গণতন্ত্র আর ইসলামের সম্পর্ক নিয়ে অনেকদিন নিয়েই অনলাইনে তর্কবিতর্ক চলছে। কিন্তু এই তর্কের কখনো ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে না। এমন হবার একটা বড় কারণ হল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ইসলামিস্টরা একদিকে তাদের অবস্থানকে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখেন, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আপত্তিগুলো তোলা হয় তা নিয়ে সরাসরি আলোচনা তারা সযত্নে এড়িয়ে চলে। দুটো ক্ষেত্রে এই প্রবণতার প্রভাব সব ভালোভাবে বোঝা যায়।
১। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ন
২। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোন ইসলামী দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় যাবার পর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে আলোচনার অনুপস্থিতি।
প্রথম অস্পষ্টতার দিকে তাকানো যাক। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসীরা একেক সময় একেকভাবে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে। যখন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপত্তির কথা আসে, তখন কেবল নির্বাচনের কথা এনে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া হয় – গণতন্ত্র হল নির্বাচনের মাধ্যমে, পপুলার ভোটের মাধ্যমে শাসক বাছাই করার পদ্ধতি। গণতন্ত্রের বিকল্প হল রাজতন্ত্র, বা একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি।
যখন ‘ইসলামী গণতন্ত্র’-এর কথা বলা হয় তখন প্রথমে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞা দেন – ‘গণতন্ত্রে বিশ্বাস করা হয় সার্বভৌমত্ব জনগণের’। তারপর ইসলামী গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেয়া হয়, ‘ইসলামী গণতান্ত্রিক দলগুলো তা মানে না। তারা বিশ্বাস করে সার্বভৌমত্ব এক আল্লাহর’।
আবার ফ্যাসিবাদ, সমাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরশাসনের আলোচনায় দেখা যায় গণতন্ত্রের আরেক সংজ্ঞা চলে এসেছে। ‘সকল নাগরিকের সমঅধিকার ও সুরক্ষা, মত প্রকাশ এবং চিন্তার স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নাগরিকের অভিপ্রায়ের প্রতিফলন’ – এর মতো অনেক বিষয়ের কথা তখন বলা হয়।
এই সংজ্ঞাগুলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্নভাবে; বলা যায়, সুবিধা অনুযায়ী, আনা হয়। এবং আলাদা আলাদাভাবে কোনটাই গণতন্ত্রের বাস্তবতা সম্পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলে না।
গণতন্ত্র মানে নির্বাচন বলে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় সেটা রিডাকশনিস্ট একটা সংজ্ঞা, এবং গণতন্ত্রের একটা ক্যারিক্যাচার। সুষ্ঠু অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু পৃথিবীতে কেউ গণতন্ত্র = নির্বাচন বলে না। তারচেয়ে বড় কথা এটা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপত্তিগুলোকে পাশ কাঁটিয়ে যাওয়ার একটা চেষ্টা। যারা গণতন্ত্রের বিরোধিতা করে, তাঁদের আপত্তি কি মৌলিকভাবে পপুলার ভোট নিয়ে?
ধরুন, কোন ভূখন্ডে ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী শাসিত হয়। এখানে যদি, শরীয়াহর সব শর্ত পূরণ করে, বাছাই করা কিছু ব্যক্তির মধ্য থেকে ভোটের মাধ্যমে নতুন শাসক নির্ধারন করা হয় তাহলে, কি গণতন্ত্রেরবিরোধিতাকারীরা সেটাকে কুফর বলবে? যেভাবে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বলে থাকে? অবশ্যই না। কারণ মূল আপত্তি নির্বাচন নিয়ে না। এটুকু গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলা মানুষরাও বোঝেন। বুঝেও তারা গণতন্ত্রের একটা সীমিত সংজ্ঞা আর ক্যারিক্যাচার দাড় করিয়ে, সেটার ওপর ভর দিয়ে তর্ক করেন।
সার্বভৌমত্বের ওপর ভিত্তি করে দেয়া সংজ্ঞার আলাপ বেশ মজার। কাউকে সার্বভৌম মনে করার বিষয়টা কি শুধু বিশ্বাস করার আর মুখে বলার? নাকি কাজের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য আছে? কেউ বিশ্বাস করে আল্লাহ একমাত্র সত্য ইলাহ, তিনিই রব, তিনি মালিক। কিন্তু নিজের পীর সাহেবের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সে মাগরিবের সালাত ৩ রাকাতের জায়গায় ৪ রাকাত করে পড়ে। সে কি আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য করছে? নাকি আল্লাহর হুকুমের বিপরীতে অন্য কারও আনুগত্য করছে? .অনেক দেশের শাসকরা বেশ আয়োজন করে ক্যামেরার সামনে সালাত আদায় করে। কেউ শুনি তাহাজ্জুদ পড়ে, কেউ কুরআনে হাফিয বলেও শুনি। থিওরেটিকালি তারাও এ কোথায় বিশ্বাস করার কথা যে, ‘আল্লাহ সার্বভৌম’।
কিন্তু এই বিশ্বাসের এ দাবি কি যথেষ্ট? কেউ আল্লাহকে সার্বভৌম মনে করার দাবি করার পর যদি বলে উত্তরাধিকার আইন ইসলামে যা আছে, সেটায় নারীদের সাথে যুলুম হয়েছে, এবং এটা বদলানো দরকার, তাহলে তার এই দাবির গ্রহণযোগ্যতা কতোটুকু?
গণতান্ত্রিক শাসনে কি পদে পদে এমন কাজ হচ্ছে না? প্রতিটি ক্ষেত্রে কি ইসলামের বিধানকে সরিয়ে, অকার্যকর করে, অন্য কোন দর্শন, কিতাব বা সত্ত্বার কথামতো নতুন বিধান বানানো হচ্ছে না? শুধু ‘আমি আল্লাহকে সার্বভৌম বলে বিশ্বাস করি’ বললে কি এ সব কিছু দূর হয়ে যাচ্ছে?
অন্যদিকে যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলেন, তারা এসব মূল্যবোধের অনুমিত মহত্ব নিয়ে লম্বা আলোচনা আনলেও এগুলোর সাথে ইসলামের কোন সাংঘর্ষিকতা আছে কি না, সেই আলাপ সযত্নে এড়িয়ে যান। অথচ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপত্তির বড় একটা জায়গা এটা। গণতান্ত্রিক শাসন কোন ধরণের আইন নিয়ে কাজ করে, কোন ধরণের সমাজ তৈরি করে, কোন ধরণের সংস্কৃতি তৈরি করে, কোন ধরণের মানুষ/নাগরিক তৈরি করে – এর সাথে ইসলামের অবস্থানের সংঘর্ষ আছে কি না, থাকলে কোন মাত্রায় আছে, সেই সংঘর্ষের সমাধান করা সম্ভব কি না – এই আলোচনা না করে, ইসলামের আর গণতন্ত্রের ‘সমন্বয়’/জোড়াতালির চেষ্টা করা সম্ভব না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটাই ঘটে।
এভাবে একেক সময় একেক সংজ্ঞা আনা হয়, অস্পষ্ট, ঘোলাটে, কিংবা ঢালাও কিছু কথাবার্তা এনে মূল আপত্তির জায়গাগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিষয় এতোবার, এতো বিভিন্নভাবে ঘটে যে, একে কাকতালীয় মনে করা বেশ কঠিন। বরং এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক যে গণতন্ত্রের প্রবক্তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই মূল আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছেন।