে না, তাই আমরা বাতিল করতে চাই’। এতো নৌটাঙ্কি করার দরকার কেন পড়লো?