মানুষের আঞ্চলিক বা গোত্রীয় পরিচয় আর ‘জাতীয়তা’র ধারণা এক না। নিজ জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা আর আধুনিক অর্থে দেশপ্রেম এক জিনিস না। নির্দিষ্ট অঞ্চল বা গোত্রের সাথে সম্পৃক্ততার ধারণাও জাতীয়তাবাদ না।
অঞ্চল ভেদে মানুষের মধ্যে ভিন্ন আচরণ, রুচি, সংস্কৃতি, মেজাজ এবং চিন্তার অস্তিত্ব, এগুলোকে কেন্দ্র করে আত্মমর্যাদার অনুভূতি অনেক আগে থেকেই ছিল, আগামীতেও থাকবে। এই পার্থক্যগুলোকে ইসলাম অস্বীকার করে না। এর মধ্যে যা যা শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক না সেগুলো বজায় রাখাও দোষের কিছু না। বরং রাজনৈতিকভাবে উম্মাহকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে এই পার্থক্যগুলো মাথায় রেখে হিসেব করা জরুরী। কিন্তু গোত্রীয় ও আঞ্চলিক পরিচয়কে জাতীয়তা এবং জাতীয়তাবাদের সাথে মিশিয়ে দেয়া যায় না।
জাতীয়তা (nationality) এবং জাতিগোষ্ঠীগত (ethnicity) পরিচয় ভিন্ন জিনিস। জাতিগতভাবে কাচিন হবার সাথে জাতীয়তা ‘বার্মিয’ হবার তফাত আছে। জাতিগতভাবে বোদো হওয়া আর জাতীয়তা ‘ভারতীয় হবার মধ্যে পার্থক্য আছে। পার্থক্য আছে জাতিগতভাবে চাকমা, মারমা, ম্রো হবার সাথে ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তার। গোত্রীয়ভাবে কুরাঈশী, খাযরাজী কিংবা তামিমী হবার সাথে তফাত আছে ‘সাউদি’, ‘কুয়েতি’ কিংবা ‘জর্ডানি’ জাতীয়তার।
অনেক ক্ষেত্রেই জাতিগত (ethnicity) পরিচয়গুলোর সাথে ‘জাতীয়তা’র পরিচয় সাংঘর্ষিক। জাতীয়তা একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের ভিত্তিতে অন্যান্য সব পরিচয়কে একীভূত করতে চায়। আর এটা অনেকেরই পছন্দ না। ইরাক, সিরিয়া এবং তুরস্কের কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের অনেকেই যেমন এই রাষ্ট্রগুলোর ভিত্তিতে জাতীয়তার পরিচয় পছন্দ করে না। তারা আলাদা রাষ্ট্র চায়। একই ধরনের কারণে ভারতের সেভেন সিস্টার্সে দশকের পর দশক যুদ্ধ হয়। বাঙ্গালিরা কিংবা বালুচিরা পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে আলাদা হতে চায়। ডুরান্ড লাইনের দুই পাশের পাশতুন গোত্ররা নিজেদের মধ্যে পাকিস্তানী আর আফগানী বলে পার্থক্য করে না। তারা পাশতুন এবং মুসলিম পরিচয়কে যথেষ্ট মনে করে।
একইভাবে আঞ্চলিক ও বংশীয় পরিচয়ও জাতীয়তা না। আমার দাদা মারা গেছেন ১৯৯৪ সালে, রাহিমাহুল্লাহ। আঞ্চলিকভাবে উনি চট্টগ্রামের মানুষ। বংশীয়ভাবে পরিচয় সৈয়দ। কিন্তু উনার জাতীয়তা কী?
১৯২০ সালে উনার জাতীয়তা কী ছিল?
১৯৬০ সালে কী ছিল?
আর ১৯৯০ সালে উনার জাতীয়তা কী ছিল?
তাঁর আঞ্চলিক কিংবা বংশীয় পরিচয় একটাই। এতে কোন পরিবর্তন নেই। কিন্তু জীবদ্দশায় তার জাতীয়তা দু’বার বদলেছে। আঞ্চলিক, বংশীয়-গোত্রীয় পরিচয় আর জাতীয়তা এক কিভাবে হল?
