বাংলাদেশে এলজিবিটি এজেন্ডার নেপথ্যে কারা? পর্ব ৩


তৃতীয় পর্যায়: প্রকাশ্যে এলজিবিটি অ্যাক্টিভিসম

আগের পর্ব

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ইন্টারনেট চ্যাট গ্রুপ, মেইল গ্রুপ এবং ফোরামের মাধ্যমে সম লিঙ্গের সাথে যৌনতায় আসক্ত ব্যক্তিদের একধরনের অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। সমকামীরা এসব অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে যৌন সঙ্গী খুঁজে বের করতো। সমকামী অ্যাক্টিভিস্টদের বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং সাক্ষাতকারের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে রেঙ্গু নামে একজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি ‘গে বাংলাদেশ’ নামে একটি অনলাইন গ্রুপ তৈরি করে। এটি ছিল বাংলাদেশে এধরণের প্রথম গ্রুপ। বাংলাদেশের এলজিবিটি অ্যাক্টিভিসমের প্রতিটা ধাপেই বিদেশী কানেকশন খুঁজে পাওয়া যায়। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের শুরু বিলেত ফেরত ভারতীয় শিবানন্দ খানের মাধ্যমে। ব্র্যাকের কর্মকান্ডের ‘অনুপ্রেরণা’ আসে ব্রিটেনে কনসোর্টিয়ামে অংশগ্রহনের পর। আর সমকামী ই-গ্রুপগুলোর পথচলা শুরু হয় বিদেশফেরত রেঙ্গুর মাধ্যমে। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সদস্য রেঙ্গু পড়াশোনার জন্য জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা সময় কাটিয়েছিল পশ্চিমে। ২০০৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় রেঙ্গু। গে বাংলাদেশের কার্যক্রম থেমে যায় সেখানেই।[1]

কিন্তু গে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রানিত হয়ে ২০০২ গড়ে ওঠে আরেকটি ই-গ্রুপ, বয়েস অফ বাংলাদেশ (Boys of Bangladesh/BoB)। কাজী হক নামে একজন ব্যক্তি (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী) ইয়াহু চ্যাটে এই গ্রুপটি চালু করে।[2] 

অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনে ‘গেট টুগেদার’ এবং ‘ডিজে পার্টি’-র আয়োজন করতে শুরু করে বয়েস অফ বাংলাদেশ। এই অনুষ্ঠানগুলো ছিল সমকামীদের জন্য যৌন সঙ্গী বাছাইয়ের আর এক সাথে ‘ফূর্তি’ করার সুযোগ।  বয়েস অফ বাংলাদেশের সদস্যরা ছিল মূলত মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির। তাদের ‘অনুষ্ঠান’গুলো হতো ঢাকাতে। অন্যদিকে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ছিল মূলত নিন্ম, নিন্ম মধ্যবিত্ত এবং ঢাকার বাইরের সমকামীদের নিয়ে।

২০০৫ সালে বন্ধু-র সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বয়েস অফ বাংলাদেশের। একই বছরের এপ্রিলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র-এর সাথে মিলে বাংলাদেশে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি নিয়ে একটি গবেষনাতে কাজ করে তারা। তবে এ গবেষনার ফলাফল পরে আর প্রকাশিত হয়নি।[3]

অ্যাক্টিভিসম:

প্রথম পাঁচ বছরে বয়েস অফ বাংলাদেশের কার্যক্রম অনলাইন নেটওয়ার্কিং আর অফলাইন ‘ডিজে পার্টি’-র মধ্যে সীমিত থাকে। পরিবর্তন আসতে শুরু করে ২০০৭ থেকে। সে বছর ব্র্যাকের জেইমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ আয়োজিত আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে বয়স অফ বাংলাদেশ।

www.boysofbangladesh.org, Our History

এই ওয়ার্কশপ গভীরভাবে প্রভাবিত করে তাদের কাজের গতিপথকে। ‘ডিজে পার্টি’র পাশাপাশি তারা অ্যাক্টিভিসমে আগ্রহী হয়ে ওঠে, অন্যদিকে এলজিবিটি এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের সাথেও সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে তাদের।

ব্র্যাকের অনুষ্ঠানের পর প্রকাশ্যে কাজ করা শুরু করে বয়েস অফ বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে প্রথম বারের মতো এলজিবিটির প্রতীক রংধনু পতাকা টাঙ্গিয়ে ধানমন্ডির জার্মান ইন্সটিটিউটের ছাদের ক্যাফেতে অনুষ্ঠান করে তারা। এটাকে সমকামী অধিকার নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে।[4] এখানেও সেই একই পশ্চিমা কানেকশন।

https://web.archive.org/web/20171001100805/http://www.boysofbangladesh.org/history_of_e-group.html
২০১০ এ বয়েস অফ বাংলাদেশের ধানমন্ডিতে অনুষ্ঠানের ছবি

একই বছর নেপালের কাঠমুণ্ডুতে এলজিবিটি এজেন্ডা নিয়ে কাজ করা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে ওয়ার্কশপ আয়োজন করে ব্লু ডায়মন্ড সোসাইটি নামে একটি সমকামী সংগঠন। এ ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে বয়েস অফ বাংলাদেশের সদস্য শওকত ইমাম রাজীব।[5] এ ওয়ার্কশপের অর্থায়ন করে এলএলএইচ নামে নরওয়ের একটি সমকামী সংগঠন। পরবর্তীতে এ প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশেও সমকামী অ্যাক্টিভিসমের অর্থায়ন করবে।[6] মজার ব্যাপার হল ব্লু ডায়মন্ড সোসাইটি এবং এর প্রতিষ্ঠাতার সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল নায ফাউন্ডেশনের শিবানন্দ খানের।[7] ২০০৮ এ ব্র্যাকের আয়োজিত বিভিন্ন ওয়ার্কশপ ও গবেষণাতেও অংশ নেয় বয়েস অফ বাংলাদেশ।[8]

www.boysofbangladesh.org, Our History

২০০৯ সালে বয়েস অফ বাংলাদেশ কক্সবাজারে একটি ওয়ার্কশপ আয়োজন করে। এটি ছিল বাংলাদেশে কোন সমকামী সংগঠনের আয়োজিত প্রথম ওয়ার্কশপ। ‘Workshop on Sexual Diversity, Partnership Building and Networking’ শিরোনামের এ ওয়ার্কশপের ফান্ডিং করে নরওয়ের এলএলএইচ।[9] সমকামী পুরুষ ও নারীদের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে হিজড়া সম্প্রদায়, মিডিয়া এবং ‘সুশীল সমাজ’ এর কিছু প্রতিনিধিও। ওয়ার্কশপে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথমত, বিকৃত যৌনতার বৈধতা আদায়ের জন্য একটি কোয়ালিশন  বা জোট গঠন করা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিলের জন্য কাজ করা।[10]

সূত্রঃ https://en.wikipedia.org/wiki/Boys_of_Bangladesh

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ এ জাতিসঙ্ঘের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউতে ৩৭৭ ধারা বাতিলের সুপারিশ করা হয়।[11] জাতিসংঘে এই সুপারিশ তোলা এবং বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে এসআরআই (সেক্সুয়াল রাইটস ইনিশিয়েটিভ) নামে একটি আন্তর্জাতিক এনজিও। আর এসআরআই-কে সহযোগিতা করে বয়েস অফ বাংলাদেশ।[12]

বয়েস অফ বাংলাদেশের মতো একটি অনিবন্ধিত, ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সংগঠন কতো সহজে জাতিসঙ্ঘ পর্যন্ত পৌছে যেতে পারে তা থেকে বৈশ্বিক এলজিবিটি মাফিয়ার শক্তি ও বিস্তৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।

২০১০ সালে বইমেলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে বের হয় কুখ্যাত মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অ্যামেরিকা প্রবাসি ইসলামবিদ্বেষি অভিজিৎ রায়ের বই ‘সমকামিতা’। অভিজিৎ রায় তার এই বইয়ে বিজ্ঞানের জগাখিচুড়ি ব্যাখ্যা, এবং নানা লজিকাল ফ্যালাসি ব্যবহার করে সমকামিতা-কে স্বাভাবিক মানবিক আচরণ হিসেবে প্রমানের চেষ্টা করে। তার অন্যান্য লেখার মতো এই লেখাটিও ছিল বিভিন্ন পশ্চিমা লেখকের লেখার ছায়া অনুবাদ। ২০১০ সালে অগাস্টে অভিজিৎ রায়ের বইটির রিভিউ প্রকাশ করে প্রথম আলো। বিশাল এক পাঠকশ্রেণীর ড্রয়িং রূমে সমকামিতার মতো জঘন্য বিকৃতির সাফাই পৌছে যায় প্রায় সবার অলক্ষ্যে।[13]

