একটা মজার স্বভাব আছে বিড়ালের। যেকোন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে আরামের জায়গা খুঁজে নিয়ে সেটাকে নিজের বানিয়ে ফেলা। একবার আস্তানা গাড়ার পর কোনভাবে তাকে সরানো যায় না। দুনিয়াদারি সম্পর্কে নির্বিকার হয়ে আয়েশি ভঙ্গিমায় শুয়ে বসে নির্লিপ্ত দার্শনিকের চোখে সে চারপাশ পর্যবেক্ষন করতে থাকে। ইউটিউবে এমন অনেক মজার মজার ভিডিও পাবেন। সিরিয়াতে মাউন্টেড মেশিনগানের ওপর গুটিসুটি মেরে বসে থাকা বিড়ালের ছবিও দেখেছিলাম ছয় বছর আগের শীতে। ইচ্ছেমতো সুইচ চেপে চারপাশের পৃথিবীটাকে শব্দহীন করে দিয়ে নিজের ভেতরে ডুব দেয়ার কাজটা সহজ না। এটাকে নিছক ‘স্বভাব’ বলা যায় কি না নিশ্চিত না। অনেক সময় একে ক্ষমতা বলে মনে হয়।
বিড়ালের এ স্বভাব মানুষের মধ্যেও দেখা যায়, একটু অন্যভাবে। যেকোন পরিস্থিতিতে একটু লম্বা সময় কাটাতে হলে মানুষ নিজের জন্য একটা কমফোর্ট যোন বানিয়ে নেয়। একবার কমফোর্ট যোন খুজে পেলে নিজেকে মুড়ে নেয় অদ্ভুত স্থিতিজড়তায়। কমফোর্ট যোন থেকে না সরার, যেকোনভাবে নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। অবস্থা, প্রেক্ষাপট যতোই খারাপ হোক না কেন, দায়িত্ব বা করণীয় যাই হোক না কেন, মানুষ তার কমফোর্ট যোন থেকে নড়তে চায় না। এ কমফোর্ট যোন যতোই তুচ্ছ বা ঠুনকো হোক না কেন।
কয়েদীর কথা চিন্তা করুন। একজন কয়েদী পার্থিব সম্পদ থেকে মুক্ত একজন মানুষ। তার তেমন কিছু হারানোর নেই। প্রতিদিনের ব্যস্ত রুটিন, জীবিকার পেছনে ছোটা, সামাজিকতা, ফ্যাশনেবল পোশাক, নন্দনতত্ত্ব কিংবা দর্শন — কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে হয় না তাকে। সব মিলিয়ে তার পার্থিব সম্পদ হল, বিছানা বালিশ, থালা বাসন, কিছু শুকনো খাবার, কিছু পোশাক, হয়তো বা অল্প কিছু বই, সাবান, ব্রাশ, টুথপেইস্ট ইত্যাদি। ইচ্ছে হলেও ভোগ আর ভোগের মাল জোগানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সে অংশগ্রহন করতে পারে না। সাময়িকভাবে হলেও বস্তুবাদী বুদবুদ থেকে বন্দীত্ব এক অর্থে তাকে মুক্ত করে। এমন পরিস্থিতিতে বস্তুর ভালোবাসা থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক সহজ হবার কথা। অ্যাটলিস্ট থিওরি তাই বলে। কিন্তু আসলে হয় উল্টোটা।
দেখা যায় এসব তুচ্ছ জিনিস নিয়েও কয়েদীরা ঝগড়া-মারামারি করে। একটা স্যাঁতস্যাঁতে বিল্ডিংয়ের, স্যাঁতস্যাঁতে সেলের কোন কোণায়, কোন দেয়ালের পাশে তার “সিট” পড়ছে এ নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন দুশ্চিন্তা করে। আজ কী খাবার দেয়া হবে, এ সপ্তাহে ইমপ্রুভড ডায়েট দেয়া হবে কি না — সময় কাটে এসব নিয়ে গবেষণায়। কখনো যদি সেল বদলে দেয়া হয় তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
বস্তুর সংস্পর্শ থেকে প্রায় মুক্ত অবস্থায়ও মানুষ বস্তুর মায়া কাঁটাতে পারে না। সবচেয়ে আনকমফোর্টেবল অবস্থাতেও মানুষ নিজের মতো করে একটা কমফোর্ট যোন বানিয়ে নেয়। একেক জনের কমফোর্ট যোন একেক রকম হয়। কিন্তু সবাই নিজ নিজ কমফোর্ট যোনকে প্রায় একই ধরণের তীব্রতার সাথে আকড়ে ধরে রাখে।
কমফোর্ট যোন গুলো অনেকটা ইকুইলিব্রিয়াম পয়েন্টের মতো। স্থিতাবস্থায় পৌছানোর পর মানুষ সহজে সেখান থেকে নড়তে চায় না। স্বেচ্ছায় শুধু তখনই নড়ে যখন বর্তমানের চেয়ে আরো উন্নত কোন কমফোর্ট যোনে যাবার সুযোগ আসে। বিড়ালের মতোই মানুষকে তার কমফোর্ট যোন থেকে সড়ানো মেলা হ্যাপা। রেগে যায়, ফুঁসে ওঠে, গজগজ করে, অনেক সময় আক্রমনও করে বসে। যে সত্যগুলো স্বীকার করলে নিজের কমফোর্ট যোনকে ছাড়তে হবে, মানুষ সেগুলো স্বীকার করতে চায় না। নানা যুক্তি, ছুতো, বাহানা খুজে সে সত্যকে অস্বীকার করার জন্য। না পারলে, নিদেনপক্ষে আড়াল করার জন্য।
কল্পনা করুন একটা জলপ্রপাত। নৌকা ভর্তি কিছু মানুষ। নিশ্চিত পতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। একজন উঠে দাঁড়িয়ে নৌকার গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করলো। দুলতে শুরু করলো নৌকা। নিশ্চিত পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নৌকার মধ্যেও কমফোর্ট যোন খুঁজে পাওয়া যাত্রীরা তখন উঠে পড়ে লেগে যাবে ঊঠে দাঁড়ানো লোকটার বিরুদ্ধে।
“নৌকা দুলাচ্ছো কেন? নৌকা উল্টে যাবো তো! স্থির হয়ে বসতে পারো না!”
দুলতে থাকা নৌকার চেয়ে নিশ্চিত পতনের দিকে এগিয়ে যাওয়া কমফোর্ট যোনে স্থির হয়ে বসে থাকায় অধিকাংশের কাছে পছন্দনীয়।
সত্যকে স্বীকার করতে গেলে কমফোর্ট যোন থেকে বের হয়ে আসতে হয়। নৌকা দোলাতে হয়। নিজের কিছু পছন্দের জিনিস ছাড়তে হয়। সাজানো-গোছানো, অন্য সবার মতো করে বানানো খেলাঘরের মায়া ছাড়তে হয়। কিন্তু বিনিময়ও পাওয়া যায়। সাহাবীদের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন, জীবনির দিকে তাকালে ছবিটা আরো পরিষ্কার বুঝতে পারবেন।
সাহাবীদের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন জন্য নিজেদের কমফোর্ট যোন ত্যাগ করার ব্যাপারটা শুরু হয়, ইসলাম গ্রহণ করার মূহুর্ত থেকেই। শুরুর দিকে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই ছিলেন মক্কার সম্ভ্রান্ত, অভিজাত পরিবারগুলোর সন্তান। সমাজে তাঁদের অবস্থান ছিল, মর্যাদা ছিল। তাঁরা কথা বললে মানুষ স্থির হয়ে শুনতো। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করার কারণে মানুষগুলোর পৃথিবী রাতারাতি পাল্টে গেল।
সমাজের নেতৃস্থানীয় মানুষের বদলে ঠাট্টা-তামাশার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেন। সম্মানিত মানুষগুলো হঠাৎ করে মুখোমুখি হলেন তীব্র বিদ্রূপ আর অপমানের। কাল পর্যন্ত যাদের কন্ঠে শ্রদ্ধা আর সমীহের মিশেল থাকতো, তাদের কন্ঠ থেকে ঝড়ে পড়তে শুরু করলো ঘৃণা আর তাচ্ছিল্য। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের জন্য এ ব্যাপারটা অনেক সময় শারীরিক নির্যাতন কিংবা আর্থিক ক্ষতির চেয়ে গুরুতর। কতো উচিৎ কাজ কেবল সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে আমরা এড়িয়ে যাই, কতো অন্যায় মুখ বুঝে সয়ে যাই, লিস্ট করতে গেলে বোধহয় শেষ হবে না। আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগেকার মক্কায় থাকলে, শুধু এ সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে আমাদের মধ্যে ক জন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”র ঘোষণা দিতে অস্বীকার করতো, সে লিস্টও হয়তো শেষ হবার না।
আমরা যেখানে প্রায় নিশ্চিতভাবেই ফেল করে যেতাম, সাহাবীগণ সেখানে পাশ করলেন। সামাজিক অবস্থান, সম্মান এগুলোর লোভ তারা সত্যকে অস্বীকার করলেন না। প্রথম প্রতিবন্ধক পার করলেন। কিন্তু এখানেই পরীক্ষার শেষ না। সবেমাত্র শুরু।
শুরুটা হয় হাসিতামাশা আর তাচ্ছিল্য দিয়ে। তিক্ত থেকে তিক্ততর হতে হতে একসময় ঠাট্টা পরিণত হয় গুজব, গালাগালিতে। সমাজে কোনঠাসা হতে থাকা মানুষগুলোর অনেকেই পরিবারের কাছ থেকেও সমর্থন পেলেন না। অনেক সময় নিজ পরিবারের প্রতিক্রিয়া হল আরো তীব্র। এ মানসিক নির্যাতন সহ্য করা, সমাজের সবার বিরুদ্ধে গিয়ে টিকে থাকাটা অত্যন্ত কঠিন। শুধু “মানুষ কী বলবে”, “কেমন লাগবে”, “অস্বস্তি লাগে” — এসব কারণে আমাদের অনেকে দাড়ি রাখতে পারি না, গোড়ালির ওপর কাপড় রাখতে পারি না, বোরকা-নিক্বাব পড়তে পারি না। অজনপ্রিয় কিংবা বিপদজনক সত্যের পক্ষ নিতে পারি না।
সাহাবীগণ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন সমাজ ও পরিবারের এ মানসিক নির্যাতন সহ্য করে টিকে থাকলেন। মানসিক নির্যাতন এক সময় শারীরিক নির্যাতনে পরিণত হল। অতর্কীতে হামলা, দলবেধে হামলা রুটিন হয়ে গেল। এমনকি ক্বা’বার সামনেও তাঁদের আক্রমন করা হল। অনেকেই সিস্টেম্যাটিক টর্চারের মধ্যে দিয়ে গেলেন। শুধু একটা বিশ্বাসের জন্য সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ থেকে তারা পরিণত হলেন সবচেয়ে নিগৃহীত মানুষে। একসময় তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করা হল। এবার আসলো দারিদ্র্য, অপমান আর অসহায়ত্বের পরীক্ষা। সম্মান, অবস্থান, সম্পদ, স্বাধীনতা — সাহাবীরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন সব হারালেন।
চোখ বন্ধ করে একটু কল্পনা করার চেষ্টা করুন, কমফোর্ট যোনের মায়ায় ব্যাংকের চাকরি আর বিসিএস-এর নিরাপদ ভালোবাসা থেকে বের হতে না পারা, আমাদের সমাজের মানুষগুলোর এ পরিস্থিতিতে কী অবস্থা হতো। আমরা আপোষ করি, কারণে-অকারণে হেরে যাই। সাহাবীরা টিকে থাকলেন। রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন।
তারপর তাঁরা নিজ বাড়ি ছাড়লেন। নিজ ভূখন্ড মক্কা ছেড়ে, নিজের চেনাজানা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। সাহাবীরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন আবিসিনিয়া এবং মদীনাতে উপস্থিত হলেন রিফিউজি হিসেবে। পার্থিব বিচারে সহায়, সম্পদ, সম্মানহীন আশ্রিত হিসেবে শুরু হল তাঁদের নতুন জীবন। পুরোপুরিভাবে তাঁরা কমফোর্ট যোন থেকে বের হয়ে আসলেন। কিন্তু তবু কি শেষ হল?
