বাংলাদেশে এলজিবিটি এজেন্ডার নেপথ্যে কারা?


ভূমিকা

বাংলাদেশে বিকৃত যৌনতার স্বাভাবিকীকরণের কার্যক্রম শুরু হয় নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে নানান আঙ্গিকে কাজ কর্ম চলছে। মূল আলোচনাতে যাবার আগে, একটা সামারি দিয়ে দেই,

বাংলাদেশে যতো ধরনের এলজিবিটি কর্মকান্ড হয়েছে সবগুলোর মধ্যে নিচের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে –

বিদেশী কানেকশনঃ বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলঃ

  • পশ্চিমা ফান্ডিং
  • আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিও
  • আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক এলজিবিটি নেটওয়ার্ক
  • দেশীয় এনজিও

শব্দজাদুঃ বাংলাদেশে সরাসরি এলজিবিটি বা সমকামী শব্দটা ব্যবহার করে কাজ করা কঠিন তাই এখানে শুরু থেকে কাজ হয়েছে বিভিন্ন অপরিচিত শব্দ, পরিভাষা এবং অ্যাক্রোনিমের (একাধিক শব্দের একত্রিত সংক্ষিপ্ত রূপ) আড়ালে। যেমন,

  • যৌন স্বাস্থ্য,
  • MSM (Men Who Have Sex With Men/ এমন পুরুষ যে অন্য পুরুষের সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয়)
  • Gender Identity (মনস্তাত্ত্বিক লিঙ্গ পরিচয়)
  • SRHR (Sexual and Reproductive Health and Rights/যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার)
  • SOGI (sexual orientation (যৌন রুচি), gender identity/মনস্তাত্ত্বিক লিঙ্গ পরিচয়)
  • SOGISEC (sexual orientation, gender identity, gender expression and sex characteristic)
  • যৌন সংখ্যালঘু
  • যৌন অধিকার
  • যৌন বৈচিত্র্য
  • বৈচিত্র্যময় লিঙ্গ পরিচয়
  • CSE (Comprehensive Sexuality Education/যৌনতা সম্পর্কিত বিস্তারিত শিক্ষা)
  • ট্র্যান্সজেন্ডার (শারীরিকভাবে সুস্থ পুরুষ যে নারী সাজে, অথবা শারীরিকভাবে সুস্থ নারী যে পুরুষ সাজে)  

আপাতভাবে পার্থক্য থাকলেও এই সব কথাবার্তার মূল বক্তব্য একঃ অবাধ ও বিকৃত যৌনতা এবং ইচ্ছেমতো নিজের পরিচয় বেছে নেয়ার বৈধতা ও সামাজিকীকরণ। প্রথম দেখায় অনেক জটিল মনে হলেও এগুলো সহজে বোঝার একটা উপায় আছে।

যখনই এধরনের আলোচনায় ‘অধিকার’ শব্দটা আসবে, বুঝবেন এখানে বিকৃত যৌনকর্মের বৈধতা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। যেমন,

  • যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার = বিকৃত যৌনতার অধিকার

যখনই, ‘বৈচিত্র্য’ শব্দটা আসবে, বুঝবেন এখানে বিকৃতির কথা বলা হচ্ছে। যেমন,

  • বৈচিত্রময় যৌন পরিচয় = সমকামী বা উভকামী
  • বৈচিত্রময় যৌন রুচি = বিকৃত যৌনতা
  • বৈচিত্রময় লিঙ্গ পরিচয় = নারী সাজা পুরুষ বা পুরুষ সাজা নারী

পর্যায়ক্রমিক অগ্রগতিঃ বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলনের কৌশল হল ধাপে ধাপে আগানো। প্রতি ধাপে তাঁরা নীতিনির্ধারক এবং আমলাদের ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত বা প্রভাবিত করে। এ পদক্ষেপগুলো এমন যে আলাদাভাবে খুব একটা চোখে পড়ার মতো না, কিন্তু দিন শেষে ধাপে ধাপে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া যায়।

