মুসলিম বিশ্বের ওপর ইউরোপের নিয়ন্ত্রন


‘স্বাধীন’ হবার পর মুসলিম বিশ্বের ওপর ইউরোপের নিয়ন্ত্রন টিকে থাকলো কীভাবে?

ঔপনিবেশিক যুগের শেষে ইউরোপীয় দখলদাররা চলে গেলেও মুসলিম ভূখন্ডগুলোর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রন পাকাপোক্ত রইলো। আধুনিক ‘মুসলিম রাষ্ট্র’গুলো হল ঐ গাছের শাখাপ্রশাখা, যে গাছের কান্ড বেড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক শাসনামলে। জাতি-রাষ্ট্রগুলোর প্রতিষ্ঠান, পলিসি আর আদর্শ – সব কিছু গড়ে উঠলো ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তিক, আইনী এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর অনুকরণে। দখলদার পিতাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে কিছুটা ঘষেমেজে নতুন নামে উপস্থাপন করলো ক্ষমতাসীন এলিটরা। নতুন দিন, স্বাধীনতা আর মুক্তির মনভুলানো বুলির আড়ালে বাস্তবতা হল আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা মাত্র। ফিরিঙ্গিরা ফিরে গেল, রেখে গেল তাদের চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থা।

শোষনের মেশিনারি চালাতে হলে ভালো কেরানী আর আমলা দরকার। দখলদার ফিরিঙ্গিরা তাই নিজেদের স্বার্থেই কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো। এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঐসব মানুষ বের হয়ে আসলো, যারা এক সময় মুসলিম সমাজের গ্রহণ করলো রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব। সবচেয়ে অভিজাত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পাঠালো ইটন, হ্যারো, অক্সফোর্ড কিংবা কেইমব্রিজে। অপ্যারিস কিংবা অ্যামস্টারড্যামে। ইকবাল পড়াশুনা করেছিল কেইমব্রিজ, হাইডালবার্গ আর লিংকন্স ইন-এ। জিন্নাহও ছিল লিংকন্স ইনের ছাত্র। উত্তর আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক নেতা পড়াশুনা করেছিল প্যারিসের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি কিংবা আফ্রিকাতে চালু হওয়া ফ্রেঞ্চ স্কুলগুলোতে।

ঔপনিবেশিক কর্তা আর তাদের পোষা অ্যাকাডেমিকরা বরাবরই ইসলামের কড়া সমালোচনা করতো। ফলে সাদা বাবুদের আশীর্বাদপুষ্ট লোকাল এলিট আর আমলাদের মধ্যে তৈরি হল ইসলাম নিয়ে গভীর হীনমন্যতা। সবচেয়ে স্বাধীনতাকামী এলিটরাও এই হীনমন্যতা থেকে মুক্ত ছিলনা। ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত এমন এক সংকর প্রজাতি তৈরি হল যাদের চামড়া বাদামী আর মগজটা ফিরিঙ্গি আর দেশির মিশ্রন। যাবার সময় এই প্রজন্মকেই ফিরিঙ্গিরা বসিয়ে গেল রাষ্ট্র, সামরিক বাহিনী, সমাজ ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রনে। গেল। এই সংকর প্রজাতি এক সময় বুদ্ধিবৃত্তি বলতে বুঝতো রুশো, জন স্টুয়ার্ট মিল কিংবা কান্টের ছকে চিন্তা করা। কয়েক প্রজন্ম পর একই প্রজাতির লোকেরা ক্ষমতার বিরোধিতা করতে শিখলো লেনিন, ক্যাস্ট্রো, চে কিংবা মাও-এর অনুকরণে।

মানবইতিহাসের হিসেবে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা বেশ নতুন। এ ধারণার জন্ম ইউরোপে। মুসলিমদের মধ্যে আঞ্চলিক ও গোত্রীয় পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও, নির্দিষ্ট সীমানার ভিত্তিতে জাতি ও নাগরিকত্বের ধারণা ছিল নতুন এবং বিজাতীয়। নিজ পরিবার, গোত্র, অঞ্চল ইত্যাদির পর মুসলিম চিন্তা করতো উম্মাহর কথা। কিন্তু জাতিরাষ্ট্র নতুন এক আনুগত্যের ধারণা আনলো। জাতিরাষ্ট্র একদিকে বিভিন্ন গোত্র, অঞ্চল, সংস্কৃতির মানুষকে এক অভিন্ন ছকে জোর করে বসালো। অন্যদিকে মুসলিমদের বৈশ্বিক পরিচয়কে সীমাবদ্ধ করলো সংকীর্ণ সীমান্ত আর রাষ্ট্র নামের এক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে।

ঔপনিবেশিক যুগের বিভাজন এবং শাসনের নীতি সমান তালে চললো জাতি রাষ্ট্রেও। সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে দেখা দিল ফাটল এবং দ্বন্দ্ব। সুদান, ইরাক, মালায়শিয়া, পাকিস্তান, মরক্কো, সিরিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়ার, চাদ, আলজেরিয়াসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন মাত্রায় সংঘাত হল। চললো ভাঙ্গাগড়ার খেলা। কিন্তু সব ভাঙ্গার পর গড়ার প্রক্রিয়া চললো ইউরোপের বেঁধে দেয়া ছকের ভেতরেই। সীমান্ত, সংবিধান, জাতিরাষ্ট্র, মানুষের আইন…. ঔপনিবেশিক শাসনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল গ্রহণযোগ্য আলোচনার সীমা নিয়ন্ত্রন করা। আগে খেয়াল রাখা হতো কোন আলোচনা যেন ফিরিঙ্গি আধিপত্যের বয়ানকে প্রশ্ন না করে। যেন বিকল্প হিসেবে ইসলামের কথা বলা না হয়। স্বাধীনতার কথা বললে তা যেন বলা হয় জাতীয়তবাদ কিংবা অধিকারের জায়গা থেকে। ঐসব বুলি কিংবা আদর্শ ব্যবহার করে যেগুলো ফিরিঙ্গি অনুমোদিত। এভাবে চললো ফিরিঙ্গিদের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী ইসলামী এবং মুসলিম চেতনাকে ভেঙ্গেচুড়ে নতুন করে গড়ার প্রক্রিয়া।

জাতি রাষ্ট্রের যুগে এসে এই নিয়ন্ত্রন একটু ভিন্ন ভাবে সামনে আসলো। এখন ফিরিঙ্গিদের বিরুদ্ধে বলা যাবে কিন্তু বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থা আর আন্তর্জাতিক শক্তির কাঠামোকে প্রশ্ন করা যাবে না। বেশি থেকে বেশি হলে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলা যাবে। কিন্তু জাতি রাষ্ট্র, ‘স্বীকৃত সীমান্ত’, সাংবিধানিক শাসন আর গান্ধীবাদী পদ্ধতির ছকের বাইরে গিয়ে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার কথা আনা যাবে না। ইসলাম চাইতে হলে বিদ্যমান ব্যবস্থার বেঁধে দেয়া ছকের মধ্যেই চাইতে হবে। প্রথাবিরোধী হতে হলেও আগাতে হবে প্রথাগত পন্থাতেই।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *