বাংলাদেশের সমাজ এবং ইসলামের প্রশ্ন – ২


নবীরাসূল (আলাইহিমুস সালাতু ওয়াসসালাম) যখন কোন সম্প্রদায়ের কাছে দাওয়াহ নিয়ে যেতেন তখন সাধারণত তিনটা শ্রেনী তৈরি হতো।

মুসলিম, যারা নবীদের দাওয়াহ গ্রহণ করে নেয়।

কাফের, যারা সক্রিয়ভাবে দাওয়াহর বিরোধিতা করে, এবং

সাইলেন্ট মেজরিটি।

হক-বাতিলের সংঘাত থেকে সাইলেন্ট মেজরিটি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। সে তার নিজের লাইফ, নিজের প্রবলেমস নিয়ে মশগুল। এতো চিন্তাভাবনা কিংবা আত্মজিজ্ঞাসার সময় তার নেই। সে শুধু খেয়েপরে বেঁচে থাকতে চায় নিশ্চিতে। তবে হ্যাঁ, স্ট্যাটাস কৌ পরিবর্তনের চেষ্টাকে সাইলেন্ট মেজরিটি সাধারণত সমর্থন করে না।

শনিবারের ঘটনার সময় বনী ইস্রাইলের মধ্যেও তিন ধরণের মানুষ দেখা দিল। প্রথম দল শনিবারের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গতে চাইলো। প্রতারণা করার দুঃসাহস দেখানো আল্লাহ ‘আয্যা ওয়া জাল্লা-এর সাথে। দ্বিতীয় দল, সৎ কাজের আদেশ করলো, মন্দ কাজের বিরোধিতা করলো। সতর্ক করলো প্রথম দলকে।

আর তৃতীয় দল? তৃতীয় দল কী করলো? কিছুই না। তারা নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গলো না, আবার এ কাজে মানাও করলো না। ইন ফ্যাক্ট তারা দ্বিতীয় দলকে বলতে শুরু করলো, তোমরা এদেরকে মানা করছো কেন, যখন আল্লাহই তাদেরকে শাস্তি দেবেন?

নিজেদেরকে তারা গুঁটিয়ে রাখলো নিজস্ব নিরাপদ খোলসের ভেতর। যখন আল্লাহ আয্যা ওয়া জাল্লা-র আযাব আসলো, তিন দলের মধ্যে কেবল দ্বিতীয় দল নাযাত পেল।

আমাদের সমাজের শ্রেনীবিভাগের আলোচনা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে ওপরের কথাগুলো মাথায় আসলো। যাই হোক, আগের আলোচনার আলোকে বাংলাদেশের মুসলিমদের সমস্যাকে এভাবে ফ্রেইম করা যেতে পারে – .বাংলাদেশে ইসলামের (এবং বাই এক্সটেনশান মুসলিমদের) প্রতি সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনী বৈষম্য এবং বিরোধিতা বিদ্যমান। সীমিত রেইঞ্জের ভেতরে কিছু আচার-আচরণ ও কথা ‘অনুমোদিত ইসলাম’ হিসেবে গৃহীত। বাকি সব অননুমোদিত, অবৈধ। “উগ্রবাদ” কিংবা “চরমপন্থা”। .ইসলামের কোন দিকগুলোকে অনুমোদিত এবং কোন দিকগুলোকে অননুমোদিত–তার সাথে কুরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামের ইলমী সিলসিলার কোন সম্পর্ক নেই। এ বিভাজনের ওপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই নিরাপদ খোলসের ভেতরে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মিডিয়া এবং সমাজের ওপর নিজ আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে এই বিভাজনের সীমা ঠিক করে দেয় সেক্যুলাররা। তাদের খেয়ালখুশি মতো। .মুসলিমদের পলিটিকাল অ্যাসপিরেশান বা রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার কোন সুযোগ নেই। ইসলামের প্যারাডাইমে রাজনীতির কথা চিন্তা করলে সর্বনিম্নে জামাত-শিবির-হেফাযত খেতাব জোটে। আর একটু বাক্সের বাইরে চিন্তা করার স্পর্ধা দেখালে জঙ্গি ট্যাগ পেয়ে হতে হয় বন্দী কিংবা বন্দুকযুদ্ধের অনিচ্ছুক অংশীদার। .অর্থাৎ রাজনীতি করতে হলে সেক্যুলার বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ (আওয়ামী লীগ) কিংবা সেক্যুলার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের জোটে যেতে হবে। বিকল্প কোন ধারার কথা চিন্তা করতে হলেও আগে মেনে নিতে হবে সেক্যুলারিসম, গণতন্ত্র, সাংবিধানিক শাসনসহ নানা তন্ত্রেরমন্ত্রের কাঠামোকে। সহজ ভাষায় বললে, আপনি এ বি সি ডি যে পার্টিই করেন সেক্যুলারিসমকে স্বীকার করে, সেক্যুলার ফ্রেইমওয়ার্কের অংশের ভেতরে করতে হবে। আপনার রাজনৈতিক চিন্তা এবং আকাঙ্ক্ষা এ কাঠামোর বাইরে যেতে পারবে না। এবং এ ফ্রেইমওয়ার্ক পরিবর্তনের যেকোন চেষ্টা তো বটেই, আলোচনা এমনকি চিন্তাকেও গণ্য করা হবে অবৈধ, চরমপন্থা এবং অপরাধ হিসেবে। যদিও বামপন্থীরা লেনিনিস্ট বিল্পবের কথা লক্ষবার বললেও সেটা উগ্রবাদ গণ্য হবে না। .তাহলে সমস্যার মানচিত্রটা দাড়ালো অনেকটা এরকম– – বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রন করে সেক্যুলার শ্রেনী .- সেক্যুলার শ্রেনী এবং আদর্শিক মুসলিম শ্রেনীর চিরশত্রু। এ দুইয়ের মধ্যে কোন ঐক্য সম্ভব না। .- সম্পদ, অবকাঠামো, দক্ষ জনবল, নেটওয়ার্কিংসহ বিভিন্ন দিক থেকে এই দুই শ্রেনীর ক্ষমতা ও সামর্থ্যের মধ্যে কোন ধরণের ভারসাম্য নেই.- সেক্যুলার শ্রেনী এমন এক কাঠামো গড়ে তুলেছে যেটার ফলাফল হল ইসলাম বিরোধী বক্তব্য, মনোভাব, প্রথা, প্রচলন, আইন ও আচরণের স্বাভাবিকীকরণ। যার প্রসার আম জনতার মধ্যেও হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে সেক্যুলার শ্রেনীর গড়ে তোলা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বয়ানের মাধ্যমে, যা ইসলামবিদ্বেষী এবং এ ভূখন্ডের মানুষের মুসলিম পরিচয়, বিশ্বাস ও ইতিহাসকে মুছে ফেলতে সচেতনভাবে সক্রিয়. – এই কাঠামোর ফলস্বরূপ ‘অনুমোদিত সীমার বাইরে’ মুসলিম কোন সেন্টিমেন্ট পাবলিকলি প্রকাশ ও প্রচার করা, এবং দাবি জানানো সামাজিকভাবে অত্যন্ত কঠিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘অবৈধ’.- স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রন বজায় রাখার জন্য সেক্যুলার শ্রেনী আম জনতাকে মোটা দাগে নিজেদের পাশে রাখার চেষ্টা করে। মিডিয়া, শিক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির মাধ্যমে চেষ্টা করে ধীরে ধীরে তাদের সেক্যুলার ধর্মে দীক্ষিত করার। এভাবে তারা নিজেদের আধিপত্যের কাঠামোর বৈধতা উৎপাদন করে। .- সেক্যুলার শ্রেনী যখন বলে ‘আমাদের মূল্যবোধ’, ‘আমাদের সংস্কৃতি’ – তখন আসলে সে বোঝায় সেক্যুলারদের মূল্যবোধ আর সংস্কৃতির কথা। কিন্তু বিষয়টা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তারা আম জনতার (মধ্যবর্তী শ্রেনী) হয়েও কথা বলছে। .- সেক্যুলার শ্রেনীর আধিপত্য টিকে আছে, কারণ আম জনতা (সাইলেন্ট মেজরিটি) কোন না কোন কারণে তা মেনে নিয়েছে। অন্যদিকে আদর্শিক মুসলিম শ্রেনী এই আধিপত্যকে ভাঙ্গার সামর্থ্য (এখনো) রাখে না। .- আম জনতা, বিভিন্ন দিক থেকে আদর্শিক মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু দ্বীনের সঠিক বুঝ না থাকায় এবং নির্দিষ্ট আদর্শ না থাকার কারণে ইসলামবিরোধী বিভিন্ন চিন্তাভাবনার আত্মীকরণ ঘটেছে তাদের মধ্যেও। .- মুসলিম পরিচয়কে জাতীয় আলোচনায় শক্তভাবে আনার কোন উপায় নেই। সেক্যুলার-জমিদার শ্রেনী বন্ধ করে রেখেছে সব পথ। আর মুসলিম পরিচয়কে আলোচনায় না এনে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক শক্তি অর্জনের কোন পথ তৈরি করা সম্ভব না। .স্ট্যাটাস কৌ বজায় থাকলে বাংলাদেশে ইসলামী দল কিংবা সংগঠন বড় দলের জোটের জুনিয়র পার্টনার হিসেবেই থেকে যাবে। বেশি থেকে বেশি প্রেশার গ্রুপের ভূমিকা পালন করতে পারবে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের আলোচনায় স্বতন্ত্র ভূমিকায় আসতে পারবে না। আধিপত্য অর্জন করতে পারবে না। .সমস্যার আলোচনা থেকেই কিছু কিছু করণীয় আমাদের সামনে উঠে আসে। যেমন – .- সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর সেক্যুলারদের আধিপত্যকে নষ্ট করে দেয়া .- উগ্রবাদ কিংবা চরমপন্থা নাম দিয়ে ইসলামের বিভিন্ন দিককে নাকচ করার ক্ষমতা সেক্যুলার শ্রেনীর হাত থেকে সরিয়ে নেয়া.- সামাজিকভাবে ইসলামী পরিচয়, আদর্শ, পোশাক ও আচরণের গ্রহণযোগ্য তৈরি করা। এর অর্থ হাজী সাহেবকে মাসজিদ কমিটিতে রাখা না। বরং ইসলামের অসংখ্য অকাট্য যে দিকগুলোকে সমাজে ডিমনাইয করা হয়, সেগুলোর অ্যাকসেপ্টেন্স।.- ইসলামবিরোধিতাকে এমনভাবে জনসম্মুখে দুর্বল করা, যাতে ইসলাম ও মুসলিমদের ঢালাওভাবে উপেক্ষা করা না যায়।.কিন্তু এগুলো অর্জনের উপায় কী? এটাই হল আমাদের হাতে থাকা মূল প্রবলেম যার সমাধান আমাদের করতে হবে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *