লিবারেল-সেক্যুলার প্রগতিবাদীরা (নাস্তিক, হিউম্যানিস্ট এবং তথাকথিত সংস্কারপন্থী মুসলিমরাও এর অন্তর্ভুক্ত) মনে করে সময়ের সাথে নৈতিকতার পরিবর্তন হওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। তাদের চোখে এটা এক প্রাকৃতিক এবং অবধারিত প্রক্রিয়া, যা সবার মেনে নেয়া উচিত। আসলে তারা নৈতিকতার ব্যাপারে বিভ্রান্তির মধ্যে আছে। সময়ের সাথে ধর্মীয় নৈতিকতাকে ছুড়ে ফেলার মধ্যে তারা কোনো সমস্যা দেখে না, কারণ ধর্মীয় বিধান এবং অবস্থানকে তারা কখনো নৈতিকভাবে বাধ্যতামূলক মনে করত না। যেমন তারা বলে–
অতীতে বিয়ে-বহির্ভূত যৌনতাকে অনৈতিক মনে করা হতো ধর্মীয় অনুভূতির কারণে। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। এখন আর আমরা এটাকে খারাপ মনে করি না, কারণ আমাদের অগ্রগতি হয়েছে।
এ ধরনের চিন্তাধারা যে তালগোল পাকানো তা সহজেই দেখানো যায়।
এমন কোনো একটা মূল্যবোধ বা নৈতিক অবস্থানের কথা চিন্তা করুন যেটা মেনে চলাকে লিবারেল-সেক্যুলাররা বাধ্যতামূলক মনে করে। যেমন, জাতিগত বা বর্ণগত সমতা (racial equality)। এবার তাদের প্রশ্ন করুন–
বর্ণগত সমতাকে আজ নৈতিক মনে করা হয়। কিন্তু সময়ের সাথে এটা তো পাল্টাতে পারে, তাই না? একসময় হয়তো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকেও নৈতিক বা গ্রহণযোগ্য মনে করা হবে। হয়তো নৈতিকতার বিবর্তনে একসময় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ অনুসরণীয় মূল্যবোধ হবে। সবাই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী আদর্শ অনুসরণের চেষ্টা করবে। তখন কি তুমি সেটাকে নৈতিক বলে মেনে নেবে? হয়তো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদে আসলে আপত্তি করার মতো কিছু নেই। আমাদের সীমিত জ্ঞানের কারণে এটা আমরা এখন বুঝতে পারছি না, কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষ বুঝতে পারবে। যিনাকে একসময় খারাপ মনে করা হতো কিন্তু আধুনিক মানুষ ‘আবিষ্কার’ করল যিনার মধ্যে আসলে খারাপ কিছু নেই। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের ক্ষেত্রেও তো এমন ঘটতে পারে, তাই না? পার্থক্য কোথায়? এভাবে কি নৈতিকতার অগ্রগতি, প্রগতি, বিবর্তন হতে পারে না?
এ প্রশ্নের জবাবে কেউ হয়তো বলতে পারে–নৈতিকতার বিবর্তন এলেমেলোভাবে হয় না। এর অগ্রগতি হয় একটা নির্দিষ্ট দিকে। সময়ের সাথে সাথে আমরা কুসংস্কার কাটিয়ে উঠি। ক্ষতিকর বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে শিখি। এভাবে আমাদের নৈতিকতা আরও নির্ভুল হয়ে ওঠে। আর সত্যিকার অর্থে একমাত্র অনৈতিক কাজ হলো অন্য কারও ক্ষতি করা। একে বলা হয় ‘হার্ম প্রিন্সিপাল’।[1]
লিবারেল-সেক্যুলারিসমে দীক্ষিত মানুষদের মধ্যে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। তারা বলে, যিনা আসলে মানুষের ক্ষতি করে না। এটা আধুনিক মানুষ আবিষ্কার করেছে। কাজেই যিনাকে অনৈতিক মনে করার কোনো কারণ নেই (যদিও আসলে এর বিপরীত অনেক প্রমাণ ও উদাহরণ আছে)। একইভাবে আমরা আবিষ্কার করেছি শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতাদর্শ ক্ষতিকর, অতএব তা অনৈতিক।
কিন্তু এখানে একটা ঘাপলা আছে। একটু পিছিয়ে আসলে বিষয়টা ধরা পড়ে। হার্ম প্রিন্সিপাল যদি সকল নৈতিকতার মাপকাঠি হয় তাহলে হার্ম প্রিন্সিপালেরও তো বিবর্তন হতে পারে। এই নীতির মধ্যেও তো পরিবর্তন আসতে পারে, তাই না? ভেবে দেখুন, যদি নৈতিকতা পরিবর্তনশীল হয় এবং নৈতিকতার একমাত্র মূলনীতি হয় হার্ম প্রিন্সিপাল, তাহলে হার্ম প্রিন্সিপালের মধ্যেও তো পরিবর্তন আসার কথা।
কিন্তু লিবারেল সেক্যুলারিস্টরা কি এ কথা মেনে নেবে?
হয়তো একসময় আমরা আবিষ্কার করব অনেক ক্ষেত্রে মানুষের ক্ষতি করাও নৈতিকভাবে বৈধ হতে পারে, এবং হার্ম প্রিন্সিপাল আসলে অতীতের সেকেলে, অচল রদ্দি মাল ছাড়া আর কিছু না।
লিবারেল-সেক্যুলারিস্টরা যদি বলে এমন হওয়া সম্ভব না, হার্ম প্রিন্সিপাল সর্বাবস্থায়, সকল সময়ে বৈধ এবং বাধ্যতামূলক–অর্থাৎ ধ্রুব সত্য–তাহলে তারা আসলে নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রগতিশীল না; বরং তারা মনে করে তাদের নৈতিকতাই পরম সত্য এবং ধ্রুব। তাহলে প্রশ্ন হবে–মুসলিমরাও নৈতিকতার এক পরম, ধ্রুব মানদণ্ডে বিশ্বাস করে। পরম নৈতিকতায় বিশ্বাস করার কারণে মুসলিমদের কেন সমালোচনা করা হচ্ছে?
আসলে হার্ম প্রিন্সিপালের খণ্ডনও বেশ সোজা।
- ক্ষতির সংজ্ঞা কী?
- এই সংজ্ঞা কে নির্ধারণ করবে?
- এই সংজ্ঞার ভিত্তি কী?
ক্ষতির ধারণা গড়ে ওঠে ব্যক্তির নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের ভিতের ওপর। কোন জিনিসটাকে আপনি ক্ষতিকর মনে করেন সেটা নির্ভর করে আপনার নৈতিক এবং অন্টোলজিকাল কমিটমেন্টের ওপর।[2]
তাই এ প্রশ্নগুলো আনলেই হার্ম প্রিন্সিপালের অসাড়তা স্পষ্ট হতে শুরু করে।
তবে আমি এখানে মনোযোগ দিতে চাই ‘পরিবর্তনশীল নৈতিকতা’-র ধারণার ওপর। হার্ম প্রিন্সিপালকে চূড়ান্ত মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করা লোকেরা সময়ের সাথে নৈতিকতার পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে ক্ষতির ব্যাপারে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফাংশান হিসেবে। অর্থাৎ কোন জিনিস ক্ষতিকর আর কোন জিনিস ক্ষতিকর না, সেটা আমরা সময়ের সাথে সাথে আবিষ্কার করি। এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে নৈতিকতার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়।
এটা তাদের বক্তব্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো ‘আবিষ্কারের’ এই প্রক্রিয়াটা কেমন?
ক্ষতি আবিষ্কার করার ব্যাপারটা জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে আসলে কী রকম? এটা কি নতুন কোনো গ্রহ বা নতুন কোনো কেমিক্যাল আবিষ্কারের মতো? এটা কি গবেষণাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে করা হচ্ছে? ক্ষতি কি দেখা যায়? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হলো, এ ধরনের অগ্রগতি দেখার কিংবা বোঝার সক্ষমতা সময়ের সাথে বদলায় কীভাবে? সময়ের সাথে প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, বড় বড়, ভালো ভালো টেলিস্কোপ তৈরি হয়েছে, তাই আমরা নতুন নতুন গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ আবিষ্কার করতে পারছি। এটা বোঝা গেল। কিন্তু নতুন নতুন ক্ষতি কীভাবে আবিষ্কৃত হচ্ছে? এটা আমরা কীভাবে সনাক্ত করছি? কী দিয়ে দেখছি?
লিবারেল-সেক্যুলার প্রগতিশীলদের কাছে এই প্রশ্নের এমন কোনো জবাব নেই, যা আবেগপ্রসূত কিংবা ফাঁপা বুলিসর্বস্ব না। তাই সে শেষমেশ বলবে–
আসলে ক্ষতিগুলো সব সময় জানা ছিল। কিন্তু ক্ষতিগুলো দূর করার জন্যে নৈতিকতার যে পরিবর্তনগুলো দরকার ছিল, দুষ্ট, স্বার্থপর লোকেরা তা করতে দেয়নি।
এ ধরনের উত্তরের ব্যাপারে দুটো বড় আপত্তি থাকে।
প্রথমত, যেগুলোকে আজ ‘ক্ষতি’ মনে করা হচ্ছে, মানুষ যে সব সময়ই সেগুলোকে ‘ক্ষতিকর’ মনে করত তার প্রমাণ কী? বরং ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আজ এমন অনেক বিষয়কে গুরুতর রকমের ক্ষতিকর মনে করা হচ্ছে, যেগুলোকে এর আগে কখনো এভাবে দেখা হয়নি।
যেমন, সমকামিতার বিরোধিতাকে আজ ক্ষতিকর মনে করা হয়। আগে মনে করা হতো না। কেবল মনের খেয়াল বশে পুরুষ লিঙ্গ বদলে নারী হবে, নারী পুরুষ হবে, আর কেউ এটার বিরোধিতা করলে সেটাকে ক্ষতিকর বলা হবে–এমন কোনো অবস্থান ইতিহাসে এর আগে আমরা দেখি না।
আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জেন্ডার স্টাডিসের অধীনে যেসব বিষয়কে অত্যাচার, নিপীড়ন, শোষণ কিংবা যৌন বৈষম্য বলে শেখানো হচ্ছে, সেগুলো তো ইতিহাসের এর আগে কেউ শোনেইনি। যে ধারণাগুলোর ওপর ভিত্তি করে এসব ক্ষেত্রে ক্ষতি বা অন্যায়ের কথা বলে হচ্ছে, সেগুলোর জন্মই হয়েছে দুই থেকে তিন দশক আগে।
কাজেই লিবারেল-সেক্যুলার প্রগতিবাদীরা যেসব জিনিসকে আজ ‘ক্ষতিকর’ মনে করে, সেগুলোকে সব সময় ক্ষতিকর মনে করা হতো, এই কথা সঠিক মনে করার কোনো কারণ নেই।
দ্বিতীয়ত, ‘ক্ষতিগুলো সব সময় জানা ছিল, কিন্তু দুষ্ট লোকেরা নৈতিকতার পরিবর্তনের পথ আটকে রেখেছিল’–এ উত্তর আসলে ‘পরিবর্তনশীল নৈতিকতার’ ধারণার বিরুদ্ধে যায়। ক্ষতি যদি সব সময় জানা থাকে তাহলে ক্ষতি আসলে পরিবর্তনশীল না। তাহলে নৈতিক অগ্রগতি কোথায় হলো?