এবার আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ তাঁদেরকে নির্দেশ দিলেন যুদ্ধ করার। যারা আক্রমন করছে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ইসলামের নিরাপত্তা ও প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ। ততোক্ষন পর্যন্ত যুদ্ধ যতোক্ষন দুনিয়া থেকে শিরক সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন না হয়। নিরন্তর যুদ্ধ। সাহাবীরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন যুদ্ধ করলেন তাদের পিতা, সন্তান আর আত্মীয়দের বিরুদ্ধে। আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল আনুগত্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিলেন। দেখলেন আসলেই ইসলামের জন্য তাঁরা কতোটা ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। সাহাবীরা সব ছাড়লেন। সামাজিক অবস্থান, সম্পদ, ভিটেবাড়ির পর ইসলামের জন্য — নিজ রক্তের মায়াও ছাড়লেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য, নিজেদের বুকের রক্ত ঢেলে দিলেন।
চিন্তা করে দেখুন, ধাপে ধাপে কতোবার আল্লাহ তাঁদের পরীক্ষা করলেন। বারবার তাঁদেরকে কমফোর্ট যোন থেকে বের করে আনলেন। সাহাবীরা সব কিছু ত্যাগ করলেন। তারপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাদের বিজয় দিলেন। রিক্ত, নিঃস্ব আশ্রিত এ মানুষগুলোই অল্প কিছু বছর পর পরিণত হলেন বিস্তীর্ন ভূখন্ডের গভর্নর, বিচারক, শাসকে। আল্লাহ তাদের সম্মানিত করলেন, প্রতিষ্ঠিত করলেন — দুনিয়া ও আখিরাতে। ইয়াওমুল ক্বিয়ামাহ পর্যন্ত তাঁদের মানবজাতির অনুসরনীয় প্রজন্মে পরিণত করলেন। রাদ্বীয়াল্লাহু আনহুম ওয়া রদ্বুআনহ।
ক্বুর’আন ও ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন এটা একটা কমন প্যাটার্ন। বিজয় দেয়ার আগে আল্লাহর তাঁর বান্দাকে কমফোর্ট যোন থেকে বের করে আনেন। আল্লাহ যাচাই করে দেখেন বান্দা আসলে তাঁর জন্য কতোটুকু ত্যাগ স্বীকারে রাজি।
ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর কথা চিন্তা করুন। দাস, অনাথ, আশ্রিত। তারপর বন্দী।
ইব্রাহিমের অবস্থা চিন্তা করুন। সমাজচ্যুত, নির্যাতিত, গৃহত্যাগী।
নূহকে আলাইহিস সালাম সহ্য করতে হয়েছে তাচ্ছিল্য আর অপমান। একই কথা লূত আর হুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এভাবে শাশ্বত সত্যের প্রতি আহ্বান করার কারণে বারবার আল্লাহর নবীদের ঘরছাড়া, সমাজচ্যুত করা হয়েছে। তাঁরা সহ্য করেছেন চরম তাচ্ছিল্ল্য, অপমান আর মানসিক নির্যাতন। তাঁদের হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। অনেককে বন্দী করা হয়েছে, অনেকে বন্দীত্বের আশংকায় আত্মগোপন করেছেন। বারবার তাঁরা স্থিতাবস্থা থেকে সরে এসেছেন। ‘যেমন চলছে চলুক না’-র স্থিতিজড়তা তাঁদের অস্তিত্বকে গ্রাস করতে পারেনি।
ইমান বাঁচাতে কলুষিত সমাজ ছেড়ে গুহায় আশ্রয় নেয়া আসহাবে কাহফ, স্বেচ্ছায় আগুনের পরিখায় ঝাপিয়ে পড়া সত্যের ওপর অবিচল আসহাবুল উখদুদ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর সাহাবীগণ— ক্বুর’আন বারবার যাদেরকে আমাদের সামনে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করছে, সবার মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন। আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে তাঁদের জীবন সাময়িকভাবে তছনছ, ওলোটপালোট হয়ে গেছে। একবার পরীক্ষার পর যখন কিছুটা ছন্দ ফিরে এসেছে, তখন আবার এসেছে নতুন কোন নির্দেশ। নতুন কোন ঝড়। নীরব, নিস্তরঙ্গ, ছকে বাধা জীবনের বদলে তাঁরা বেছে নিয়েছেন চরম অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তার জীবন। বারবার নিজের কমফোর্ট যোন থেকে বের হয়ে এসেছেন।
অন্যদিকে যুগে যুগে যাদের আল্লাহ ধ্বংস করেছেন তাদের সবার বৈশিষ্ট্য ছিল নানা পার্থিব অজুহাতে চিরন্তন সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা।
