“সমকামী” আন্দোলনের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর অন্যতম হল তারা বিতর্কের ফ্রেইম ঠিক করে দিতে পেরেছে। এই আন্দোলন এবং তাদের লিবারেল সমর্থকরা পুরো বিষয়টাকে উপস্থাপন করে পরিচয় এবং অধিকারের প্রশ্ন হিসেবে।প্রথমে অল্প কিছু মানুষের ঐচ্ছিক আচরণের ভিত্তিতে তারা একটা কৃত্রিম পরিচয় (i.e “সমকামী”) আবিষ্কার করে। (লক্ষ্য করুন আমরা এখানে **আচরণের** কথা বলছি। **আকর্ষনের** কথা বলছি না।)
তারপর এই স্ব-উদ্ভাবিত পরিচয়ের ভিত্তিতে তারা নিজেদের “সংখ্যালঘু এবং সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়” (মাইনরিটি) হিসেবে উপস্থাপন।তারপর বলে তারা সমান অধিকার চায়। এভাবে সম লিঙ্গের সাথে যৌনাচারের কাজটা এবং এর নৈতিকতা থেকে ফোকাস সরিয়ে নিয়ে এটাকে অধিকারের প্রশ্ন হিসেবে ফ্রেইম করা হয়।
অথচ প্রশ্নটা অধিকারের না। “সমকামী” আন্দোলনেরও ভাষ্য হল তারা স্বাভাবিক (ওদের ভাষায় “হেটেরোসেক্সুয়াল” বা “বিসমকামীদের”) মানুষদের মতো সমান অধিকার চায়। স্বাভাবিক মানুষ যা কিছু করতে পারে সেটা তাদেরকেও করতে দিতে হবে।
অথচ তাদের ঐচ্ছিক যৌন আচরণের বিষয়টা বাদ দিলে অন্য সব দিকে তাদের বাকি সবার মতো একই অধিকার আছে। পার্থক্য হচ্ছে সম লিঙ্গের সাথে যৌন সম্পর্ক সংক্রান্ত কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ের ব্যাপারে। এই আচরণগুলোকে বৈধতা দেয়ার ব্যাপারে। বিয়ে, সন্তান দত্তক নেয়া, পরিবার হিসেবে গণ্য হওয়া, স্বামী বা স্ত্রীর উত্তরাধিকার পাওয়ার অধিকার, স্বাভাবিক যৌনতার সংজ্ঞায় “সমকামিতাকে” নিয়ে আসা, সম লিঙ্গের সাথে যৌনাচারকে অনৈতিক এবং অস্বাভাবিক হিসেবে দেখার মতো বিষয়গুলোতে।
*“সমকামীরা বিসমকামীদের মতো একই অধিকার চায়”*, সহজ ভাষায় এর অর্থ হল – তারা তাদের যৌনাচার, তাদের যৌন কর্মের স্বাভাবিকীকরণ চায়। বৈধতা চায়, গ্রহণযোগ্যতা, নৈতিক সমর্থন চায়। কাজেই প্রশ্ন অধিকারের না, বরং প্রশ্ন ঐ কাজের নৈতিকতা নিয়ে।
আপনি অমুক কাজকে বৈধ করতে চান। সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্য করতে চান। তাহলে এখন প্রশ্ন হবে ঐ কাজটার মরালিটি নিয়ে। ঐ কাজটা কী ভালো না মন্দ? যদি মূল কাজ থেকে ফোকাস সরিয়ে অধিকারের ইস্যু বানানো হয় তাহলে অনেক হারামকে, অনেক অনৈতিকতার এমন স্বাভাবিকীকরণ সম্ভব।
নিচের আরগুমেন্টটার কথা ধরুন –
অনেক মানুষ মাদক ব্যবহার করে। অনেক মানুষ এতে আনন্দবোধ করে। অনেক মানুষ মাদক ব্যবহার না করলে ডিপ্রেশনে ভোগে। তারা এমনও দাবি করতে পারে যে জন্মগতভাবে কিংবা পরিবেশগত কিছু ফ্যাক্টরের কারণে মাদক ব্যবহারের প্রতি তাদের একটা সহজাত ঝোঁক আছে। তারা অ্যাডিকটিভ পারসোনালিটিতে ভোগেন।
এখন তারা মাদক ব্যবহার অধিকার আন্দোলন শুরু করলেন।
তারা বলতে শুরু করলেন, অনেক মানুষ ভোজনরসিক হয়। আমরা মাদকরসিক। অনেক মানুষের জন্মগতভাবে অবিস বা ওভারওয়েইট হবার প্রবণতা থাকে। আমাদের জন্মগতভাবে মাদক ব্যবহারের প্রবণতা আছে।
কেউ চাইলে ভেজিটেরিয়ান হতে পারে। কেউ চাইলে নন-ভেজেটেরিয়ান হতে পারে। মুসলিমরা হালাল মাংশ খেতে পারে। ইহুদীরা কোশার খাবার চাইতে পারে। আমরা মাদকভোগী। আমরাও অমাদকভোগীদের মতো মতো সমান অধিকার চাই।
আমরা চাই বার্গারখোরদের মতো ইয়াবাখোরদের একই অধিকার থাকুক। বিরানীখোরদের মতো ডাইলখোরদেরও একই অধিকার থাকুক। আমরা এখানে কোন বৈষম্য চাই না। আমরা সবাই মানুষ। আমরা সবাই সমান।
মাদকভোগী হবার কারণে আমাদের অনেক লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হয়। সমাজে আমাদের গাঞ্জুটি, হেরোইনচি, বাবাখোর, ডাইলখোর ইত্যাদি নেতিবাচক নামে ডাকা হয়। আমরা সমাজে প্রকাশ্যে বলতে পারি না যে আমরা মাদকভোগী। যদি নিজের পরিচয় প্রকাশ করি তাহলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না। অফিসে জানলে ছাটাই করে দেয়। সবসময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয়। সবসময় একটা মুখোশ পরে থাকতে হয়। মাদক কেনার সময় কিংবা খাওয়ার সময় ধরা পড়লে পুলিশ আমাদের জেলে নিয়ে যায়। ঘুষ নেয়। সাধারণ মানুষের হাতে ধরা পড়লে তারা গণপিটুনি দেয়।
পরিবার থেকে আমাদের অনেক খারাপ কথা বলা হয়। বাবামা বলে, তোর জন্য আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। সবসময় একটা লজ্জা, মানসিক কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়।
আমরা এই যন্ত্রনা, এই অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। আমরা আমাদের ইচ্ছেমতো মাদক ব্যবহারের অধিকার চাই। আপনার ভালো না লাগলে আপনি মাদক ব্যবহার করবেন না। কিন্তু আমাদের ব্যবহার করতে দিন। আমাদের নিজ ঘরের প্রাইভেসিতে অন্তত আমাদের আমাদের মতো করে থাকতে দিন?
আপনি কি এটাকে যৌক্তিক মনে করবেন? এটা কি একটা ভ্যালিড আরগুমেন্ট? নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, এখানে মাদক ব্যবহারের বিষয়টাকে অধিকারের প্রশ্ন বানানো হচ্ছে। কিন্তু আপত্তিটা অধিকারের জায়গাতে না। আপত্তিটা মাদক ব্যবহার নিয়ে। অর্থাৎ কাজটা নিয়ে। তাহলে এটা সিভিল রাইটস বা নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন নাকি ভালো-মন্দের ইস্যু?
সম লিঙ্গের সাথে যৌনাচারকে অধিকারের প্রশ্ন বানানোর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। এটা প্রাইমারিলি অধিকারের ইস্যু না। কিন্তু এই বিষয়টা বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাইয়ের মাধ্যমে চাপা দেয়া হয়েছে। বিশাল সংখ্যক মানুষ বিষয়টাকে সিভিল রাইটস ইস্যু মনে করছে। যদিও বিষয়টা রাইটস ইস্যু না। আলোচনাটাকে যে তারা নিজেদের পছন্দ করা একটা ছকে নিয়ে যেতে পেরেছে, এটা হল তাদের সফলতা। এটা খুব ডেলিবারেটলি, প্ল্যানড ওয়েতে করা হয়েছে। এই আন্দোলনের বিভিন্ন অ্যাক্টিভিস্ট এবং স্ট্র্যাটিজিস্টের লেখাতেও এ বিষয়টি উঠে এসেছে। এবং বাংলাদেশে যে প্রপাগ্যান্ডা চালানো হচ্ছে তা এই ফ্রেইমওয়ার্কের আলোকেই হচ্ছে। তাই এই ভুল এবং মিসলিডিং ফ্রেইমওয়ার্ক নিয়ে আগে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।