বিকৃতি এবং অ্যাপিল টু অথোরিটি


সম্প্রতি একজন অ্যামেরিকান “আলিম” (শুহাইব ওয়েব) ইমাম ইবনু হাজার আল-আসকালানির রাহিমাহুল্লাহ একটি বক্তব্য খন্ডিতভাবে ব্যবহার করে, এবং বর্তমান সময়ের কিছু “গবেষকদের” উপসংহারের ওপর ভিত্তি করে দাবি করেছে – ইসলাম নারী নেতৃত্ব সমর্থন করে। আর যারা বলে নারী নেতৃত্ব হারাম – তাদের বেশিরভাগেরই কোন বিশেষায়িত জ্ঞান নেই। তারা শুদ্ধভাবে এক পৃষ্ঠা আরবিও পড়তে পারে না, কিন্তু আক্বিদা-ফিকহ ইত্যাদির জটিল জটিল বিষয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো মন্তব্য করে ফেলে।

একথাটা আসলে বেশ পুরনো। কিছুটা ভিন্নভাবে আমাদের দেশেও অনেককে এমনটা বলতে দেখা যায় – “সূরা ফাতিহা শুদ্ধ করে পড়তে পারে না, কিন্তু শিরক নিয়ে কথা বলে।” “আরবীর প্রাথমিক জ্ঞান নেই কিন্তু আক্বিদা, ইমান-কুফর, তাওহিদ-শিরক নিয়ে কথা বলে।” – ইত্যাদি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইলম অর্জন এবং আরবী ভাষা শেখার কোন বিকল্প নেই, একথা অনস্বীকার্য। একজন তালিবুল ইলম হবার নূন্যতম যোগ্যতা হল সাবলীলভাবে আরবী পড়তে পারা। এবং কোন সন্দেহ নেই নিজের খেয়ালখুশি মতো ইসলামের মৌলিক কিংবা শাখাগত বিষয়ে কথা বলা শুধু অনুচিতই না, বরং গুনাহ। এটা আরবী না পারা লোকের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি আরবী ভাষাবিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। জাহিলের ক্ষেত্রে যতোটা প্রযোজ্য, দা’ঈ, তালিবুল ইলম, এবং আলিমদের ক্ষেত্রে তার চেয়ে আরো বেশি প্রযোজ্য।

কিন্তু তা সত্ত্বেও নিজের মতের বিরোধিতাকারীর আরবী জ্ঞান কিংবা নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষার অভাবকে টেনে এনে নিজের অবস্থান সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করা এই অ্যামেরিকান “আলিম” এবং একই ধরণের যুক্তি ব্যবহার করা দেশীয়দের বক্তব্য ভুল, এবং অনেক ক্ষেত্রে নিন্মমানের বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাই। বেশ কিছু কারণে।

প্রথমত, যারা বিরোধিতা করেন তাদের বেশিরভাগই নিজের খেয়ালখুশির অনুসরণ করে, বা নিজের “ইলম”-এর ভিত্তিতে সেটা করেন না। বরং ইসলামের ইতিহাসের অন্যান্য আলিমদের অবস্থানের ভিত্তিতেই সেটা করে। সহজ ভাষায় তারা ইচ্ছেমতো নিজেদের মতের ওপর ভিত্তি করে বিরোধিতা বা সমর্থন করেন না। বরং অন্যান্য আলিমদের বিপরীত মত থাকার কারণে বিরোধিতা করেন। দু’টোর মধ্যে অনেক, অনেক পার্থক্য। যেমন নারী নেতৃত্বের এ ব্যাপারটাই দেখুন। অ্যামেরিকান এই “আলিম” এর কথা অনুযায়ী, যারা নারী নেতৃত্ব হারাম বলে, তারা শুদ্ধভাবে এক পৃষ্ঠা আরবী পড়তে পারে না। অথচ অথচ এটা উম্মাহর মুফাসসির, মুহাদ্দিস, আর ইমামগনের অবস্থান।
[দেখুন – ১) https://islamqa.info/en/3285, ২) https://islamqa.info/en/71338, ৩) https://islamqa.info/en/21062]

সুতরাং কোন আরবী পড়তে না পারা মুসলিম যদি এই মহীরুহদের মতের ভিত্তিতে এই “আলিম” কিংবা তার সমগোত্রীয় “গবেষক”-দের বিরোধিতা করে তাহলে কি সেটা ভুল? শুহাইব ওয়েব আরবিতে হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়তে পারে, কিন্তু তাই বলে তার এ অবস্থান সঠিক হয়ে যাচ্ছে না। আবার আরবিকে এক লাইন পড়তে না পারা অনেকেই এ ব্যাপারে সঠিক ধারণা রাখেন। তাদের আরবি ভাষা সম্পর্কে অক্ষমতা তাদের সঠিক হওয়াকে বদলে দেয় না।

দ্বিতীয়ত, থেকে ১০-১৫ বছর আগেও এমন একটা পরিস্থিতি ছিল যে, মানুষকে দ্বীনের ব্যাপারে যে কোন বুঝ দেয়া যেত, এবং আলিম বা আলিম নামধারীরা সাতপাঁচ যা ইচ্ছে বুঝিয়ে দিলেও কেউ সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারতো না। কিন্তু বর্তমানে ইলমের বিশাল ভান্ডার ইন্টারনেটের কারণে বিভিন্ন ভাষায় মানুষের হাতের নাগালেই আছে। যার কারণে ইসলাম সম্পর্কে যেকোন কিছু চালিয়ে দেয়া এখন অতোটা সহজ না।

আমার কথা ভুল বুঝবেন না। আমি বলছি না যে ইন্টারনেট থাকা, একটু বুদ্ধিমত্তার সাথে গুগল ব্যবহার করতে পারা, এবং মাকতাবাতুস শামিলা থাকা সবাই আলিম হয়ে গেছে, বা ফতোয়া দেয়ার উপযোগী হয়ে গেছে। অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক ও বিশেষায়িত পড়াশুনার কোন বিকল্প নেই, মূল আরবীতে সোর্স ম্যাটেরিয়াল পড়ার কোন বিকল্প নেই। এবং অবশ্যই যোগ্য আলিম ছাড়া আর কারো ফতোয়া দেয়ার যোগ্যতা নেই। যে এমনটা করে সে বর্জনীয়, যদিও সে মাঝেমধ্যে সঠিক কথা বলে, বা তার কথার মধ্যে কিছু কল্যাণ থেকে থাকে। তবে এর মানে এটাও না যে, শুহাইব ওয়েব, মুল্লাহ ব্র্যাডলি, কিংবা এক লক্ষ সইয়ের ফ্রড অথবা এরকম অন্যান্য জোচ্চোররা নিজেদের ইচ্ছেমতো যা কিছু দ্বীন বলে চালিয়ে দেবে, আর সাধারণ মানুষ সেটা ধরতে পারবে না। এক সময়ে এটা সম্ভব ছিল, কিন্তু এখন আর না। আর এতে সত্যিকারের আলিমদের কোন সমস্যা হবার কথা না। যারা নানা ধরণের ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে, ছেলেভুলানো কথার ফেরি করে, আর যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সন্তুষ্টির জন্য ইসলামকে বদলে দিতে চায় – সমস্যা হবার কথা তাদের।

তৃতীয়ত, দুঃখজনকভাবে আলিমদের বিশাল একটা অংশের মধ্যে যখন খন্ডিত বা আংশিক বক্তব্য উপস্থাপন করে বাতিলকে হক্ব প্রমাণ করার একটা ব্যাপক প্রবণতা দেখা দেয়, তখন সাধারণ মানুষ বাধ্য হয় বিভিন্ন বিষয় ভিন্ন উৎস থেকে যাচাই করে দেখতে। বেশিরভাগ মানুষই মুফতি হবার জন্য কিংবা খ্যাতি বা নামযশ পাবার জন্য এটা করে না। নিজের দ্বীন সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার জন্য এটা করে।

দুটো উদাহরণ দেই। আমাদের দেশে হুসাইন বিন মানসুর আল-হাল্লাজ নামে একজন ব্যক্তিকে আল্লাহর ওলি হিসেবে প্রচার করা হয়। যাদেরকে বাংলাদেশের মূলধারা বলা হয় তাঁদের মধ্যেও এটা দেখা যায়। অথচ একজন সাধারণ মুসলিম যখন এই ব্যক্তির কথাবার্তা ও কাজের কথা শুনে, ইসলামের ব্যাপারে তার আরবী না জানা, নিয়মতান্ত্রিক জ্ঞান না থাকা মন বারবার বলে, এ হল স্পষ্ট কুফর ও শিরক। এবং সে যখন শোনে আল-হাল্লাজের সমসাময়িক আশির বেশি আলিম তাকে মুরতাদ আখ্যা দিয়েছিল এবং হত্যার ফতোয়া দিয়েছিল, তখন তার দুশ্চিন্তা হয়, কেন বারবার এই ব্যক্তিকে আল্লাহর ওলি হিসেবে তার সামনে উপস্থাপন করা হল। এবং যদি এমন একটি বিষয়ে আলিমদের ওপর ভরসা না করা যায়, তাহলে আরো মৌলিক বিষয়গুলোতে কিভাবে ভরসা করা যেতে পারে?

দ্বিতীয় উদাহরণ, ইউসুফ এস্টেস। অ্যামেরিকান রিভার্ট। প্রথমে ক্যাথলিক পাদ্রী ছিলেন। পরে মুসলিম হয়েছেন। দাওয়াহ করেন। অনেক খ্রিষ্টান আল্লাহর ইচ্ছায় তার দাওয়াহর মাধ্যমে মুসলিম হয়েছেন। পিস টিভির কল্যাণে অনেকেই তাকে চেনার কথা। পিস টিভির পাশাপাশি মিশরীয় হুদা টিভিতেও তিনি অনুষ্ঠান করেছেন। তবে হুদা টিভি উপমহাদেশে তেমন একটা পরিচিত না। অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীর এক কম্যান্ডারের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে বেশ মাতামাতি হচ্ছে। এই কম্যান্ডার দাবি করেছে আফগানিস্তানে অ্যামেরিকান আর্মিই হল মুজাহিদিন। তবে আমার মত ইউসুফ এস্টেস অনেক আগেই, অনেক দূরত্ব রেখেই, সব দিক দিয়ে এই কম্যান্ডারকে ছাড়িয়ে গেছেন।

২০০১ এর ৯/১১ এর হামলার পর ইউসুফ এস্টেস হুদা টিভিতে এক অনুষ্ঠানে অদ্ভূৎ, না অবিশ্বাস্য কিছু কথা বলেন। তার মূল বক্তব্য ছিল – আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ক্বিতাল করো যতোক্ষন না ফিতনা দূরীভূত হয়। যারা অ্যামেরিকা আক্রমণ করে নিরীহ জনসাধারণ হত্যা করেছে তারা ফিতনাবাজ। তাই তাদের হত্যা করা জিহাদ। জর্জ বুশ আফগানিস্তান আক্রমন করে মূলত ইসলামের মূলনীতির অনুসরণ করেছে। অ্যামেরিকার আফগানিস্তান আক্রমণ হল জিহাদ। [ লিঙ্ক ]

এখন আমি বুঝি একথাটা কতোটা বাতিল, কিন্তু আল্লাহর শপথ করে বলছি, একটা সময় ছিল যখন আমার কাছে এ কথাগুলো যৌক্তিক মনে হয়েছিল। আর তা মনে হবার কারণ ছিল ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয়, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর – মৌলিক কিছু দাবি সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। আমি স্কুলের বইতে এগুলো পাইনি। জুমার খুতবাতে এগুলো শুনিনি, বিকট শব্দে চলতে থাকা ওয়াজ কিংবা বাজারে প্রচলিত নূরানী নামায শিক্ষা, কিংবা মকসুদুল মোমেনিন জাতীয় বইগুলোতেও এ বিষয়গুলো সম্পর্কে পড়িনি। ফিতনা কী, মুমিন আর কাফিরের রক্তের পার্থক্য কী, আল ওয়ালা ওয়াল বারা কী, মূর্তিপূজা ছাড়াও যে শিরকের অন্যান্য রূপ আছে, একবার কালিমা উচ্চারণ করলেই যে আমৃত্যু ইমানের গ্যারান্টি পাওয়া যায় না – এ বিষয়গুলো আমার জানা ছিল না।

আজো যখন কোন ‘আল্লামা কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করে অনুবাদ করে বলে, আল্লাহ মুশরিকদের ইবাদতের স্থানের নিরাপত্তা দিতে বলেছেন – যখন জাতিসংঘ কিংবা অ্যামেরিকান সেনাবাহিনীর অনুকূলে ফতোয়া দেয়, এবং কুরআনের বিকৃত ব্যাখ্যা দেয়, তখনো নিশ্চিতভাবেই অনেক আন্তরিক মুসলিম আমার মতো একইভাবে বিভ্রান্ত হয়। এবং এখনো পাঠ্য বই, মিম্বর কিংবা মঞ্চ থেকে এ বিষয়গুলো নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার মতো কোন আলোচনা দেখি না।

হুদা টিভি মিশরীয়। মিশরীয়দের মাতৃভাষা আরবী। নিশ্চিতভাবেই হুদা টিভির সাথে অনেক আলিম জড়িত, যাদের ব্যাপক বিশেষায়িত পড়াশুনা আছে। সম্ভবত তাদের অনুষ্ঠানগুলো তদারকির জন্য কোন ধরণের শার’ই সম্পাদনার প্রক্রিয়াও আছে। তারপরও এমন বক্তব্য তাদের কাছ থেকেই এসেছে। এবং এমন উদাহরণ আমাদের সময়ে কম না। এমন অবস্থায় যেকোন কথাকে শুধু ব্যক্তি পরিচয়ের ওপর গ্রহণ করে ফেলা অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। এবং আমার কাছে এটা কোনভাবেই অযৌক্তিক মনে হয় না।

ব্যাপারটা সহজভাবে বলি। অবশ্যই হাইস্কুলে পড়া কোন ছেলে বিজ্ঞান বইয়ের কয়েক পাতা পড়ে গুগল করে জেনেটিক্স নিয়ে সিদ্ধান্তমূলক কথা বলা শুরু করলে সেটা গ্রহণযোগ্য না। যারা জেনেটিক্স নিয়ে পড়াশুনা করেছেন তাদের কাছেও ব্যাপারটা ভালো লাগার কথা না। তবে যখন জেনেটিক্স বা বায়োলজি নিয়ে পড়াশুনা করা লোকেরা আংশিক কিছু তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে, মৌলিক অনেক বিষয় গোপন করে, জেনেটিক্স কিংবা বায়োলজির অনেক উস্তাদ লোকের কথা বাদ দিয়ে, খন্ডিত চিত্র উপস্থাপন করে একটা আবোলতাবোল হাইপোথিসিসকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে – তখন জেনেটিক্সের তথ্যউপাত্ত, জনক ও মহীরুহদের কথার ভিত্তিতে তাদের এ বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাইয়ের বিরোধিতা করার অধিকার হাইস্কুল কিংবা প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রদের আছে।

আর এমন করা হলে যদি নানা আবেগী অথবা ছেলোভুলানো কথা দিয়ে, কিংবা জেনেটিক্স ডিগ্রির প্রসঙ্গ টেনে তাদের চেয়ে জ্ঞানের দিক দিয়ে শত বা হাজার গুণে বড় অতীত ও বর্তমানের মানুষদের বক্তব্য ও অবস্থান উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয় – তখন কোন নার্সারীতে পড়া বাচ্চারও সেটা ভালো লাগার কথা না। কারণ বড়-ছোট কারোরই বাটপাড়ি ভালো লাগে না।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *