বালির বাঁধ


কোন মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে আমরা ভালো বা খারাপ ঠিক করব? আমরা কি মানদণ্ড হিসেবে নেব প্রচলন, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জাতির ঐতিহ্য অথবা সংস্কৃতিকে? নাকি একটি সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় মানদণ্ড থাকতে হবে?

২০১৬ সালের অ্যামেরিকান নির্বাচনী প্রচারণা ও প্রপাগ্যান্ডার বড় একটা অংশ হয়েছিল অনলাইনে। মূলধারার মিডিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও ট্রাম্প সমর্থকরা এক ধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল এই ইন্টারনেট প্রচারণার কল্যাণে। প্রচারণার অংশ হিসেবে ট্রাম্প সমর্থকরা বানিয়েছিল হিলারি-বিরোধী অনেক ভিডিও। এমনই একটা ভিডিওতে তুলে ধরা হয়েছে সময়ের সাথে সাথে সমকামী বিয়ের ব্যাপারে হিলারির বদলাতে থাকা অবস্থান।

ভিডিও দেখা যাচ্ছে, ২০০৪ এ হিলারি বলেছিল, ‘আমি বিশ্বাস করি বিয়ে হলো (কেবল) নারী ও পুরুষের মধ্যে পবিত্র বন্ধন’।

৬ বছর পর ২০১০ এ, ‘আমি সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে বিয়েকে সমর্থন করিনি, তবে (তাদের মধ্যে) সিভিল পার্টনারশিপ ও কন্ট্র্যাকচুয়াল রিলেশানশিপ সমর্থন করি।’

২০১৩ তে, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং পলিসি হিসেবে গে এবং লেসবিয়ানদের বিয়ে সমর্থন করি।’

আর ২০১৫ তে অ্যামেরিকার সুপ্রিম কোর্ট সমকামী বিয়েকে আইনি বৈধতা দেয়ার পর হিলারি বলেছিল,

হিলারি রাজনীতিবিদ। রাজনীতিবিদদের সাধারণত কোনো নৈতিকতা থাকে না, তবে ভালো ধারণা থাকে সমাজের নৈতিকতার ব্যাপারে। তাই মাত্র ১১ বছরের মধ্যে ‘শুধুই নারী-পুরুষের পবিত্র বন্ধন’ থেকে বিয়ে হয়ে গেছে সমলিঙ্গের ‘প্রেমের বিজয়’। ১১ বছর আগে যেটা অগ্রহণযোগ্য ছিল, এখন সেটা হয়ে গেছে স্বাভাবিক। আর তা বুঝতে পেরে সুর মিলিয়েছে হিলারিও। এটা শুধু ১১ বছরের ব্যাপার না। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে নৈতিকতা, বিশেষ করে যৌনতার ব্যাপারে পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তনের দিকে তাকান। দেখতে পাবেন অবিশ্বাস্য মাত্রার পরিবর্তন।

একই কথা কিছুটা ভিন্নমাত্রায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ছেলেমেয়ে ভার্সিটিতে উঠে প্রেম করবে, একসময় এটাকে খুব খারাপ মনে করা হতো। এখন এটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। প্রেমের এই স্বাভাবিকীকরণের জন্য এক নতুন ধরনের ভাষাও তৈরি করে ফেলেছি আমরা ।

   ‘ভাবি ছেলের বিয়ে দিয়েছেন?’

      ‘জি ভাবি, গত মাসে। ছেলের নিজের পছন্দ ছিল।’

ক্রমাগত বদলাতে থাকা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকে মাপকাঠি হিসেবে নেয়ার এই হলো ফলাফল। সময়ের সাথে বদলাতে থাকা নৈতিকতার কম্পাস বাঁধ দিতে পারে না; বরং হয়ে ওঠে অধঃপতন আর অবক্ষয়ের কারণ। পাবলিক পারসেপশান বদলায়, খুব দ্রুতই বদলায়। এক প্রজন্মের কাছে যা অকল্পনীয়, অন্য প্রজন্মের কাছে তা-ই হয়ে ওঠে স্বাভাবিক। ভবিষ্যতে সমাজ আর কী কী গ্রহণ করে নেবে তা নিয়েও সহজেই পূর্বাভাস করা যায়। কারণ, কোন উৎসগুলো সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করছে সেটা আমাদের জানা। টিভি, হলিউড-বলিউড, শিল্প, সাহিত্য, গ্লোবাল সেলিব্রিটিদের নিয়ে গসিপ–এগুলোর মাধ্যমে ক্রমাগত আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট, হাইপার-লিবারেল, প্রায় কামুক দৃষ্টিভঙ্গি। বিনোদন মনে করে এগুলোকে নিত্যদিনের অপরিহার্য অংশ বানিয়ে নিচ্ছি আমরা। বিনোদনের জগৎ থেকে শেখা ‘নৈতিকতা’কে নিয়ে আসছি বাস্তবে। এ প্রভাবকে অ্যামপ্লিফাই করছে সোশ্যাল মিডিয়া, একজনের একান্ত অসুখ পরিণত হচ্ছে মহামারিতে।

এ প্রচণ্ড ও সর্বব্যাপী সাংস্কৃতিক ও নৈতিক আগ্রাসনের মোকাবেলায় আমাদের জবাব যদি হয় ‘সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা’, ‘সমাজবাস্তবতা’ আর ‘আমাদের সমাজে এসব মানায় না’–তাহলে এ স্রোতে বাঁধ দেয়ার আশা এখনই ছেড়ে দেয়া উচিত। এ যুক্তিগুলো দিয়ে টেকা যাবে না। বরং আপনার যুক্তিই একদিন আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বাধ্য করবে এ অসভ্যতাকে মেনে নিতে। মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। সমাজ বদলায়, গ্রহণযোগ্যতার সংজ্ঞা বদলায়, বদলায় অধিকাংশের মত। ইসলামের বদলে সামাজিকতা, গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহ্যকে মানদণ্ড হিসেবে নিলে পশ্চিম থেকে আমাদের দিকে ছুটে আসা প্রচণ্ড ও সর্বব্যাপী নৈতিক অধঃপতনের স্রোতের মোকাবেলা করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।

২.

