আধুনিক পশ্চিম বলে মানবসভ্যতার গ্রাফ সময়ের সাথে উর্ধমুখী। যতো সময় যাচ্ছে ততো মানুষের অগ্রগতি হচ্ছে। এই অগ্রগতি সামগ্রিক। জ্ঞানবিজ্ঞান, মানবতা, নৈতিকতা, প্রযুক্তি; অগ্রগতি হচ্ছে সব দিকে। যতো সময় যাবে মানুষ ততো উন্নত হবে। সবসময়, গতকালের চেয়ে আগামীর মানুষ শ্রেষ্ঠ হবে।
কিন্তু ইসলাম থেকে আমরা সম্পূর্ণ উল্টো শিক্ষা পাই। ইসলাম থেকে আমরা জানি, নবী (ﷺ)-এর ওফাতের পর থেকে মানবসভ্যতার গ্রাফ সময়ের সাথে নিম্নমুখী। সবচেয়ে জ্ঞানী, সবচেয়ে সভ্য, সবচেয়ে নৈতিক, সবচেয়ে পরিপূর্ণ, শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম ছিল নবী (ﷺ)-এর প্রজন্ম। তারপর থেকে ক্রমাগত অবস্থার অবনতি হচ্ছে, এবং কিয়ামতের আগ পর্যন্ত এই অবস্থা চলবে।
নবী (ﷺ) বলেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজন্ম তাঁর প্রজন্ম, অর্থাৎ সাহাবীদের (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রজন্ম। তারপর তাবেঈ-দের প্রজন্ম। তারপর তাবে-তাবেঈদের প্রজন্ম। প্রত্যেক শুক্রবারে জুমু’আহর খুতবাতে আমরা এ কথাটা শুনি। এই হাদীস থেকে সভ্যতা, শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে ইসলামের শিক্ষা আমরা পাই। কিন্তু অভ্যস্ততার কারনেই হয়তো, আমরা কথাটাকে যথাযথ গুরুত্ব দেই না।
নবী (ﷺ)-এর প্রজন্ম শ্রেষ্ঠ কেন?
সাহাবীদের মধ্যে তো বিশ্বখ্যাত কোন বিজ্ঞানী ছিল না। সাহাবীদের অধিকাংশকেই শিক্ষিত বলা যায় না। লিখতেপড়তে জানা সাহাবার সংখ্যা বেশ কম ছিল, রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম। প্রযুক্তির দিক থেকে বর্তমানের সাথে তো তুলনাই চলে না। স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং এর দিক থেকে পারস্য আর বাইযেন্টাইন ছিল সমৃদ্ধ। মদীনার অবস্থা ছিল শোচনীয়। খোদ নবী (ﷺ)- দিনের পর দিন অভুক্ত থেকেছেন। ঘুমিয়েছেন খেজুর পাতার পাটিতে। আর যে অর্থে আমরা আজকে ‘অধিকার’ এর কথা বলি, সেই স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী মদীনাতে তো ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ হতো। আধুনিক লেন্সের ভেতরে দিয়ে তাকালে ব্যক্তিঅধিকার, নারী অধিকার, সাম্য, মানবতা অনেক কিছুই মদীনাতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আব্বাসী খিলাফতের অধীনস্ত বাগদাদ, উমাইয়্যাদের অধীনস্ত আন্দালুস কিংবা উসমানীদের ইস্তামবুলের সাথেও তো এই মাপকাঠিগুলোর দিক থেকে মদীনার তুলনা করা যায় না। .
জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থ-বাণিজ্য, জীবনযাত্রার মান, বস্তুবাদী সুবিধা, আধুনিক অধিকারের আলাপ – কোন দিক থেকেই মদীনাকে শ্রেষ্ঠ বলা যায় না। কিন্তু তবু নবী (ﷺ)-এর প্রজন্মই কেন শ্রেষ্ঠ? যদি এগুলোই সভ্যতার প্রধান মাপকাঠি হয় তাহলে সাহাবীদের (রাদ্বীয়াল্লাহু আনহুম) প্রজন্ম শ্রেষ্ঠ কীভাবে? শুধু এক ভাবেই এই প্রজন্মকে শ্রেষ্ঠ বলা যায়। যদি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি অন্য কিছু হয়। সেই অন্য কিছুটা কী?
বিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ তাওহিদের জ্ঞান এবং বাস্তবায়ন। কুরআন সুন্নাহর ইলম। ইসলামী শরীয়াহর শাসন। কুরআনের শিক্ষা এবং নববী সুন্নাহর অবিকৃত, বিশুদ্ধতম অনুসরণ। তাক্বওয়া, তাসাউফ, যুহদ, তাওয়াক্কুল। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি এগুলো। ইসলামী সভ্যতার ধারণার কেন্দ্রে আছে এই বৈশিষ্ট্যগুলো। জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তির মতো চলকগুলো সভ্যতার সেকেন্ডারি বৈশিষ্ট্য হতে পারে। এগুলোর দরকারও আছে। কিন্তু এগুলো সভ্যতার এবং শ্রেষ্ঠতার মৌলিক চলক না।
কিন্তু আমরা যখন ক্রমাগত জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অধিকার, জীবনযাত্রার মানের মতো মেট্রিকগুলো দিয়ে ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে যাই, তখন এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। সভ্যতার আধুনিক পশ্চিমা ব্যাখ্যা আমরা গ্রহণ করে নেই। নিজস্ব ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে বোঝার চেষ্টা করি সেই লেন্সের ভেতরে। আবার উম্মাহর পুনঃজাগরণকেও আমরা এই মেট্রিকগুলোর বেঁধে দেয়া ছকের ভেতর চিন্তা করি। তাই ইমাম আহমাদ এর বদলে ইবনে সিনাকে দিয়ে আমাদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রমাণের চেষ্টা করতে হয়।
অসংখ্য ইসলামী বুদ্ধিজীবি, আন্দোলন এবং দলকে আমরা বলতে দেখি, ইসলামের বিজয় আসবে জ্ঞানবিজ্ঞানে উন্নতির মাধ্যমে। ক্যারিয়ার বানিয়ে। ইসলামের সৌন্দর্য দিয়ে কাফিরদের মুগ্ধ করে দিয়ে, অমুক সংখ্যক পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে, অ্যাকাডেমিয়াতে ঢুকে ‘রেভ্যুলুশান’ করে ফেলে, জ্ঞানবিজ্ঞান শিল্পসাহিত্যে ইসলামী রেনেসাঁর মাধ্যমে, কিংবা ইসলামকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করে। ইসলামী শরীয়াহর ব্যাপারে জ্ঞানতাত্ত্বিক আমূল পরিবর্তন এনে…
কিন্তু যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম শ্রেষ্ঠ, সেগুলোর কথা আমরা ভাবি না। পুনঃজাগরণ এবং বিজয়ের পথ হিসেবে ঐ বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের কথা ভাবি না। ভাবলেও সেটাকে কেন্দ্রীয় লক্ষ্য মনে করি না। আমরা সভ্যতার যে মেট্রিকগুলো নিয়েছি, সেগুলো অনুযায়ীই উম্মাহর পুনঃজাগরণের কথা ভাবছি। আমার সীমিত বোধবুদ্ধিতে মনে হয়, যদি আমরা উম্মাহর পুনঃজাগরণ চাই, নবী (ﷺ) যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেই অর্থে শ্রেষ্ঠ হতে চাই, তাহলে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের মৌলিক মেট্রিকগুলোর ওপর জোর দেয়া দরকার। আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন, আমাদের ইমাম আহমাদকে দরকার নাকি ইবনে সিনাকে। ফারাবী আর আল-কিন্দিকে দরকার নাকি ক্বাক্বা আর খালিদ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)-কে।