কয়েকদিন আগে এক জন বলছিলেন…অবস্থা দেখে বাংলাদেশের মুসলিমদের একেবারে অসহায় মনে হচ্ছে। মুখ ফুটে না বললেও এই অনুভূতি নিশ্চয় আরো অনেকের মনে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু একই সাথে আমরা প্রায়ই শুনি, বলি এবং লিখি, বাংলাদেশে ৯০% মুসলিমের দেশ।
বিষয়টা গোলমেলে। ৯০% মুসলিমের দেশের মুসলিমদের অবস্থা অসহায় হয় কিভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বেশ কিছু ইন্ট্রেস্টিং ব্যাপার সামনে আসে। বাংলাদেশে মুসলিমদের অবস্থা আসলে কেমন এ প্রশ্নের জবাব আসলে নির্ভর করবে বাংলাদেশের সমাজ এবং সমাজের মানুষকে কিভাবে ভাগ করা হচ্ছে তার ওপর।
ওয়ার্ল্ডভিউ এবং মতাদর্শের দিক থেকে আমার মতে বাংলাদেশের সমাজের মানুষকে মোটা দাগে তিনভাগে ভাগ করা যায় –
ক) আদর্শিক সেক্যুলার
খ) আদর্শিক মুসলিম – যারা ব্যক্তি সমাজ, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক–সব অঙ্গনে ইসলাম চান (‘ইসলামপন্থী’ শব্দটা সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে)
গ) আম জনতা (‘the hanging middle’/ সমাজের মধ্যবর্তী অংশ) .এই তিন শ্রেনীর মধ্যে সংখ্যাগুরু কারা?
বাংলাদেশের সমাজে ক এবং খ, অর্থাৎ আদর্শিক সেক্যুলার এবং আদর্শিক মুসলিম মোটামুটি চরম পর্যায়ের সংখ্যালঘু। মেজরিটি হল গ। আদর্শহীন আম জনতাই সংখ্যাগুরু।
তারা হল সমাজের ঐ মানুষগুলো যারা মতাদর্শ, মতবাদ, ওয়ার্ল্ডভিউয়ের মতো বিষয়গুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিংবা মাথা ঘামানোর সুযোগ পায় না। তাদের মূল কনসার্ন জীবিকা, জীবনযাত্রার মান, নিশ্চয়তা, কমফোর্ট, শান্তি, সুখ আর আপওয়ার্ড সোশ্যাল মোবিলিটি নিয়ে।
এদের তরুণ প্রজন্ম শবে বরাতের রাতে বন্ধুদের সাথে ঘুরে ঘুরে মসজিদে নামায পড়ে, আবার মদ-গাঁজা নিয়ে বারবিকিউ নাইট করে নিউ ইয়ারস ইভে। একদিকে রুমডেইট করে অন্যদিকে আবার গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড একে অপরকে নামায পড়তে বলে।
এদের চিন্তাভাবনা, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রিত হয় প্রভাবশালী কালচার দ্বারা। কখনো যি-বাংলা, কখনো স্টার-ওয়ার্ল্ড, কখনো নেটফ্লিক্স, কখনো টিকটক–কখনো বা বাংলার চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সব কিছুর জগাখিচুড়ি। এরা সবদিকেই আছে। আবার কোন দিকেই নেই।
ব্যক্তি, সমাজ ও আর্থিক জীবনের অনেক অংশে এরা কার্যত সেক্যুলার, আবার একই সাথে ‘ধর্মভীরু’। ইসলামের ব্যাপারে তাদের অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবেগ ও ঐতিহ্যভিত্তিক। তাদের ইসলাম নুসুসভিত্তিক হবার বদলে সাংস্কৃতিক।
কিন্তু তারা সরাসরি ইসলামকে অস্বীকার করে না। নিজেদের মধ্যে তারা এখনো আল্লাহ, তাঁর দ্বীন এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিয়ে সম্মান, আবেগ এবং ভালোবাসা অনুভব করে। প্রশ্ন করা হলে নিজেদের মুসলিম বলেই পরিচয় দেয়। এমনকি জরিপে অনেকেই শরীয়াহর শাসনের পক্ষে বলে। তবে একই সাথে তারা অনেক চিন্তা ও আচরণকে তারা সমর্থন করে এবং স্বাভাবিক মনে করে যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
আমরা যে বলি ৯০% মুসলিমের দেশ, এই ৯০% এর অধিকাংশ হল এই গ-শ্রেনীর মানুষ। তারাই এ দেশের মেজরিটি, ক বা খ না।.