ব্যাপারটা অদ্ভূত।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ নবী-রাসূলদের বিরোধিতা করেছে পার্থিব নানা মোহের কারণে, কোন আদর্শিক দ্বন্ধের কারণে না। একটু উষ্ণতা, নরম বিছানা, স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপত্তা। বিড়াল তার কমফোর্ট যোন খুজে নেয়ার সময় এ বিষয়গুলোই দেখে।
বেশিরভাগ মানুষ নমরুদ, ফিরআউন, ক্বারুন, হামান কিংবা আবু জাহলের অবস্থানে থাকে না। সত্যকে মেনে নেয়ার কারণে দুনিয়াব্যাপী সাম্রাজ্য, বিপুল ক্ষমতা, নেতৃত্ব, আধিপত্য হারানোর ভয় অধিকাংশের থাকে না। বেশিরভাগ মানুষ অনুল্লেখ্য, সাধারণ। তাদের অবস্থাও সাধারণ। অনেক কিছু হারানোর ভয়ে তারা সত্যকে অস্বীকার করে — এমন না। কোন অমূল্য সম্পদের লোভে না, ছাপোষা, মিডিওকার, তুচ্ছ, ঘামে ভেজা, তেল চিটচিটে, বেঢপ-বেখাপ্পা গৃহী জীবনের মোহে তারা সত্যকে ভুলে থাকে। কমফোর্ট যোন থেকে সরার অনীহার কারণে, আতংকের কারণে, সস্তা কিছু সুখ-সুবিধা বাচিয়ে রাখতে তারা সত্য নিয়ে চিন্তা বন্ধ রাখতে চায়। তারা নিজেদের জন্য একটা রুটিন বানিয়ে নেয়, বাস্তব জীবনের বদলে মনের আয়নায় জীবনের একটা নির্দিষ্ট সংস্করণ বানিয়ে নেয়। আর যা কিছু এ খেলাঘরের জন্য হুমকি, সেগুলোর বিরোধিতা করে।
একটা মুহূর্ত কল্পনা করুন। আপনাকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে। গল্প-উপন্যাসের বিদায়বেলার মত দীর্ঘ আবেগঘন দৃশ্যের অংশ হবার সুযোগ আপনি পাচ্ছেন না। জীবন আপনার সাথে এ বেইসিক কার্টেসিটুকু করছে না। কয়েক মিনিটের মধ্যে বেড়িয়ে যেতে হবে। হয়তোবা বন্দী হিসেবে, হয়তোবা আত্মগোপনে। ফিরাউনের কারাগারে কিংবা চেনা পৃথিবী থেকে দূরে কোন লোকালয়ে বা পাথুরে গর্তে। প্রচন্ড অস্থিরতার মাঝেও কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে স্পষ্ট উপলব্ধির। ঐ মুহূর্তটির কথা কল্পনা করুন। যখন বাস্তবতার অসহনীয় ওজন আপনার ওপর চেপে বসেছে। আপনি উপলব্ধি করছেন, আপনার সম্পূর্ণ জীবন বদলে যাচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যে বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে তিলে তিলে গড়ে তোলা আপনার একান্ত বুদবুদ।
আপনার চেনা পৃথিবী, আপনার খেলাঘর আসতে আসতে ঝাপসা হয়ে আসছে। দিগন্ত ধসে পড়েছে — সময়, দৃশ্যপট, পৃথিবী ভেঙ্গেচুড়ে দুমরেমুচড়ে ঐ একটা বিন্দুতে, একটা মূহূর্তে প্রায় স্থির হয়ে আছে। স্রোতের মত একের পর এক অনুভূতি, স্মৃতি আপনাকে গ্রাস করছে অবিশ্বাস্য গতিতে অসংখ্য বিক্ষিপ্ত, প্রায় সম্পর্কহীন, শব্দ, চিন্তা, ছবি মাথার ভেতরে উকি দিয়েই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তটায় যদি আপনি মনোযোগ দেন, যদি আসলেই চেষ্টা করেন, তাহলে নিজের সত্যিকার চেহারটা চিনতে পারবেন। আপনার আর কোণায় বসে থাকা আরামপ্রিয় বিড়ালের জীবনের সাদৃশ্য বুঝতে পারবেন। উপলব্ধি করবেন কতোটা তুচ্ছ, নগণ্য, মূল্যহীন, অর্থহীন কিছু জিনিসের পেছনে আপনি এতোদিন ছুটেছেন। কী ছেলেখেলার মাঝে আপনি এতোদিন অর্থ আর স্বার্থকতা খুজে ফিরেছেন।
আমরা যারা ইসলামকে সত্য বলে জানার পরও সত্যকে ভুলে থাকি, আর যারা অল্প-স্বল্প সুবিধাবাদি ইসলাম পালন করার চেষ্টা করে “দায়িত্ব শেষ” হবার আর নিজেকে “অন্য অনেকের চেয়ে ভালো” মনে করে আত্মতৃপ্তিতে ভুগি — সবার জন্যই কথাগুলো সত্য। বছরের পর বছর, ভুলকে ভুল হিসেবে চেনার পরও, সত্য আমাদের সামনে প্রকাশিত হবার পরও আমরা যে নিজেদের বদলাতে পারি না, ভুল শোধরাতে পারি না, তাওবাহ করতে পারি না, দায়িত্ব পালন করি না, পুরোপুরি সত্যকে আকড়ে ধরতে পারি না, মোহ-মায়া ছাড়তে পারি না, সাধারণ হয়েও অসাধারন হয়ে উঠতে পারি না, তার কারণ হল এই বিড়ালপ্রবণতা। কমফোর্ট যোনের প্রতি ভালোবাসা। এটা আমাদের সবার গল্প।
তবে সফল তাঁরাই যারা সত্যের কারণে নিজ নিজ কমফোর্ট যোন থেকে বের হয়ে আসেন।