ইয়োগোস্লাভিয়া ১৯১৮ সালে গঠন হয়, ১৯৯২ সালে ভেঙ্গে যায়। ধরুন ঐ অঞ্চলের কেউ ১৯১৫ তে জন্মে, ২০০০ সালে মারা গেল। তার জাতীয়তা কয়বার বদলালো? আর আঞ্চলিক ও বংশীয় পরিচয় কয়বার বদলালো? এমন আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।
উমাইয়্যা, আব্বাসী, উসমানী খিলাফাহগুলো ছিল বংশীয় শাসন। এই শাসনের অধীনে থাকা মানুষের পরিচয়ের দুটা অংশ ছিল –
ক) মুসলিম পরিচয়, মূল পরিচয়
খ) আঞ্চলিক ও গোত্রীয় পরিচয় – হিজাযী, শামী, কুরাইশী, তামীমি ইত্যাদি
তাদের মধ্যে উমাইয়্যা, আব্বাসী বা উসমানী কোন ‘জাতীয়তা’র ধারণা ছিল না (যদিও আজকের ‘সাউদি’ আরবে এই বিচিত্র জিনিস তৈরি হয়েছে)। উমাইয়্যাহদের বদলে আব্বাসীরা আসায় মানুষের পরিচয় বদলায়নি। কেবল শাসক বদলেছে এবং বাইয়াহ বদলেছে।
অন্যদিকে জাতীয়তা, ওপরের ক কিংবা খ কোনটার মধ্যে পড়ে না। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা ধারণা, যা সরাসরি পলিটিকাল এনটিটি হিসেবে রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত। আজকের জাতীয়তা এবং জাতীয়তাবাদের ধারনা এসেছে আধুনিক রাষ্ট্র এবং জাতিরাষ্ট্রের ধারণা থেকে। যেখানে জাতীয়তা এবং জাতিরাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। আছে লিবারেল-সেক্যুলার দর্শন থেকে আসা শাসন, আনুগত্য এবং সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে কিছু নির্দিষ্ট ধারণা। এগুলোর জন্ম ইউরোপে, দুই-আড়াইশো বছর আগে।
উপনিবেশবাদের মাধ্যমে পরে এই ধারণাগুলো বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। . আধুনিক রাষ্ট্রে ‘জাতি’ একটা কল্পিত এবং কৃত্রিমভাবে তৈরি সম্প্রদায় (imagine community)। যার সংজ্ঞা এবং সীমানা এলেমেলো এবং অসংলগ্ন (arbitrary & inconsistent)।
জাতি নামক এই সম্প্রদায় বা কমিউনিটির ধারণা তৈরি হয়েছে অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠার জন্য। অন্য সব কিছুর প্রতি (ধর্ম, গোত্র, অঞ্চল) আনুগত্যের ওপর অগ্রাধিকার পাবার জন্য। বাকি সব কিছুর প্রতি ছাপিয়ে দেশ ও জাতির প্রতি আনুগত্য প্রধান্য পাবে। আর সেটা হবে দেশ ও জাতির মূর্ত রূপ ‘রাষ্ট্রের’ প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে।
আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে দেশকে সর্বোচ্চ আনুগত্য, পবিত্রতা এবং কর্তৃত্বের আধার হিসেবে দেখাহয়। দেশপ্রেম এবং দেশের প্রত্যি আনুগত্যকে দেয়া হয় সর্বোচ্চ মূল্যবোধ হিসেবে। যে কাজ অন্য কোন ক্ষেত্রে বৈধ না, ‘দেশের জন্য’ করলে সেটা বৈধ হয়ে যায়। ধর্ম, বংশ, আদর্শ কিংবা সম্মানের জন্যেও যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু দেশের জন্য করা যায়। স্রেফ গতো দুশো বছরে জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে যতো মানুষ মারা গেছে, অতো মানুষ চারশো বছরের ক্রুসেইড এবং ধর্মযুদ্ধে মারা যায়নি। তবুও এটা পবিত্র ইবাদাত!
চূড়ান্ত মূল্যবোধ, কর্তৃত্ব এবং পরিচয়ের কেন্দ্র হিশেবে দেশ বা রাষ্ট্রকে রাখার এই ধারণাকে এনলাইটেনমেন্ট এবং শাসনের সেক্যুলার-লিবারেল দর্শন থেকে আলাদা করে দেখার কোন সুযোগ নেই। খিলাফাহর পতন, মুসলিম উম্মাহর নানা ‘রাষ্ট্রে’ বিভক্ত হওয়া এবং উম্মাহ-বোধের বদলে নির্দিষ্ট অঞ্চলকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চিন্তার ধারণা প্রসারের পেছনেও জাতীয়তাবাদের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
আঞ্চলিক এবং বংশীয়-গোত্রীয় পরিচয় মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শুরু থেকে ছিল। ১৩০০ বছর ধরে এগুলোর ভিত্তিতে তৈরি কোন বিভক্তি উম্মাহকে এতো তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ, দুর্বল ও অসহায় করতে পারেনি, যা একশো বছরের জাতীয়তাবাদের কারনে হয়েছে।
এতো সব কিছু উপেক্ষা করে মক্কাকে ভালোবাসার হাদীস কিংবা ‘আগে যেটা আঞ্চলিক ও গোত্রীয় পরিচয় ছিল সেটাই আজকে জাতীয়তা’ – এ জাতীয় কথা অত্যন্ত অগভীর, রিডাকটিভ এবং ফ্র্যাংকলি চিন্তাগত অলসতার ইঙ্গিত দেয়।