এই বই প্রকাশিত হবার পর বয়েস অফ বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অভিজিৎ রায়ের সাথে দেখা করে। একই বছর ধানমন্ডির জার্মান ইন্সটিটিউটে আন্ডার দা রেইনবো নামের একটি এলজিবিটি উৎসব আয়োজন করা হয়। পরের দুই বছরেও এ ‘উৎসব’ আয়োজিত হয়।

২০১৩ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক এলজিবিটি নেটওয়ার্কের সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে যায় বয়েস অফ বাংলাদেশ। জাতিসংঘের ইকোসকের উপদেষ্টা মর্যাদা পাওয়া ইলগার এশীয় শাখার সদস্য পদ পায় তারা। ২০১৩ এর ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে ইলগার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে বক্তব্য উপস্থাপন করে বয়েস অফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি তানভীর আলিম।[14]

https://web.archive.org/web/20150303033427/https://ilga.org/the-universal-periodic-review-and-lgbti-rights-in-bangladesh/
জাতিসঙ্ঘে বয়েস অফ বাংলাদেশ এবং ইলগার পক্ষ থেকে দেয়া বক্তব্য। সূত্রঃ https://www.upr-info.org/sites/default/files/documents/2013-10/international_lesbian_gay_assoc_oral_bangladesh_2013.pdf

এ বছর আবারও জাতিসঙ্ঘের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউতে বাংলদেশ সরকারকে ৩৭৭ নম্বর সেকশন বাতিল করতে বলা হয়। বাংলাদেশ এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে এই সুপারিশ গ্রহণযোগ্য না।[15]

সমকামী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সরকারের এ অবস্থানের সমালোচনা করে আইন ও সালিশ কেন্দের মতো সংস্থাগুলোও। ভারতীয় পত্রিকা ডিএনএ ইন্ডিয়াকে দেয়া সাক্ষাকারে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অ্যাক্টিভিস্ট বিনা ডি কস্টা বলেন,

https://www.dnaindia.com/world/report-bangladesh-refuses-to-abolish-criminalisation-of-consensual-same-sex-ties-1899219

বাংলাদেশের সরকার মৃত্যুদণ্ড বাতিল এবং দণ্ডবিধির ৩৭৭ অনুচ্ছেদ বাতিল করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ গ্রহন করতে রাজি হয়নি, এতে আমরা হতাশ।“[16]

এরপর এপ্রিল ও মে মাসে ব্র্যাক জেইমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ আর বয়েস অফ বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে দুটি গোলটেবিল বৈঠক হয়। বাংলাদেশে এলজিবিটি অধিকার আন্দোলনকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, আলোচনা হয় তা নিয়ে। এ অনুষ্ঠানে সমকামী সংগঠনগুলোর সদস্য এবং ব্র্যাকের পাশাপাশি অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন দূতাবাস এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও।[17]

২০১৪ সালে সমকামীতাদের সামাজিকীকরণের জন্য মার্কিন সরকারের স্টেইট ডিপার্টমেন্টের অর্থায়নে ‘প্রজেক্ট ধী’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে বয়েস অফ বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে মুন্সিগঞ্জের একটি রিসোর্টে দুই দিন ব্যাপী ‘ধী রেসিডেন্সি’ নামের একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।[18] দেশের সমকামীতাদের সামাজিকীকরণ নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এই কর্মশালায়।

বর্তমানে ট্র্যান্সজেন্ডার অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে খ্যাতি পাওয়া অনেকেই বয়েস অফ বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত এই ধী রেসিডেন্সিতে অংশ নেয়।[19]

অক্টোবরে ধী- নামে কমিক প্রকাশ করে বব, যে কমিকের প্রধান চরিত্র একজন সমকামী নারী। এই কমিকের মোড়ক উন্মোচন হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলে। ডেইলি স্টার এবং ডয়েচ ভেলের মত মিডিয়াগুলো ইতিবাচকভাবে নিউজ করে অনুষ্ঠানটি নিয়ে।[20] প্রজেক্ট ধী-র অংশ হিশেবে ২০১৬ নাগাদ দেশের ১৩টি জেলায় অনুষ্ঠান আয়োজন করে বয়েস অফ বাংলাদেশ।

বয়েস অফ বাংলাদেশ এবং এ ধরণের সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের পরিধি ও প্রভাব কেমন ছিল সে ব্যাপারে একটা ধারণা পাওয়া যায় ২০১৮ সালে দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে। ঢাকায় সমকামী ক্লাব শিরোনামের এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  

“ইদানীং রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সমকামীরা ক্লাব খুলে তাদের কাজ করছে। কেউ কেউ এক সঙ্গে থাকছে। এমন একাধিক সমকামী সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এসব সংগঠন গোপনে চালাচ্ছে কার্যক্রম। কিছু এনজিও দিচ্ছে তাদের সহায়তা। ফেসবুক, টুইটার, ইমো, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে এরা এখন সরব। সাংকেতিক কোড ব্যবহার করে বাড়াচ্ছে সদস্য সংখ্যা। সদস্য সংখ্যা কীভাবে বৃদ্ধি করবে তারও ট্রেনিং দেয়া হয় এখানে।…

২০১৫ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর বৃটিশ কাউন্সিলে একটি সমকামী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেদিন ২০০-এর বেশি সমকামী তরুণ-তরুণী জড়ো হয়েছিল। যেখানে ‘ধী’ নামে একটি সমকামী কমিক উপস্থাপন করা হয়েছিল। আর এর চরিত্র ধারণ করেছিলেন দেশের খ্যাতনামা এক সাংস্কৃতিক দম্পতির মেয়ে। সেদিনকার সমাবেশে সমকামীদের অধিকারের পক্ষে ‘নিজেরা করি’ এনজিওর সমন্বয়কারী নানা কথা বলেছিলেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। বৃটিশ কাউন্সিলের সমকামীদের সে সমাবেশের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। এর আগে ২০১৩ সালের ২৯শে এপ্রিল জেনেভায় অনুষ্ঠিত ‘ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউতে’ তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সমকামীদের অধিকারের পক্ষে কথা বলায় দেশে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ২০১৭ সালের আগস্টে কেরানীগঞ্জ থেকে এক গোপন বৈঠক চলাকালে ২৮ সমকামীকে পুলিশ আটক করে। এ ঘটনা নিয়েও দেশজুড়ে তোলপাড় হয়।”[21]

ঢাকায় সমকামী ক্লাব, দৈনিক মানবজমিন

২০০৯ থেকে ২০১৬ এর মধ্যে বয়েস অফ বাংলাদেশের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডের তালিকা (তাদের সাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী) নিচে দেয়া হল –

  • ২০০৯ সালে সাহরা (South Asian Human Rights Association for Marginalized Genders and Sexualities-SAHRA) নামে একটি আঞ্চলিক এলজিবিটি প্ল্যাটফর্মের সদস্য হয় বয়েস অফ বাংলাদেশ।
  • ২০১১ সালে বব এবং বন্ধু যৌথভাবে বাংলাদেশে সাহরার মিটিং আয়োজন করে।
  • জার্মান কালচারাল ইন্সটিটিউট এবং অলিয়স ফ্রসেজে এলজিবিটি নিয়ে বেশ কিছু শিল্প প্রদর্শনী ও ‘ফেস্টিভাল’ আয়োজন ও অংশগ্রহণ করে
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগামের এশিয়ান উইমেনস ইউনিভার্সিটিতে একাধিকার প্রেসেন্টেশান দেয় এবং সেমিনারে অংশগ্রহণ করে
  • বাংলাদেশে হিউম্যান রাইটস ফোরামের সদস্যপদ লাভ 
  • সমকামীতার ওপর একটি ব্রোশিয়ার প্রকাশ (২০১৩)
  • প্রনয়নামা নামে দুটি আবৃত্তি অনুষ্ঠান আয়োজন
  • সমকামীতার পক্ষে যাদুর শহর নামে মঞ্চ নাটক আয়োজন
  • এলজিবিটি নিয়ে আয়োজিত ব্র্যাকের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ
  • সমকামী ফিল্ম ফেস্টিভাল নিয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাথে যৌথ আয়োজন 
  • বাংলাদেশের সমকামীরা যেন সহজে যৌন সঙ্গী খুঁজে বের করতে পারে তার জন্য সমকামীদের আন্তর্জাতিক ডেইটিং অ্যাপ (যৌন সঙ্গী খুঁজে বের করার জন্য তৈরি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন)-এর সাথে কোলাবরেশন
  • সমকামীদের ‘আইনী ক্ষমতায়ন’ নিয়ে ব্ল্যাস্টের সাথে কাজ করা
  • বয়েস অফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি (শওকত ইমাম রাজীব) ২০১৫ সালে ইলগা এশিয়ার বোর্ডের সদস্য মনোনীত হয়।[22]
  • ২০১৬ সালে বয়েস অফ বাংলাদেশ বাংলাদেশে সমকামীতার বৈধতা ও সামাজিকীকরণের লক্ষ্যে ৫ বছরের একটি স্ট্র্যাটিজিক পরিকল্পনা প্রস্তুতের জন্য ময়মনসিংহে ওয়ার্কশপ আয়োজন করে বব।