দীর্ঘদিন ধরে নির্দিষ্ট কিছু ধ্যানধারণা, আদর্শ সাধারণ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বৈশ্বিক মিডিয়া। মিডিয়া খুব ধীরে ধীরে, নিয়ম করে কাজটা করে–তাই ব্যাপারটা সব সময় হয়তো আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। ক্রমশ একটি নির্দিষ্ট বয়ানকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা, একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বা জনগোষ্ঠীকে ‘অপর’ কিংবা ‘দানব’ আকারে চিত্রিত করা, কোনো অস্বাভাবিক আচরণ বা বিকৃতিকে স্বাভাবিক করে তোলার কাজে মিডিয়ার অত্যন্ত পারদর্শী। দীর্ঘদিন ধরেই সোশ্যাল এঞ্জিনিয়ারিং এবং জনমত নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হলো মিডিয়া। এর একটি কারণ হলো সাধারণ মানুষের জন্য মিডিয়া কাজ করে তথ্যের উৎস হিসেবে। যার কারণে কিছু তথ্য চেপে রেখে বা বদলে দিয়ে মিডিয়া ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যেকোনো বিষয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তাকে। আরেকটি কারণ হল, মিডিয়া বিভিন্নভাবে মানুষের সামনে ট্রেন্ডসেটারের ভূমিকা পালন করে। পোশাক, বই, সিনেমা, গ্যাজেট থেকে শুরু করে আদর্শ পর্যন্ত–বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মিডিয়াই মানুষকে জানিয়ে দেয় কোনটা ‘হিপ অ্যান্ড ট্রেন্ডি’ আর কোনটা সেকেলে। এভাবে খুব সহজে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রচার করতে পারে মিডিয়া। পারে অন্ধকারকে আলো আর আলোকে অন্ধকার হিসেবে উপস্থাপন করতে।

গত এক শতাব্দীজুড়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জনমত, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মূল্যবোধ পরিবর্তনের এ কাজগুলো করে আসছে ম্যাস মিডিয়া। আধুনিক প্রপাগ্যান্ডার জনক এবং আনসাং হিরো (বা অ্যান্টিহিরো) এডওয়ার্ড বারনেইস তার বই ‘প্রপাগ্যান্ডা’-তে মিডিয়ার মাধ্যমে সোশ্যাল এঞ্জিনিয়ারিং-এর ধাপগুলো তুলে ধরেছেন খুব সহজবোধ্য ও খোলামেলাভাবে। দশকের পর দশক ধরে সফলতার সাথে বাস্তবায়িত হচ্ছে সেই ধাপগুলো।

একটা বাস্তব উদাহরণ দেয়া যাক।

প্রায় বছর খানেক আগে জনপ্রিয় মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম TEDxTalk এর একটি পর্বে মিরজাম হেইন নামে একজন জার্মান মেডিক্যাল ছাত্রী বলে, পেডোফিলিয়া বা শিশুকাম একটি অপরিবর্তনীয় যৌনপ্রবৃত্তি (unchangeable sexual orientation)। একজন নারী ও পুরুষের পারস্পরিক যৌনকামনা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি কিছু মানুষ শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে–এটাও স্বাভাবিক। এই তাড়না, এই আকর্ষণবোধের কারণে শিশুকামীদের দোষারোপ করা উচিত না।[1] ভিডিওটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় এবং তুমুল বিরোধিতার কারণে TEDxTalk বাধ্য হয় তাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে ভিডিওটি সরিয়ে নিতে।

মজার ব্যাপারটা হলো হেইন এটাও বলেছে যে, এ ধরনের যৌনতাড়না স্বাভাবিক হলেও এর বাস্তবায়ন অপরাধ ও অনৈতিক। অর্থাৎ শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু এই কামনা বাস্তবায়িত করা অস্বাভাবিক, এই আকর্ষণের ওপর কাজ করা অপরাধ।

এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে নৈতিকতার মানদণ্ডের ব্যাপারে আমাদের আলোচনা।

শিশুকাম যদি নারী-পুরুষের পারস্পরিক শারীরিক আকর্ষণের মতোই স্বাভাবিক এবং অপরিবর্তনীয় বিষয় হয়, তাহলে এই আকর্ষণের ওপর আমল করা কেন অপরাধ হবে?

কারণ, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যখন কোনো শিশুর সাথে যৌনতায় লিপ্ত হয় তখন ব্যাপারটা দুজনের সম্মতিতে হয় না। এটা অপরাধ কারণ এখানে পারস্পরিক সম্মতি (Consent) থাকছে না। একই কারণে পশুকামও অপরাধ, কারণ এ ক্ষেত্রেও সম্মতি একপাক্ষিক। পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যৌনকর্ম হচ্ছে না।

হেইনের উত্তর।

যদিও পশ্চিমের অনেকেই এখন শিশুকামের ব্যাপারে তার এ অবস্থানের বিরোধিতা করছে, কিন্তু যৌনতার ব্যাপারে আধুনিক পশ্চিমের ধারণা অনুযায়ী হেইনের এ উত্তর সঠিক। চিন্তা করে দেখুন, বিবাহ-বহির্ভূত সেক্স (যিনা), সমকামিতা, উভকামিতা, সুইঙ্গার সেক্স, হুকআপ কালচার (বহুগামিতা), গ্রুপসেক্সের মতো যৌনবিকৃতিগুলোর পক্ষে উদারনৈতিক পশ্চিমের ডিফেন্স কী?