লিবারেল-সেক্যুলাররা বলবে, দুষ্ট লোকেরা যখন পরাজিত হয় আর ভালো লোকেরা যখন সত্যিকারের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে, তখন অগ্রগতি ঘটে। কিন্তু এটা নৈতিক অগ্রগতির বেশ দুর্বল একটা ধারণা। এ ধরনের অগ্রগতিতে সবাই বিশ্বাস করে। সবাই মনে করে ভালো-মন্দের মধ্যে চিরন্তন লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে অনেক সময় সত্যের পক্ষ বিজয়ী হয়। অনেক সময় মিথ্যের পক্ষ বিজয়ী হয়। অ-লিবারেল, অ-সেক্যুলার আস্তিকরাও এটা বিশ্বাস করে। কিন্তু এটাকে নৈতিকতার সেই ক্রমবিবর্তন বলা যায় না, যার কথা লিবারেল-সেক্যুলাররা বলে থাকে।
আসলে খুঁটিয়ে দেখতে গেলে নৈতিক প্রগতির ধারণা ধোপে টিকে থাকে না। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই তা ধসে পড়ে। এ ধারণা গড়ে উঠেছে বেশ গুরুতর কিছু জ্ঞানতাত্ত্বিক ত্রুটির ওপর। আর এই ত্রুটিগুলোর অনেকগুলো এসেছে হার্ম প্রিন্সিপালের অসম্পূর্ণতা এবং ত্রুটি থেকে।
লিবারেল-সেক্যুলাররা যখন নৈতিক অগ্রগতির কথা বলে, তখন মুসলিমদের উচিত এর বিরোধিতা করা। মুসলিম হিসেবে আমরা নৈতিকতার অপরিবর্তনীয়, অমোঘ, পরম মানদণ্ডে বিশ্বাসী, যা ওয়াহি নাযিলের সময় থেকে শুরু করে কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। তাই আমাদের উচিত লিবারেল-সেক্যুলারদের এই কল্পকাহিনির ফাঁকফোকরগুলো তুলে ধরা এবং প্রতিপক্ষকে তাদের এসব জোড়াতালিগুলো নিয়ে কথা বলতে বাধ্য করা।
[ড্যানিয়েল হাক্বিকাতযু, The Modernist Menace To Islam বই থেকে নেয়া। বাংলায় ‘সংশয়বাদী’ নামে অনূদিত।]
[1] হার্ম প্রিন্সিপাল–মানুষের যা ইচ্ছে করার অধিকার আছে যতক্ষণ না সেটা অন্য কারোর ক্ষতির কারণ হচ্ছে। যদি অন্য কারও ক্ষতি না হয়, তাহলে মানুষের কোনো কাজে বাধা দেয়ার অধিকার সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম বা কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। বাধা কেবল তখনই দেয়া যাবে যখন ব্যক্তির কাজ অন্য কারোর ক্ষতি করবে। কোনো কাজ নৈতিকভাবে অননুমোদিত কিংবা অবৈধ হবে—যখন তা অন্যের ক্ষতি করবে। এর বাইরে বাকি সব বৈধ, বাকি সব অনুমোদিত। ~ অনুবাদক
[2] অনটোলজি—অনটোলজি (Ontology)–বাংলায় পরাবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা। দর্শনের ওই শাখা, যা বাস্তবতার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে। কী আছে, কী নেই? কোনটা বাস্তব, কোনটা অবাস্তব? অস্তিতশীল কী? অস্তিত্বশীল হবার অর্থ কী? বস্তু কী? সত্তা কী?– এ ধরনের প্রশ্নগুলো অনটোলজির আলোচনা। অর্থাৎ এখানে লেখক বলছেন–‘ক্ষতির’ ব্যাপারে একজন ব্যক্তির ধারণা নির্ভর করে অনটোলজির প্রশ্নগুলোর উত্তর সে কীভাবে দিচ্ছে তার ওপর। ~ অনুবাদক