কিন্তু মেজরিটি হওয়া সত্ত্বেও, জাতীয় পর্যায়ের আলোচনা এবং ন্যারেটিভ এই আম জনতা নিয়ন্ত্রন করে না। এ ভূখণ্ডের সমাজ ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রন করে ক শ্রেনী – অর্থাৎ সেক্যুলার, প্রগতিশীল শ্রেনী।
বাংলাদেশের মিডিয়া, কালচার, শিক্ষা এবং জাতীয় ন্যারেটিভ তৈরি ক্ষমতা এদের নিয়ন্ত্রনে। ব্রিটিশ আমলের জমিদার শ্রেনীর মতো এরাও সংখ্যালঘু, কিন্তু সংখ্যার তুলনায় রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতির ওপর এদের নিয়ন্ত্রন অনেক বেশি।
এই সেক্যুলারদের মধ্যে বিভিন্ন ভাগ আছে। দুটো প্রধান শ্রেনীর দিকে তাকানো যেতে পারে।
সেক্যুলারদের মধ্যে প্রথম শ্রেনী হল – কলকাতার বাঙ্গালিয়ানা এবং বাম চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত সুশীল প্রগতিশীল অংশ। এরা এ ভূখণ্ডের ‘আদি’ সেক্যুলার। বিভিন্ন বামপন্থী দল-সংগঠন, উদীচী-ছায়ানট, বাংলা একাডেমি, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, প্রজন্মগত ধারাবাহিকতার সুশীল, বাংলাদেশের প্রথম দিকে এনজিওগুলোর পরিচালক টাইপের লোকেরা হল Legacy Secular।
এদের সেক্যুলারিসম প্রবলভাবে দাদাবাবু এবং বামপন্থা দ্বারা প্রভাবিত। হাজার বছরের বাঙ্গালি ঐতিহ্য আর বাঙ্গালিয়ানার মতো বিষয়গুলো এদের কাছে অনেকটা ধর্মের মতো। এদের বড় একটা অংশ মাথায় থালা সাইযের টিপ লাগাবে, হাতা কাটা ব্লাউস কিংবা পাঞ্জাবী পরে চাবিয়ে চাবিয়ে প্রমিত বাংলা বলবে আর রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আহাউহু করবে। ইসলামের বিধিবিধান, ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রকাশ, মসজিদ, মাদরাসার মত বিষয়গুলোর ব্যাপারে এই সেক্যুলারদের চুলকানি পুরনো এবং গভীরে প্রোথিত।
সেক্যুলাদের দ্বিতীয় শ্রেনী হল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এককেন্দ্রিক বিশ্বে স্যাটেলাইট টেলিভিশন এবং ইন্টারনেটের যুগে বেড়ে ওঠা গ্লোবালাইযড সেক্যুলার প্রজন্ম। ‘Nouveau riche’- দের মতো এরা হল ‘Nouveau Secular’। এদের সেক্যুলারিসম কসমোপলিটান, এবং শক্তভাবে পশ্চিমমুখী।
টেন মিনিট স্কুল, জাগো, IMUN, ডিজিটাল খিচুড়ি, BYLC ইত্যাদি থেকে বের হওয়া ছেলেপেলে, মিড ও হাই লেভেল কর্পোরেট চাকুরে, অ্যাড এজেন্সি চালানো লোকজন, হাল আমলের ফেসবুক ইনফ্লুয়েন্সার, ‘তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবি’দের বড় একটা অংশ, বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনাঢ্য পরিবার এবং রাজনৈতিক এলিটদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অনেকে–এই ‘সেকেন্ড ওয়েভ সেক্যুলারদের’ উদাহরণ।
এদের কাছে বাঙ্গালি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বাঙ্গালিয়ানা তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। তবে টোকেন কালচারাল রেলিক হিসেবে তারা এগুলো ব্যবহার করে। কর্পোরেট হলিডেতে পরিণত করে এগুলো থেকে টাকা বানায়, এবং ‘কালচারালি সেন্সিটিভ’ হবার অংশ হিসেবে এগুলো পালন করে। অনেকে আবার এক ধরণের গ্লোবালাইযড মাল্টিকালচারালিসম প্রমোট করতে গিয়ে এদের সরাসরি বাঙ্গালিয়ানার বিরুদ্ধেও বলে।
এদের ইসলামবিদ্বেষ দাদাবাবুদের মতো না। অনেকের ক্ষেত্রে তা ডকিন্স-হ্যারিসদের পথ ঘুরে আসা। আবার অনেকের ক্ষেত্রে তা হল ক্লাসিকাল লিবারেল ডিসকোর্স কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মতো হালকা ভদ্রত্বের পরতের আড়ালে রাখা।
এই দু ধরণের সেক্যুলারদের মধ্যে অনেক সময় ওভারল্যাপ ঘটতে পারে। একই পরিবার কিংবা ব্যক্তিরমধ্যেও দু ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। আবার এমন কেউ থাকতে পারে, যাদের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য এদিক-সেদিক আছে। অর্থাৎ সবার মধ্যে সব বৈশিষ্ট্য আছে, এবং হুবহু যেভাবে বলা হয়েছে সেভাবেই আছে–ব্যাপারটা এমন না। এটা মোটা দাগের একটা বিবরণ, আশা করি মূল আইডিয়াটা এখান থেকে ক্লিয়ার।
বাংলাদেশের প্রকৃত সংখ্যালঘু হল খ-শ্রেনী, অর্থাৎ আদর্শিক মুসলিম শ্রেনী। এই শ্রেনীকে আমরা অনেক সময় ‘প্র্যাকটিসিং মুসলিম’, ‘ইসলামিস্ট’, ‘দ্বীনি কমিউনিটি’, ইত্যাদি বলে থাকি।
সংখ্যার দিক থেকে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও এই শ্রেনী সংখ্যালঘু। ‘আম জনতার’ মতো সংখ্যার শক্তি তাদের নেই। আবার সেক্যুলার-শ্রেনীর মতো আধিপত্যও নেই।
এই শ্রেনীর কোন কথা বলার সুযোগ নেই সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। তাদের কন্ঠ রোধ করার সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়ে যায় সেক্যুলার-শ্রেনী। এই আদর্শিক মুসলিম শ্রেনীর অস্তিত্ব এবং পরিচয়কে জাতীয় পর্যায়ে হয় অস্বীকার করা হয়, অথবা তাদের পরিচয় স্বীকার করা হয় নেতিবাচক অর্থে–সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ, উগ্র, জঙ্গি, ইত্যাদি নামে। তাঁদের যেকোন বক্তব্য কিংবা অবস্থান উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ কিংবা তাণ্ডব খেতাব পেয়ে যায়।
বাংলাদেশে এমন একটা সামাজিক এবং শক্তির কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে যেখানে খুব সহজে এই মুসলিম শ্রেনীকে ‘অপর’, ‘অদ্ভূত’ কিংবা ‘শত্রু’ প্রতিপন্ন করা যায়। ফলে তাদের বিরুদ্ধে অবলীলায় এমন সব কথা বলা যায় এবং কাজ করা যায়, যা সেক্যুলার কিংবা আম-জনতা শ্রেনীর ক্ষেত্রে করা যায় না।
চাইলেই ২০ জন সেক্যুলারকে গুলি করে মেরে ফেলা যায় না কিন্তু ‘হেফাযতি’ মারা যায়। চাইলেই ৫-ই মে-র মতো করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে দমন করা যায় না। কিন্তু ইচ্ছেমতো ‘তাণ্ডব’ থামানো যায়।
চাইলেই কয়েকটা বই ‘রিকভারি’ দেখিয়ে কিছু ছাত্রকে দানব হিসেবে উপস্থাপন করা যায় না, তবে ‘জঙ্গি’-দের ক্ষেত্রে করা যায়।
‘অপরাধ প্রমাণিত হবার আগে নির্দোষ’–হবার নীতি চাইলেই উপেক্ষা করা যায় না, তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামাত-শিবির হলে করা যায়।
গুম থাকা অবস্থাতেই গুমের বৈধতা অন্যদের ক্ষেত্রে তৈরি করা হয় না। কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তি ‘উগ্রবাদী’ হলে করা যায়।
আর এই সমীকরণের কারণে ‘৯০% মুসলিমের দেশ’ হবার পরও, বাংলাদেশের মুসলিমদের অবস্থা একেবারেই অসহায়।
এই আলোচনাতে সরলীকরণ আছে। এখানে কেবল ওয়ার্ল্ডভিউ কিংবা মতাদর্শের কথা এসেছে। অর্থনীতির কথা আসেনি, আসেনি ইন্টারসেকশানাল দিকগুলোর কথাও। তবু আমি মনে করি বাংলাদেশের মুসলিমদের অবস্থান বোঝার জন্য এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার জন্য এই শ্রেনীবিভাগের আলোকে চিন্তা করা কার্যকরী হতে পারে। এই আলোচনা বিস্তৃত ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এ আলোচনায় ঢোকা জরুরী। বাস্তবতাগুলো দিন দিন অত্যন্ত কষ্টদায়কভাবে প্রকট হয়ে উঠছে আমাদের সামনে।