   ‘আমরা তো কারও ক্ষতি করছি না!’

   ‘যতক্ষণ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিয়ে কিছু করছি, ততক্ষণ কী সমস্যা?’

   ‘ভালোবাসা কোনো বাধা, কোনো সীমানা মানে না।’

   ‘দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যা ইচ্ছে করার স্বাধীনতা আছে এবং এতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারও নেই।’

   ‘আমার এ ব্যাপারটা (যেকোনো যৌনবিকৃতি) জন্মগত।’

মূলত বিভিন্ন আঙ্গিকে বেশ কয়েক দশক ধরে এ ধরনের উত্তরই শুনে আসছি আমরা। সুতরাং শিশুকামের ব্যাপারে মিরজাম হেইন যা বলেছে তা পুরোপুরিভাবে পশ্চিমের এ দৃষ্টিভঙ্গি, এ মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন–এ মানদণ্ডে সমস্যা কোথায়? হ্যাঁ, এটা ইসলামের নৈতিকতার সাথে যায় না, কিন্তু পারস্পরিক সম্মতির শর্ত দিয়ে তো কমসেকম শিশুকামিতা ও পশুকামিতার মতো ব্যাপারগুলো আটকানো যাচ্ছে, এটাই বা কম কিসে?

সমস্যা হলো, এ শর্ত দিয়ে শিশুকামিতাকে আসলে আটকানো যায় না। কেন যায় না, ব্যাখ্যা করছি।

দেখুন বলা হচ্ছে–শিশুর সাথে সেক্স অপরাধ এবং অনৈতিক কাজ, কারণ এখানে উভয়পক্ষের পারস্পরিক সম্মতি (consent) নেই। প্রশ্ন হলো, পারস্পরিক সম্মতি নেই কেন?

কারণ, একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে, বয়ঃপ্রাপ্ত হবার আগে শিশুর মধ্য যৌনতার ধারণা থাকে না। যে শিশুর মধ্যে যৌনতার ধারণা, নিজের যৌনতা সম্পর্কে সচেতনতা নেই তার পক্ষে অবশ্যই কোনো যৌনকর্মে সম্মতি দেয়া সম্ভব না। শিশুর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বা সম্মতি জানানোর ক্ষমতা (agency) থাকে না। কাজেই শিশুর সাথে সেক্স আবশ্যিকভাবেই হচ্ছে সম্মতি ছাড়া, তাই এটি একটি অনৈতিক ও অপরাধ। যেমন একজন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া যৌনকর্ম করা অপরাধ।

রাইট?

রং।

এ পুরো যুক্তির ভিত্তি হলো Consent–সম্মতি। যদি আমি প্রমাণ করতে পারি যে শিশুর যৌনতার ব্যাপারে সম্মতি দেয়ার মতো পরিপক্বতা বা ম্যাচিউরিটি আছে, তাহলে কি এ যুক্তি আর টিকবে? মজার ব্যাপারটা হলো, শিশুরাও যে ‘যৌনতা সম্পর্কে সচেতন’ এটা এরই মধ্যে পশ্চিমা অ্যাকাডেমিয়া এবং মিডিয়ায় সুপ্রতিষ্ঠিত একটি বিষয়; যদিও এখনো বিষয়টা ঠিক ওভাবে আলোচনা করা হচ্ছে না।

সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই পশ্চিমা মনোবিজ্ঞানের অবস্থান হলো শিশুরা জন্ম থেকেই যৌনতা সম্পর্কে সচেতন। যৌনতা সম্পর্কে আধুনিক সেক্সোলজির জনক ড. অ্যালফ্রেড কিনসি এবং আরেক মহারথী ড. জন মানির অবস্থানের দিকে তাকালেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়। এ দুজনের অবস্থানের সারসংক্ষেপ হল :

১) জন্মের পর থেকেই শিশুরা যৌনতা সম্পর্কে সচেতন, যৌনতায় সক্রিয় এবং যৌনসুখ অর্জনে সক্ষম। জন্মের পর থেকেই একজন শিশুর মধ্যে যৌনতার ধারণা ও বোধ থাকে।[2] এ কারণেই শিশুকাম বা অজাচার অস্বাভাবিক কিছু না।

২) প্রতিটি মানুষ সর্বকামী (pansexual/omnisexual) হিসেবে জীবন শুরু করে। তারপর সে কোনো এক বা একাধিক ধরনের যৌনাচারকে বেছে নেয়। এটি জন্মের সময় নির্ধারিত বা প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত না। প্রাকৃতিকভাবে যৌনতা নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ না, এ কেবলই একটি সামাজিক প্রচলন।

৩) মূলত সব ধরনের যৌনতাই স্বাভাবিক। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন যৌনতার ব্যাপারে আমাদের ধারণা বদলায়। আমাদের সামাজিক চিন্তার কারণে আমরা কিছু যৌনাচারকে স্বাভাবিক আর কিছু যৌনাচারকে অস্বাভাবিক মনে করি।[3]

কিনসি এবং মানির কিছু উদ্ধৃতি দেখা যেতে পারে।

Sexual Behavior In The Human Female বইতে কিনসি বলেছিল,

‘সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বেড়াজাল ছাড়া অন্য কোন কারণে নিজের জননাঙ্গে অন্যের স্পর্শ কিংবা অন্যের জননেন্দ্রিয় দেখা, কিংবা আরও নির্দিষ্ট কোন যৌনসম্পর্ক শিশুকে কেন বিচলিত করবে তা বোঝা মুশকিল।’[4]

অন্যদিকে Development of paraphilia in childhood and adolescence প্রবন্ধে মিরজাম হেইনের মতো হুবহু একই কথা বলেছিল জন মানি,

‘শিশুকাম স্বেচ্ছায় বেছে নেয়া না, আর ইচ্ছে করলেই একজন শিশুকামী একে ছেড়ে আসতে পারে না। শিশুকামীতা যৌনতার ব্যাপারে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বা অনুরক্তি বা; বরং এটি যৌন-মনস্তাত্ত্বিক গঠন। একজন মানুষের শিশুকামী হওয়া বাঁ-হাতি বা কালার ব্লাইন্ড হবার মতো (অর্থাৎ বিষয়টি তার সিদ্ধান্ত এবং ইচ্ছার ঊর্ধ্বে)[5]

যদি কিনসি আর জন মানির দেয়া যৌনতার ধারণা গ্রহণ করা হয়–যদি মানব যৌনতার ব্যাপারে আধুনিক পশ্চিমা চিন্তার মূলনীতিগুলো মেনে নেয়া হয়–তাহলে আর এ যুক্তি দেয়া যায় না যে, শিশুকাম একটি অপরাধ কারণ শিশুদের পক্ষে যৌনকর্মে সম্মতি দেয়া সম্ভব না। যদি কেউ যৌনতা সম্পর্কে সচেতন হয়, যৌনসুখ অর্জনে সক্ষম হয় এবং সক্রিয়ভাবে যৌনকর্মে অংশগ্রহণ করতে পারে, তাহলে সে সম্মতি কেন দিতে পারবে না?

ঠিক এ যুক্তিই সত্তরের দশক থেকে ব্যবহার করে আসছে শিশুকামের পক্ষে প্রচারণা চালানো অ্যামেরিকান ও ইউরোপিয়ান বিভিন্ন সংস্থা।[6] কাজেই মিরজাম হেইন যা-ই বলুক না কেন, (অপ) বিজ্ঞানের অফিশিয়াল ভাষ্য অনুযায়ী শিশুরা সম্মতি (consent) দিতে সক্ষম। শিশুকামীদের ‘স্বাভাবিক’ যৌনতাড়না বাস্তবায়নে পশ্চিমা তত্ত্ব মতে কোনো বাধা নেই।

৩.

এ তো গেল অ্যাকাডেমিয়ার কথা। সাধারণ মানুষের কী অবস্থা? অ্যাকাডেমিকদের তত্ত্বকথার কচকচির সাথে অধিকাংশ সময় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের তেমন কোনো সম্পর্ক থাকে না। এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা কি এ রকম? সাধারণ মানুষও কি মনে করছে, একজন শিশু যৌনতা সম্পর্কে সচেতন? নিজের যৌনতা সম্পর্কে সে সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম?

হ্যাঁ, সাধারণ মানুষও আজ এমন মনে করতে শুরু করেছে। কিংবা বলা ভালো তাদের মনে করানো হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য পুরোদমে কাজ করছে মিডিয়া, শিক্ষাব্যবস্থা, পশ্চিমা সরকার এবং বৈশ্বিক সংগঠনগুলো (ইউএন, WHO ইত্যাদি)। ব্যাপারটা সম্ভবত আপনারও চোখে পড়েছে, তবে সম্পর্কটা হয়তো আপনি ধরতে পারেননি।

গত কয়েক বছরের অল্প কিছু শিরোনাম মনে করিয়ে দিই–

‘ব্রিটেনের প্রথম জেন্ডার ফ্লুয়িড পরিবার : বাবা নিজেকে নারীতে পরিণত করছে, মা নিজেকে মনে করে পুরুষ, আর ছেলে বড় হচ্ছে জেন্ডার নিউট্রাল হিসেবে।’[1]

নিউ ইয়র্কে আইনি ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ৩১টি লৈঙ্গিক পরিচয়কে (Gender Identity)।[2]

ব্রিটিশ ডিপার্টমেন্ট স্টোর জন লুইস ঘোষণা করেছে, এখন থেকে তারা আর বাচ্চাদের পোশাক ‘ছেলে’ বা ‘মেয়ে’ ট্যাগ দিয়ে আলাদা করবে না। এখন থেকে তারা বাচ্চাদের জন্য শুধু বিক্রি করবে ‘Unisex’/‘Gender Neutral’ পোশাক।[3]

২০১৭ এর মার্চে মানুষের মৌলিক পরিচয় ও যৌনতার পরিবর্তনশীল সংজ্ঞার এ যুগ নিয়ে কাভার স্টোরি করে টাইম ম্যাগাযিন। ‘Beyond ‘He’ or ‘She’: The Changing Meaning of Gender and Sexuality’ শিরোনামের এ লেখায় সমকামী অধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ GLAAD এর একটি জরিপের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, অ্যামেরিকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ তরুণ এখন আর নিজেদের সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক যৌনাচারে আকৃষ্ট (Heterosexual) অথবা সম্পূর্ণভাবে সমকামিতায় আকৃষ্ট মনে করে না। বরং ‘মাঝামাঝি কিছু একটাকে’ বেছে নেয়। একইভাবে অ্যামেরিকান তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ এখন আর নিজেদের ‘পুরুষ’ বা ‘নারী’ হিসেবে পরিচয় দেয় না।[4]

কিছুদিন আগে তাদের সাপ্তাহিক সাপ্লিমেন্ট ‘Lifestyle’ এ ট্র্যান্সজেন্ডার আন্দোলনের পেছনের ধারণাগুলোকে সমর্থন করে প্রচ্ছদ কাহিনি করেছে বাংলাদেশের ডেইলি স্টার[5]

