কালচার হিসেবে, বিশেষ করে কিশোর-তরুণদের কালচার হিসেবে আজ যা চলে তার প্রায় সবকিছুই পশ্চিম থেকে নেয়া। কমসেকম গত দুই দশক ধরে এই অবস্থা চলে আসছে। বাবা-মার প্রজন্মের ‘কালচারের’ সাথে সন্তানদের ‘কালচারের’ কোন মিল নেই।
কালচারের মাধ্যমে প্রজন্মগত এবং জীবনদর্শনগত দূরত্ব তৈরি ব্যাপারটা পশ্চিমে ব্যাপকভাবে ঘটে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। সেক্সুয়াল রেভ্যুলুশন, হিপি মুভমেন্ট, কাউন্টারকালচার, রক অ্যান্ড রৌল – এসবের মাধ্যমে। ক্লোসআপ যেমন তাদের ক্যাম্পেইনের ওয়াইট পেইপারে বলেছে তাদের এই ক্যাম্পেইনে ভিত্তির ষাটের দশকের যৌন বিপ্লবের আদর্শ।
আমাদের মত দেশগুলোতে এই হাওয়া আসতে শুরু করে আশি ও নব্বইয়ের দশকে। ২০০০ সালের পর থেকে ইন্টারনেটের কল্যানে এই স্রোত পরিণত হয় বন্যায়। খুব দ্রুত পুরো বিশ্বজুড়ে তৈরি হয় এক মনোকালচার। জোড়াতালি দেয়া কুৎসিত এক নকশীকাঁথা।
ইন্টারনেট এই ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের খুবই শক্তিশালী এবং কার্যকরী মাধ্যম। আগে যে প্রক্রিয়া শেষ হতে বছরের পর বছর সময় লাগতো, এখন সেটা হয় মাসের ব্যবধানে। টিকটকের বদৌলতে অ্যামেরিকার সাবআর্বের কিশোরীদের মধ্যে শুরু হওয়া ট্রেন্ড পৌছে যাচ্ছে তিনশো ফিটের রাস্তায় বসে আড্ডা দেয় টিকটক অপুদের কাছে। তুরস্কের আইসক্রিম চ্যালেঞ্জের অনুকরণে নাচ ধরে দেশের হিজাব পরা আপুরা।
‘হাজার বছরের বাঙালি’ সংস্কৃতি এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ। মিডিয়া এবং গ্লোবালিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যে এজেন্ডা সেট করেছে, কিছু সময় পরে ‘বাঙালি কালচার’ তার আত্মীকরণ করে নিয়েছে। শুধু বাঙালি সংস্কৃতি না, মোটামুটি সব ট্র্যাডিশানাল সংস্কৃতির জন্যই এটা সত্য।
এধরনের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনের মোকাবেলা নিছক ‘ট্র্যাডিশন’ দিয়ে করা সম্ভব না। কারণ নিছক ট্র্যাডিশনের ভিত্তি হল অতীতকে আকড়ে ধরা। পূর্বপুরুষের অনুসরণ। এখানে শক্ত কোন আকাঈদী, আদর্শিক উপাদান নেই।
‘আমাদের পূর্বপুরুষ অমুক কাজ করেনি’, ‘আমাদের সমাজের সাথে এসব যায় না…’ – এগুলো খুব দুর্বল অবস্থান। এগুলোর ভিত্তিতে বেশিদিন এই ঝড়ের সামনে টেকা যায় না। বেশি থেকে বেশি আগ্রাসনের গতি কিছুটা শ্লথ করা সম্ভব। এক প্রজন্ম হয়তো বাঁধা দিতে পারে, কিন্তু শিক্ষা, মিডিয়া, শিল্পের মাধ্যমে পরের প্রজন্মের মূল্যবোধ বদলে যায়। বদলে যায় চিন্তার ধরন। বাবামা-যে জিনিসের বিরোধিতা করেছে, সন্তান তা উৎসাহ ভরে গ্রহণ করে নেয়।
এভাবেই হয়, এভাবেই হয়ে আসছে।
আপনি ফ্রি লাভ এর চিন্তা গ্রহণ করলে সেটা শুধু ‘পবিত্র ভালোবাসা’, ট্রু-লাভ, কিংবা ‘সৌলমেইট’-এর গল্পে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর সাথে লিভ টুগেদার আসবে, এলgiবিt আসবে, ট্র্যান্স আসবে। সামনে আরো অনেক কিছু আসবে। কারণ এই সব কিছু মিলে এক পরস্পর সংযুক্ত সম্পূর্ণতা। যার কোন এক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্রভাবে গ্রহণ বা বর্জনের সুযোগ নেই।
আপনি লিভ টুগেদারকে হ্যাঁ বলবেন কিন্তু এলজি টিভির ব্যাপারে গিয়ে সীমা টানবেন – তা হবে না। এটা যৌক্তিক না। আপনি নানা বুঝ দিয়ে নিজের মনে হয়তো এর বৈধতা তৈরি করবেন, কিন্তু সেটা অন্য কারো কাছে অর্থবহ হবে না। আপনার টানা সীমানা আপনার সন্তান মানবে না। এটাই লজিকাল, এটাই কনসিস্টেন্ট।
সভ্যতার যেকোনো অংশ তার পুরোটার সাথে সংযুক্ত। এক সুতো টানলে দেখবেন অসংখ্য অদৃশ্য আঁশ আর সংযুক্তির জালের মাধ্যমে বাকি অংশের সাথে তা যুক্ত। ‘ভালো’ মনে করে যে অংশটুকু আপনি আলাদা করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন, তা আপনার ঘরে টুকরো টুকরো করে, খণ্ডে খণ্ডে, ধাপে ধাপে নিয়ে আসছে তার সম্পূর্ণ কাঠামো।
এজন্যই নিছক ‘কালচারাল মুসলিম’ কিংবা ‘ইসলামিকেইট’ সংস্কৃতির ধারণা দিয়ে আপনি এই আগ্রাসনের মোকাবেলা করতে পারবেন না। ভেসে যাবেন। যেভাবে আপনাদের আগে ভেসে গেছে খ্রিষ্টান এবং ইহুদীরা। এই আগ্রাসন, এই দ্বন্দ্ব মৌলিকভাবে আকীদাহ, এবং দ্বীনের দ্বন্দ্ব। ওয়ার্ল্ডভিউ এবং সভ্যতার দ্বন্দ্ব। বিশুদ্ধ, আপসহীন আকীদাহ এবং মানহাজ ছাড়া এই লড়াইয়ে জেতা দূরের কথা, টিকে থাকাও সম্ভব না। এটাকে সালাফি, ওয়াহাবি, ত।লেব।নী, মরু ইসলাম, বেদুঈন ইসলাম – যাই বলুন না কেন, বাস্তবতা এতে বদলাবে না।
আপসহীন আকীদাহ, মানহাজ, সালাফুস সালেহীনের অবস্থানের আলোকে দ্বীন ইসলামের সঠিক বুঝ আকড়ে ধরা ছাড়া এবং সক্রিয় বিরোধিতা ছাড়া এই আগ্রাসনের কবল থেকে নিজেকে এবং নিজের বংশধরদের ঈমান রক্ষা করা সম্ভব না। রূম আর কিসরার সাম্রাজ্য ‘বেদুঈনরা’ই জয় করেছিল। কালচারালি অনেক বেশি সমৃদ্ধ কুরাঈশরা না।