মাযলুমের কষ্ট আসলে কখনো উপলব্ধি করা যায় না পুরো মাত্রায়। যে যুলুমের শিকার না, সে মাযলুমের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে তার কষ্ট অনুভব করতে পারেনা। যতোক্ষন পর্যন্ত সে নিজে যুলুমের স্বীকার না হচ্ছে ততোক্ষন সে এই কষ্টের ধরন বুঝতে পারবে না। যার প্রিয় জন কখনো বন্দী হয়নি সে কখনো বুঝবে না এ অভিজ্ঞতাটা কেমন। যে কখনো নির্যাতিত হয়নি সে বুঝবে না যে আসলে এই অপমান এবং কষ্ট কেমন। যে কখনো সন্তান হারায়নি সে বুঝবে না সন্তান হারানোর কষ্ট।
তাই উইঘুর বাবা মাদের কষ্ট আমাদের কাছে বিমূর্ত একটা বিষয়। তাদের কষ্টের ব্যাপারে আমাদের অনুভুতি কেবল একটা ধারণা। একটা অনুমান। একটা আনুমানিক হিসেব। আমরা ধরে নেই, হয়তো উইঘুরদের ‘এতোটুকুন’ কষ্ট পেয়েছে, হয়তো তাদের ‘অমন’ একটা অনুভূতি হয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ আমরা তাদের মতো যুলুমের স্বীকার হচ্ছি না, ততোক্ষন পর্যন্ত, তাদের কষ্ট আমাদের কাছে স্বরূপে, পরিপূর্ণ মাত্রায় ধরা দেবেনা।
আমরা যারা দূর থেকে দেখি তাদের জন্য এগুলো হল সুইচ দেয়া এম্প্যাথি বা সহমর্মিতা। আমি দুই মিনিট মযলুমকে নিয়ে চিন্তা করে অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু কষ্ট অনুভব করি। তারপর ‘সহমর্মিতাবোধের’ সুইচ বন্ধ করে পাঁচ মিনিট কোন মজার ভিডিও দেখে হাসাহাসি করি। তারপর পাঁচ ঘন্টা নিজের জীবিকা, পরিবার ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমার কষ্টবোধ, আমার সহমর্মিতা ইচ্ছে করলেই সুইচ টিপে বন্ধ করা যায়।
কিন্তু যে যুলুমের শিকার হচ্ছে, তার জন্য বিষয়টা ঐচ্ছিক না। তার পক্ষে এ যুলুম থামানো সম্ভব না। জেগে থাকা প্রতিটি মূহুর্ত তার এই কষ্টের মধ্যেই কাটাতে হয়। আমি যেভাবে চিন্তা করতে পারি সেভাবে চিন্তা করার বিলাসিতা তার নেই। মাযলুম আর আমি দুটো ভিন্ন জগতে থাকি। দুটোর রঙ আলাদা, কাঠামো আলাদা। আমাদের মাইন্ডসেট এবং হেডস্পেইস আলাদা। তাই যুলুম থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমরা ‘মানবতা’ আর সুশীলতা দেখাতে পারি। আমার পারাটাই স্বাভাবিক কারণ আমি তো থার্ড পার্টি। যুলুম কমা বাড়ায় আসলে, রিয়েল টার্মসে, আমার কিছু যায় আসে না।
কিন্তু যখন আমাদের সাথে ছোট ছোট যুলুম হয় তখন আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়ি। একটা মোটামুটি মানের নৃশংস রেইপ আমাদের আশেপাশে ঘটলে আমরা কঠিন শাস্তির জন্য কঠিন কঠিন কথা বলি। কারণ এগুলো আমাদের সাথে ঘটে, আমাদের আশেপাশে ঘটে। তাই এই যুলুম, এই কষ্ট আমাদের আপন মনে হয়। আর সেই মনে হওয়া অনুযায়ী আমাদের প্রতিক্রিয়া হয়।
কিন্তু যখন ৩০ লক্ষ মানুষকে কনসেন্ট্রেইশান ক্যাম্পে বন্দী রাখা হয়। ৩৫ বছরের নিচের প্রায় সব নারীপুরুষকে গণহারে ধর্ষন করা হয়। যখন নারীদের বাধ্যতামূলক গর্ভপাত (অনেক সময় কোন অ্যানেসথেশিয়া ছাড়া) করানো হয়। যখন নারী ও পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া হয়। যখন তাদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা হয়। যখন সন্তানদের পিতা-মাতার কাছ থেকে আলাদা করা হয়। যখন বাধ্য করা ইসলামের সমালোচনা করতে, গালি দিতে। যখন নিয়ম করে নির্যাতন করা হয়। যখন জোর করে মদ আর শূকরের মাংশ খাওয়ানো হয়। রোযা রাখতে বাধাঁ দেয়া হয়। যখন মুসলিম নারীদের বিছানায় ৩২ দাত বের করে হাসতে থাকা হান চাইনিযদের উঠিয়ে দেয়া হয়। তখন আমরা সেটার মাত্রা বোঝার ধারেকাছে আমরা পৌছাতে পারি না। পৌছাতে তো পারি-ই না পৌছানোর চেষ্টাও করি না। কারণ এই যুলুম আমাকে প্রভাবিত করে না। এর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। এটা আমার জন্য অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছু একটা।
আর এই কষ্টের ছিটেফোঁটাও আমি অনুভব করি না দেখেই, আমি ঐসব মানুষের জন্য সাফাই গাইতে পারি, আবেগে গদগদ হতে পারি, যাদের চোখের সামনে, যাদের সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় সমর্থনে বছরের পর বছর এই নির্যাতন চলে। যারা উত্তেজিত হয়ে উইঘুর নারীদের বিছানায় ওঠার জন্য মুখিয়ে থাকে।
অথবা আমি ঐসব মানুষদের সম্মান করে যেতে পারি, যারা এই জেনোসাইডের বৈধতা দেয়া তথাকথিত ‘মুসলিম’ শাসকদের বৈধতা দেয়। ‘চীনের অভ্যন্তরীন বিষয়’ কিংবা ‘আমি জানি না’ বলে দায় সারে। দ্বীনের কথা, আল্লাহর কথা আনলে বাঙ্গালকে অর্থনীতি আর রাজনীতি বোঝায়। আমাদের এই সুশীলতা ততোক্ষণ টিকে থাকবে যতোক্ষণ এই যুলুম আমাদের জন্য দূরবর্তী ‘কিছু একটা’ হবে।
আরো অনেক কথা বলা যায়। বলা দরকার। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। মুখে তিক্ত একটা স্বাদ অনুভব করছি।
আল্লাহর কুরআনের বক্তব্য দিয়ে শেষ করি।
আর যদি তারা দ্বীনে ব্যাপারে তোমাদের নিকট কোন সহযোগিতা চায়, তাহলে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। [তরজমা, আল-আনফাল, ৭২]
তোমাদের এসব উম্মাত তো একই উম্মাত (যারা একই দ্বীনের অনুসরণ করে), আর আমিই তোমাদের প্রতিপালক, কাজেই আমাকেই ভয় কর। [তরজমা, সূরা আল-মু’মিনুন, ২৩]