নার্সারির বাচ্চাদের জেন্ডার ফ্লুয়িডিটির ব্যাপারে ক্লাস নিচ্ছে ড্র্যাগ কুইনরা।[6]

ব্রিটেনে প্রতি সপ্তাহে ৫০ জন শিশুকে Gender Dysphoria ও Gender Change সংক্রান্ত ক্লিনিকে পাঠানো হচ্ছে, যার মধ্যে আছে ৪ বছর বয়সী শিশুও। বাড়ছে শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ পরিবর্তন অপারেশন।[7]

একটা ছাড়া ওপরের সবগুলো খবর ২০১৭ এর। মাঝের সময়টুকুতে যুক্ত হয়েছে আরও অসংখ্য এমন গল্প। সারা বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে সমকামী আন্দোলনের ধাঁচে গড়ে ওঠা ট্র্যান্সজেন্ডার আন্দোলন ও এর দর্শন।

সংক্ষেপে ট্র্যান্সজেন্ডার আন্দোলনেরর মূল কথা হলো–ধরাবাঁধা কোনো যৌনতা ও লৈঙ্গিক পরিচয় মানুষের নেই। এ ব্যাপারটা একটা স্পেক্ট্রাম, একটা রংধনুর মতো (হ্যাঁ, এই জন্যই রংধুন সিম্বল ব্যবহার করা হয়)। কোনো কিছু সাদাকালো না। এখানে আছে অনেক, অনেক রং। যেকোনো মানুষ বা শিশু যদি একজন নারী, পুরুষ বা অন্য কোনো ‘কিছু’ হিসেবে পরিচিত হতে চায়, তবে তা-ই মেনে নিতে হবে। শারীরিকভাবে, জন্মসূত্রে সে যা-ই হোক না কেন!

লক্ষণীয় বিষয় হলো, এখানে সত্যিকারের ইন্টারসেক্স বা ট্রু হারমাফ্রোডাইটের (‘হিজড়া’) কথা বলা হচ্ছে না। জনসংখ্যার মাত্র 0.018% True intersex হয়ে থাকে।[8] অর্থাৎ এমন মানুষ সংখ্যায় খুবই কম। মানুষের লৈঙ্গিক পরিচয় যে বাইনারি এটার প্রমাণ পৃথিবীর বাকি ৯৯.৯82% মানুষ। কিন্তু আধুনিক সময়ের অতি-আধুনিক মানুষের মধ্যে কারও কারও হঠাৎ করে মনে হলো মানুষের পরিচয়ের ব্যাপারে এই ‘পুরোনো চিন্তা’-কে ভেঙে নতুন এক চিন্তার কাঠামো তৈরি করা দরকার। তারা বলা শুরু করল, লৈঙ্গিক পরিচয় প্রাকৃতিকভাবে নির্ধারিত কিছু না। মানুষ তার সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ঐতিহ্যে ইত্যাদির কারণে প্রভাবিত হয়ে নিজেকে চিহ্নিত করে পুরুষ অথবা নারী হিসেবে। এটা নিজের বেছে নেয়ার ব্যাপার, পূর্বনির্ধারিত কিছু না। তাই এমন হতে পারে যে, একজন মানুষ শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু তার ভেতরের ‘সত্তাটি’ নারীর। অথবা একজন মানুষ শারীরিকভাবে নারী কিন্তু তাদের ভেতরে পুরুষ সত্তার বসবাস। যখন এমনটা ঘটে তখন একে বলা হয় Gender Dysphoria এবং এমন মানুষকে বলা হয় Transgender। আবার এমনও হতে পারে যে, একজন মানুষ শারীরিকভাবে যা-ই হোক না কেন একেক সময় সে নিজেকে নারী চিহ্নিত করে, আর অন্য সময় পুরুষ হিসেবে। তার কোনো নির্দিষ্ট gender বা লৈঙ্গিক পরিচয় নেই, সে Gender Neutral বা Gender Fluid।

ট্র্যান্সজেন্ডার মুভমেন্ট এখন পশ্চিমে পরিণত হয়েছে ট্র্যান্সজেন্ডার উন্মাদনায়–মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী চার বছর বয়সী শিশুদেরও এখন নাকি ‘মনে হচ্ছে’ তারা ভুল দেহে জন্ম নিয়েছে। এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ফ্রিতে এমন সব ওষুধ দিচ্ছে যেগুলো তাদের স্বাভাবিক বয়ঃসন্ধিকে বিলম্বিত বা বন্ধ করবে।[9]

কিন্তু ট্র্যান্সজেন্ডার উন্মাদনার সাথে আপেক্ষিক নৈতিকতা আর শিশুকামের সম্পর্ক কী?

সম্পর্ক আছে।

দেখুন, ট্র্যান্সজেন্ডার আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একেবারে শিশুরাও ট্র্যান্সজেন্ডার হতে পারে। শৈশব থেকেই নিজেদের মধ্যে তারা অনুভব করতে পারে ভিন্ন যৌন পরিচয়, ভিন্ন সত্তা। বয়সের কোনো লিমিট এখানে নেই। দু-বছর বয়স থেকেই স্কুলে রীতিমতো ক্লাস নিয়ে বাচ্চাদের এগুলো শেখানো শুরু হয়েছে। চার বছরের বাচ্চা বিশ্বাস করছে তার লিঙ্গ পরিবর্তন সার্জারি করা দরকার। এই পুরো ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত আমাদের ঠেলে দিচ্ছে শিশুদের যৌন-জীব (sexual being) হিসেবে মেনে নেয়ার দিকে। অর্থাৎ কিনসি এবং মানির এই উপসংহারের দিকে–জন্মের পর থেকেই শিশুরা যৌনতা সম্পর্কে সচেতন, যৌনতায় সক্রিয় এবং যৌনসুখ অর্জনে সক্ষম। জন্মের পর থেকেই একজন শিশুর মধ্যে যৌনতার ধারণা ও বোধ বিদ্যমান থাকে