রূপবান:

ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ ও উৎসাহকে কাজে লাগিয়ে এবং বয়েস অফ বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে থেকে গড়ে ওঠে আরও কিছু সমকামী সংগঠন। 2008 এ কুইয়ার বাংলা (Queer Bangla) এবং (Gay Bangla) নামে দুটো সংগঠন তৈরি হয়, যদিও কোনটাই ঐভাবে স্থায়ী হয় না। তবে সক্রিয় হয় রূপবান নামে আরেকটি উদ্যোগ। ২০১১ থেকে নেটওয়ার্কিং শুরু করলেও রূপবান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ২০১৪ সালে ‘রূপবান’ নামে দেশের প্রথম সমকামী ম্যাগাযিন প্রকাশের মাধ্যমে।[23]

এই ম্যাগাযিনের প্রচারনা চলে প্রিন্ট মিডিয়া (যেমন ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে) এবং অনলাইনের মাধ্যমে। ব্রিটিশ কাউন্সিলে অনুষ্ঠিত রূপবানের প্রথম সংখ্যার প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় তৎকালীন ব্রিটিশ হাই-কমিশনার রবার্ট গিবসন, ব্যারিস্টার সারা হোসেনসহ আরো অনেকে। ম্যাগাযিনটির প্রকাশনার খবর ফলাও করে প্রচার করে ডেইলি স্টার, বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা ট্রিবিউন, বিবিসি সহ বিভিন্ন পত্রিকা ও গণমাধ্যম।[24] বরাবরের মতো এখানেও ছিল পশ্চিমা কানেকশন। রূপবানের প্রধান উদ্যোক্তা জুলহাস মান্নান ছিল মার্কিন দূতাবাসের সাবেক কর্মকর্তা, তার সম্পর্ক ছিল ছিল ইউএসএইডের সাথেও।[25]

বয়েস অফ বাংলাদেশের সাথে মিলে বাংলাদেশের সমকামীদের নিয়ে একটি জরিপ চালায় রূপবান। দাবি করে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ নাকি সমকামী! এই হাস্যকর দাবি পরবর্তীতে বিদেশী এনজিও, পশ্চিমা সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের প্রতিবেদনগুলোতে বারবার ব্যবহার করবে। বয়েস অফ বাংলাদেশের মতো রূপবানও সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট তৈরির জন্য দেশজুড়ে বিভিন্ন ওয়ার্কশপ আয়োজন করে রূপবান ইয়ুথ লিডারশীপ প্রোগ্রাম নামে।[26]

তবে প্রকাশ্য কর্মকান্ডের দিক থেকে বয়েস অফ বাংলাদেশকে বেশ অনেকটা ছাড়িয়ে যায় রূপবান। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে রঙধনু র‍্যালি আয়োজন করে রূপবান। শাহবাগে রংবেরঙের পোশাক পরে মিছিল করে হিজড়া এবং সমকামী পুরুষরা। এ সময়টাতে রূপবান দুটি ‘ফ্যাশন শো’ ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে যেগুলোর মূল থিম ছিল ট্র্যান্সজেন্ডার ও ক্রসড্রেসিং, অর্থাৎ সমকামী পুরুষদের নারীর পোশাকে সাজা।[27]    

জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা জুলহাস মান্নান ও তার সহগামী মাহবুবকে ২০১৬ সালে হত্যা করার পর রূপবানসহ স্তিমিত হয়ে আসে অন্যান্য সমকামী সংগঠনের কার্যক্রম।

অনেক অ্যাকটিভিস্ট দেশ ছেড়ে চলে যায়। প্রায় বন্ধ হয়ে যায় সমকামী অধিকার নিয়ে প্রকাশ্য কার্যক্রম।

এমন পরিস্থিতিতে শুরু হয়ে বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলনের চতুর্থ পর্যায়। 

পরের পর্ব


[1] https://web.archive.org/web/20171001100805/http://www.boysofbangladesh.org/history_of_e-group.html

[2] Star Observer, Getting connected in Bangladesh, 2008,

[3] “Though ASK (Ayan o Saleesh kendro, literally “law and arbitration center”) at- tempted to undertake a situation analysis of the LGBT in Dhaka, the research findings were never made public.” Hossain, A. “Bangladesh: Review of LGBT situation in Bangladesh.” The Greenwood Encyclopedia of LGBT Issues Worldwide (2010): 333-346.

www.boysofbangladesh.org, Our History

[4] www.boysofbangladesh.org, Our History

[5] Hossain, Adnan. “Section 377, same-sex sexualities and the struggle for sexual rights in Bangladesh.” Austl. J. Asian L. 20 (2019): 115. এবং, www.boysofbangladesh.org, Our History

[6] The workshop was titled ‘South Asian Partnership Building Workshop’ organized by Blue Diamond Society of Nepal in cooperation with LLH, Norway.

https://web.archive.org/web/20171001100805/http://www.boysofbangladesh.org/history_of_e-group.html

[7] https://bluediamondsociety.wordpress.com/2013/05/22/honouring-shivananda-duncan-george-khan-obe-june-6-1948-may-20-2013/

[8] https://web.archive.org/web/20171001100805/http://www.boysofbangladesh.org/history_of_e-group.html

[9] www.boysofbangladesh.org, Our History

LLH: Norwegian Organisation for Sexual and Gender Diversity, নরওয়ের প্রথম ও সর্ববৃহৎ এলজিবিটি সংগঠন।

[10] Hossain, Adnan. “Section 377

[11] ইউনিভার্সালা পিরিওডিক জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়।

[12] Sexual Rights Initiative. “Report on Bangladesh–4th Round of the Universal Periodic Review–February 2009.” (2009).

www.boysofbangladesh.org, Our History

[13] https://web.archive.org/web/20130430084114/https://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-08-06/news/84289

[14] The Universal Periodic Review and LGBTI Rights in Bangladesh, 17th October 2013, Alessia Valenza, ILGA Asia

https://web.archive.org/web/20150303033427/https://ilga.org/the-universal-periodic-review-and-lgbti-rights-in-bangladesh/

[15] Bangladesh refuses to abolish criminalisation of consensual same-sex ties,

https://www.dnaindia.com/world/report-bangladesh-refuses-to-abolish-criminalisation-of-consensual-same-sex-ties-1899219

[16] প্রাগুক্ত      

[17] https://www.bracu.ac.bd/news/jpgsph-hosts-round-table-sogi-issues-bangladesh-upr-2013

https://www.bracu.ac.bd/news/roundtable-lgbt-movement

[18] www.boysofbangladesh.org, Our History

[19] https://www.instagram.com/projectdhee/

[20] https://www.thedailystar.net/the-star/human-rights/the-story-dhee-140974

https://www.dw.com/bn/বাংলাদেশে-সমকামী-নারীদের-নিয়ে-কমিক-স্ট্রিপ/g-18697567

[21] https://mzamin.com/article.php?mzamin=107312

[22] ILGA Asia New Board, ২০১৫

https://ilgaasiatw2015.wordpress.com/2015/10/30/ilga-asia-new-board/
https://thequeerness.com/2018/03/25/lgbtq-people-dont-exist-in-a-vacuum-tq-speaks-to-shakhawat-imam-rajeeb/

[23] Hossain, Adnan. 2019. “Roopban.” Pp. 1390–92 in The Global Encyclopedia of Lesbian, Gay, Bisexual, Transgender and Queer History, edited by H. Chiang and A. Arondekar. Farmington Hills, MI: Charles Scribner and Sons.

[24] https://www.thedailystar.net/first-local-magazine-for-gays-launched-7611

https://web.archive.org/web/20140123051238/http://www.dhakatribune.com/arts-amp-culture/2014/jan/20/first-ever-lgbt-magazine-launched

[25] Hossain, Adnan. 2019. “Roopban.”.

[26] https://roopbaan.org/2017/09/23/roopbaan-youth-leadership-program-2015-2016/

[27] https://roopbaan.org/2017/09/23/rb-sns-trans-show-2014/

https://roopbaan.org/2017/09/23/dragonball-2015/