মিডিয়া, সুশীল সমাজ, বামপন্থী: মোটামুটি শুরু থেকে বাংলাদেশের মিডিয়া, সুশীল সমাজ এবং বামপন্থীরা এলজিবিটি এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় বা সহযোগী হিসেবে কাজ করে গেছে। প্রথমে ব্যাপারটা একটু অদ্ভূত মনে হতে পারে। আদর্শিকভাবে, কিংবা অন্তত মুখ রক্ষার জন্য হলেও এলজিবিটি আন্দোলনের মতো একটা সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের বিরোধিতা বাংলাদেশের বামপন্থীদের করা উচিৎ ছিল। তারা সেটা করেনি, উলটো সহযোগী হয়েছে। একটু খতিয়ে দেখলে এ ব্যাপারটাকে আর অদ্ভূত মনে হয় না।

এলজিবিটি এজেন্ডার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বৈশ্বিক এনজিও নেটওয়ার্ক। আর বাংলাদেশের সুশীল, প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের বড় একটা অংশ যেহেতু এনজিও-জীবি, তাই বিরোধিতার কোন ইচ্ছা থেকে থাকলেও তা ডলারের প্রকোপে মুছে গেছে। এছাড়া প্রগতিশীল চিন্তাধারা বিশ্বাসগত বা আকীদাহগতভাবেই পশ্চিম থেকে আসা যেকোন মতবাদকে বিনা প্রশ্নে অন্ধভাবে গ্রহণ করে নেয়। ক্রিটিকালি যাচাই করে না।     

চার পর্যায়ঃ আলোচনার সুবিধার জন্য বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলনের ইতিহাসকে আমি চার পর্যায়ে ভাগ করেছি।

  • প্রথম পর্যায়: ‘এইডস প্রতিরোধ ও যৌন স্বাস্থ্য’
  • দ্বিতীয় পর্যায়:  ‘গবেষনা এবং যৌন অধিকার, যৌন সংখ্যালঘু, যৌন বৈচিত্র্য’
  • তৃতীয় পর্যায়: সমকামী অধিকার
  • চতুর্থ পর্যায়: যৌন শিক্ষা ও ট্র্যান্সজেন্ডার

তবে প্রতি ক্ষেত্রে যে এক পর্যায় শেষ হবার পর নতুন আরেক পর্যায় শুরু হয়েছে, ব্যাপারটা তা না। আন্দোলনগুলোর ইতিহাস সাধারণ এমন পরিপাটিভাবে আগায় না। বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে ওভারল্যাপ থাকে। এখানেও আছে। যেমন হিজড়াদের ট্র্যান্সজেন্ডার নাম দিয়ে নানা কার্যক্রম শুরু হয় ২০০০ সালেই। এই অর্থে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে বাংলাদেশে কাজ চলছে বিশ বছরের বেশি সময় ধরে। তবে প্রকৃত অর্থে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারটা শুরু হয় ২০১৩ এর পর। তাই ট্র্যান্সজেন্ডারবাদকে আমি চতুর্থ পর্যায়ে রেখেছি।

এই শ্রেনীবিভাগ বোঝার এবং আলোচনার সুবিধার জন্য, কেউ চাইলে অন্য কোন ভাবেও শ্রেনীবিভাগ করতে পারেন।

ভূমিকা শেষ এবার আমরা মূল আলোচনায় যেতে পারি।

পর্ব ১: প্রথম পর্যায়: এইডস প্রতিরোধ ও যৌন স্বাস্থ্য

পর্ব ২: দ্বিতীয় পর্যায়: ‘স্বাস্থ্য সেবা’ থেকে ‘অধিকার’ – যৌন অধিকার, যৌন সংখ্যালঘু, যৌন বৈচিত্র্য

পর্ব ৩: তৃতীয় পর্যায়: প্রকাশ্যে এলজিবিটি অ্যাক্টিভিসম

পর্ব ৪: চতুর্থ পর্যায়: ট্র্যান্সজেন্ডার ও হিজড়া

পর্ব ৫: চতুর্থ পর্যায়: ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ: আইন, পাঠ্যপুস্তক এবং যৌন শিক্ষা