এর বাস্তব উদাহরণও দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দশ ও আট বছর বয়সী দুটো ছেলেকে নিয়ে বেশ শোরগোল হচ্ছে অ্যামেরিকান মিডিয়ায়। ছেলে দুটো দাবি করছে ২ এবং ৩ বছর বয়সে স্বাভাবিক শারীরিক পরিচয়ের বাইরে ওরা নিজেদের মধ্যে আবিষ্কার করেছে অন্য এক ‘সত্তা’। সেই থেকে স্বেচ্ছায় ওরা ‘ড্র্যাগ’ করে আসছে।[10] ড্র্যাগ (Drag) হলো পশ্চিমা সমকামীদের একটি সাবকালচার, যেখানে নারীদের পোশাক চাপিয়ে ও মেইকআপ করে সমকামী পুরুষরা অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন ধরনের যৌন উত্তেজক স্টেইজ শো, নাচ, গান ইত্যাদিতে । কাজটা যখন সমকামী পুরুষরা করে তখন তাদের বলা হয় ‘ড্র্যাগ কুইন’। ‘ড্র্যাগ কিং’ এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। সমকামী নারীরা পুরুষের মতো ড্রেসআপ ও মেইকআপ করে। এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলো স্বভাবতই চরমমাত্রায় যৌনায়িত হয়, এবং বেশির ভাগ সময় এগুলো হয় সমকামীদের বিভিন্ন ক্লাব ও বারে। ছেলে দুটোর মধ্যে একজন এরই মধ্যে সমকামীদের বারে নেচে টিপসও জোগাড় করে ফেলেছে।[11]

আসুন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিন্দুগুলো এবার মেলানো যাক। পুরো ব্যাপারটা একটু ধাপে ধাপে চিন্তা করুন–

ট্রান্সজেন্ডার উন্মাদনার কারণে ৪ বছরের বাচ্চা লিঙ্গ পরিবর্তনের অপারেশন করতে চাচ্ছে। দুই বছরের বাচ্চা পর্যন্ত ‘সন্দেহে ভুগছে’ তার যৌনতা ও লৈঙ্গিক পরিচয় নিয়ে। ১০ বছর বয়সী ছেলেরা বলছে ২/৩ বছর বয়েস থেকেই তারা নিজেদের মধ্যে ভিন্ন ‘সত্তা’ অনুভব করছে, এবং যৌন উত্তেজক নাচানাচি শুরু করছে আটকা পড়া সত্তাকে মুক্ত করার জন্যে। এই পুরো ডিলিউশান ও উন্মাদনাকে সমর্থন করছে অভিভাবক, সমাজ, রাষ্ট্র ও মিডিয়া। জীবনকে আমূল বদলে দেয়া বিভিন্ন মেডিক্যাল প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে এই বাচ্চাদের ‘অনুভূতির’ ওপর ভিত্তি করে। সিদ্ধান্তগুলোর সাথে যৌনতার ব্যাপারটা জড়িত ওতপ্রোতভাবে। এ সবকিছুর মাধ্যমে বুঝে কিংবা না বুঝে আমরা মেনে নিচ্ছি যে শিশুরাও যৌন-জীব (sexual being), তারাও যৌনতা সম্পর্কে সচেতন। ৮ বছর বয়সী একটা ছেলে যখন বলে সে চরম যৌনায়িত সমকামী সাবকালচারের মাঝে নিজের প্রকৃত সত্তাকে খুঁজে পায়, অথবা সে পুরুষের দেহে আটকে পড়া একজন নারী–এবং আমরা সেটা মেনে নিই, তখন আমরা মূলত এটাই মেনে নিচ্ছি যে, নিজের যৌনতা ও শরীরের ব্যাপারে এ সিদ্ধান্তগুলো দেয়ার মতো পরিপক্বতা তার মধ্যে এসেছে। অর্থাৎ এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার মাধ্যমে আমরা মেনে নিচ্ছি এ বয়সী একটা বাচ্চার সম্মতি দেয়ার–consent করার–সক্ষমতা আছে।

‘যে মানুষ নিজের পুরো শরীরকে বদলে ফেলার ব্যাপারে, নিজের লিঙ্গ বদলে ফেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারে, কার সাথে শোবে সেই ব্যাপারে সে সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না?’

একজন শিশুকামী যদি ওপরের প্রশ্নটা করে, কী জবাব দেবেন? যদি যৌনতা এবং যৌনবিকৃতির ব্যাপারে পশ্চিমা চিন্তার মূল কাঠামোকে মেনে নেয়া হয়, যদি একটা শিশু তার লিঙ্গ পরিবর্তনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে এটাও মানতে হবে যে এই শিশু সম্মতি দিতে পারে যৌনকর্মের ব্যাপারেও। কাজেই যে যুক্তি দিয়ে মিরজাম হেইন এবং অন্যান্য আরও অনেকে শিশুকামী তাড়নার বাস্তবায়নকে অনৈতিক ও অপরাধ বলছেন, তা আসলে ধোপে টেকে না। ট্র্যান্সজেন্ডার উন্মাদনা আমাদের শেখাচ্ছে শিশুরাও যৌনতার ব্যাপারে সচেতন, সক্রিয় ও সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম।

আর ঠিক এভাবেই, এ যুক্তিতেই যৌনতার ব্যাপারে আধুনিক পশ্চিমা দর্শন–যা আমরা আধুনিকতার নামে গদগদ হয়ে গ্রহণ করেছি–একসময় বৈধতা দেবে শিশুকামিতাকে।

ঠিক দু-দশক আগে যেভাবে সমকামিতার স্বাভাবিকীকরণ ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়েছিল, বর্তমানে ঠিক একই কাজ করা হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার রাইটস’ এর নামে। এরই মধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত একে বৈধতা দেয়ার তাত্ত্বিক এবং রেটোরিকাল কাঠামো। এখন শুধু প্রয়োজন নিয়মিত কিছু আবেগঘন সাহিত্য, সিরিয়াল, সিনেমা আর দেশে দেশে হাই-প্রোফাইল কিছু শিশু ট্র্যান্সজেন্ডার সেলিব্রিটি।

‘যৌনতা, ব্যক্তিপরিচয়–এসব আপেক্ষিক। ব্যক্তির স্বাধীন সিদ্ধান্তের বিষয়। একজন মানুষ ভেতরে কেমন তা-ই মুখ্য। সামাজিক প্রথা আর পশ্চাৎপদতার কারণে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা উচিত না। যখন কারও ক্ষতি হচ্ছে না তখন বিরোধিতা কেন?’

এমন সব যুক্তির মাধ্যমে চেষ্টা চলছে এই বিকৃতি ও অসুস্থতাকে স্বাভাবিক ও নির্দোষ হিসেবে উপস্থাপনের। একবার এই বিকৃতি গৃহীত হবার পর একই যুক্তি ব্যবহার করে বৈধতা দেয়া হবে শিশুকামের। আমার কথাটা স্মৃতিতে মজুদ করে রাখতে পারেন, বছর দশেক পর মিলিয়ে নেবেন।

মজার ব্যাপার হলো, ট্র্যান্সজেন্ডার মুভমেন্টের পক্ষে দেয়া যুক্তিগুলো দিয়ে খুব সহজে সমকামিতার পক্ষে দেয়া যুক্তিগুলো খণ্ডন করা যায়। সমকামিতার পক্ষে বহুল ব্যবহৃত একটি যুক্তি হলো মানুষ জন্মগতভাবেই সমকামী হয় (‘born this way’)। আবার অনেকে বলার চেষ্টা করে একটি বিশেষ জিন (the gay gene) এর কারণে কিছু মানুষ সমকামী হয়ে জন্মায়। অর্থাৎ তারা দাবি করে সমকামীদের যৌনতা নির্ধারিত বায়োলজি দ্বারা। আবার দেখুন ট্র্যান্সজেন্ডার উন্মাদনার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে যৌনতা, লৈঙ্গিক পরিচয় এসব পরিবর্তনশীল। কোনো কিছুই পাথরে লেখা না। নারী হয়ে জন্মানো মানুষ একসময় পুরুষ হতে পারে, যে নারীদের প্রতি আকর্ষণ বোধ করত, একসময় সে আকর্ষণ বোধ করতে পারে পুরুষের প্রতি। এগুলো খুবই স্বাভাবিক।

যদি আসলেই তা-ই হয়, তাহলে নিশ্চয় সমকামিতাও জন্মগত হতে পারে না। জন্মগত লিঙ্গ আর যৌনতাকেই যদি অস্বীকার করা হয়, তাহলে আর জন্মগত সমকামিতা বলে কী থাকে? ঠিক একইভাবে ‘সমকামী জিন’ বলেও কোনোকিছু থাকতে পারে না। কারণ, ট্র্যান্সজেন্ডার আন্দোলনের পক্ষে দেয়া যুক্তি অনুযায়ী সমকামিতা, উভকামিতা, পশুকামিতা, কিংবা নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যৌনতা–কোনো কিছুই জিনগত না, বায়োলজিকালি নির্ধারিত না। এগুলো সবই বদলাতে পারে। যার অর্থ একজন সমকামী, একসময় বের হয়ে আসতে পারে সমকামিতা থেকে। আর এটা যদি সাধারণভাবে ঘটতে পারে, তাহলে নিশ্চয় চিকিৎসার মাধ্যমেও কাউকে সমকামিতা থেকে বের করে আনা সম্ভব। অর্থাৎ ট্র্যান্সজেন্ডার উন্মাদনার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সমকামিতার পক্ষে চালানো নিজেদের প্রপাগ্যান্ডাকেই খণ্ডন করে বসে আছে মিলিট্যান্ট সেক্যুলারিযম। তাদের এক কথা আরেক কথার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। অসংলগ্ন ধ্যানধারণা ও মতাদর্শের মধ্যে এ প্যাটার্নটা বারবার দেখা যায়।

এই অর্থহীন যৌন-মানসিক বিকৃতির জট ইসলামের আলোতে খোলা খুব সোজা। আমরা জানি, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ফিতরাহর (natural disposition) ওপর। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ। সমকামিতা জন্মগত না, স্বাভাবিকও না; বরং একটি যৌন-মানসিক বিকৃতি। জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে প্রতিটি মানুষ বয়ঃপ্রাপ্ত (বালেগ) হয় এবং তখন থেকে সে অর্জন করে যৌনতায় সক্রিয় হবার সক্ষমতা। অঞ্চল, আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে এই বয়সের মধ্যে কিছু পার্থক্য হয়; কিন্তু কোনো শিশুই যৌন-জীব হিসেবে জন্ম নেয় না। একইভাবে আমরা জানি আল্লাহ ভুল করেন না। কাজেই ভুল করে, ছেলের দেহে মেয়ে বা মেয়ের দেহে ছেলে আটকা পড়েছে–এ ধরনের কোনো কিছু হওয়া সম্ভব না। হয় এটা মানসিক রোগ, বিকৃতি, বাহ্যিক কোনো ফ্যাক্টরের প্রভাব (শৈশবের যৌন-মানসিক নিপীড়ন, শক, ট্রমা ইত্যাদি) অথবা সিহর বা জ্বিন শায়াত্বিনের প্রভাব। আর যারা সত্যিকার অর্থে শারীরিকভাবে ইন্টারসেক্স (মোট জনসংখ্যার ০.০১৮%), তাদের হুকুম হাদিস থেকে স্পষ্ট এবং এটা তাদের জন্য একটি পরীক্ষা। কিন্তু যখনই আপনি পরম মানদণ্ডকে ছেড়ে আপেক্ষিকতার গলিতে ঢুকে পড়বেন, কোনো কূলকিনারা পাবেন না।

আপেক্ষিক নৈতিকতা আর সামাজিকতাকে নৈতিকতার মানদণ্ড হিসেবে নেয়ার অনেক নেতিবাচক ফলাফলের মধ্যে একটা হলো পশ্চিমের আজকের এই যৌন অবক্ষয়। সমকামিতা, ট্র্যান্সজেন্ডার আর শিশুকামিতা নিয়ে উন্মাদনা। যৌনতা এবং যৌনবিকৃতি এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে শক্তিশালী, কারণ এ বিষয়গুলো সহজাতভাবে মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলে; কিন্তু একই ধরনের বিশৃঙ্খলা বিদ্যমান পশ্চিমা চিন্তা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অন্যান্য ক্ষেত্রেও। পশ্চিমা সভ্যতা তাদের উৎকর্ষের চরমে পৌঁছানোর পর এখন আছে অবক্ষয় আর অধঃপতনের পর্যায়ে। প্রত্যেক সভ্যতার এই পর্যায়ে দেখা দেয় নানান ধরনের যৌনবিকৃতি ও সীমালঙ্ঘন। লেইট স্টেইজ ডেকাডেন্স। পশ্চিম এখন ঠিক এ অবস্থায় আছে। অল্প হলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা বুঝতেও শুরু করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা মুসলিমরা এখনো অনিমেষ চোখে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছি পচতে শুরু করা অতিকায় এই কাঠামোর দিকে। অথচ সত্যিকারের দিকনির্দেশনা, সত্যিকারের পরশপাথর, পরম মানদণ্ড আল ফুরকানকে হাতের কাছে অবহেলা ভরে ফেলে রেখে আজও স্বপ্ন দেখছি তাদের অনুকরণে নিজেদের উন্নতির।

কী বিচিত্র ইচ্ছা-অন্ধত্ব! কী অদ্ভুত আত্মঘৃণা!

~

চিন্তাপরাধ বই থেকে


[1] Britain’s FIRST gender fluid family: Father who’s transitioning to be a woman and mother who identifies as male and female are raising their son, not to get ‘hung up’ on being a boy, Mail Online, August 13, 2017

[2] Gender Id Card 2015, https://on.nyc.gov/2lIqAkf

[3] Childrenswear Goes Genderless At John Lewis, Vogue, September 4, 2017

[4] Beyond ‘He’ or ‘She’: The Changing Meaning of Gender and Sexuality, Katy Steinmetz, Mar 16, 2017

[5] Androgyny In A Fair World, Lifestyle, The Daily Star, August 8, 2017

[6] Drag queens sent to nursery schools to teach kids as young as two about ‘gender diversity’, The Sun, November 12, 2017

[7] ‘Some are confused, others are trapped in the wrong body’: Astonishing 50 kids a week referred to sex change clinics, Mirror Online, October 22, 2017

[8] How common is intersex? a response to Anne Fausto-Sterling, Sax L (2002)

[9] Puberty blockers may improve the mental health of transgender adolescents, PBS News Hour, Aug 20, 2016,

Schools rushing ‘on whisper’ to label pupils as transgender, The Sunday Times, January 21, 2018

[10] ‘ডেযমন্ড’ – You will love ‘Drag Kid’ Desmond. Fiercely, https://www.youtube.com/watch?v=Qk0WA3VlFfA

‘ল্যাকট্যাশিয়া’ – Meet the 8-Year-Old Boy Who Transforms Into a Drag Queen Named Lactatiahttps://www.youtube.com/watch?v=bdCXxUxI-WE

[11] 11 Year old boy ‘Desmond’ dancing at a gay (3 Dollar Bill Bar) bar, Dec. 2, 2018,

https://www.youtube.com/watch?v=9EZ60tqJB4c

[1] ভিডিও এখন ইউটিউবে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশ উক্তি নিচের লেখায় খুঁজে পাওয়া যাবে,Hillary Clinton had the chance to make gay rights history. She refused. Washington Post, August 29, 2016

[1] Pedophilia is a natural sexual orientation, Mirjam Heine University of Würzburg

[2] Table 34. Examples of multiple orgasm in pre-adolescent males. Some instances of higher frequencies, Alfred Kinsey, Sexual Behavior in the Human Male, 1948

[3] রেফারেন্স ও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, মিথ্যের শেকল যত, মুক্তো বাতাসের খোঁজে, ইলমহাউস পাবলিকেশন,

পাঠক সাবধান! ভয়ের জগতে প্রবেশ করছো তুমি!! ফলো দা মানি – https://bit.ly/2NaKzGQ

[4] 4 Sexual Behavior in the Human Female, p. 121

[5] John Money –Development of paraphilia in childhood and adolescence (1993)

[6] দেখুন অ্যামেরিকান সমকামী শিশুকামী সংস্থা NAMBLA (North American Man Boy Love Association) এর সদস্যদের বক্তব্য – Chickenhawk : Men Who Love Boys (1994)