প্রথম পর্যায়: এইডস প্রতিরোধ ও যৌন স্বাস্থ্য
নব্বইয়ের দশকে অ্যামেরিকাসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের পাশাপাশি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এইডস মহামারীকে বৈশ্বিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে। এইডস মোকাবেলায় সরকারি বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক খাত থেকে আসে প্রচুর ফান্ড। এই অর্থের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ যায় এইডস সচেতনতা এবং এইডস রোগীদের নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর কাছে। আর পশ্চিমা বিশ্বে, যেখানে এইডস মহামারী শুরু, এইডস নিয়ে কাজ করা অধিকাংশ সংগঠন কোন না কোনভাবে সমকামী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল। অনেক ক্ষেত্রে একই লোক একাধিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতো।[1] ফলে এইডস মোকাবেলায় আসা ফান্ডিংয়ের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পৌছে গেল সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের কাছে। ফান্ডিংয়ের সাথে সাথে বাড়লো তাদের প্রভাব। সবচেয়ে বেশি এইডস ঝুকিতে থাকা জনগোষ্ঠী হিসেবে জাতিসংঘের জাতিসঙ্ঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিষদের(ECOSOC) এর উপদেষ্টা পদও পেয়ে গেল কিছু কিছু সমকামী সংগঠন।[2] জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে বিকৃত যৌনতার অধিকারের আলাপ তারা তুলতে শুরু করলো আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। এভাবে গড়ে ওঠলো এলজিবিটি আন্দোলনের বৈশ্বিক প্রভাব ও বিস্তৃতি।
এইডস মহামারীর আরেকটা অপ্রত্যাশিত প্রভাব ছিল। প্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে সমকামিতার ব্যাপারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নেতিবাচক। কিন্তু সমকামিতাকে ঘৃন্য অপরাধ মনে করা হলেও এইডস সংক্রান্ত উদ্যোগে এসব দেশের সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি সাহায্য পাওয়া যায়।[3] আর এর মাধ্যমে সমকামী সংগঠনগুলো কাজ করার সুযোগ পায় এসব দেশে। এভাবে গড়ে ওঠে প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশেও এভাবেই শুরু হয় এলজিবিটি আন্দোলনের কার্যক্রম।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বেশ কিছু দেশী ও বিদেশী এনজিও ‘এইডস প্রতিরোধ’-এর ব্যানারে বাংলাদেশে কাজ করতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই সেইসময় (এবং এখনও) বাংলাদেশে এইডস আক্রান্তদের প্রায় সবাই ছিল সমকামী অথবা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ড্রাগ ব্যবহারকারী। কাজেই এইডস নিয়ে কাজ করা কার্যত ছিল সম লিঙ্গের সাথে যৌনতায় লিপ্ত পুরুষদের নিয়ে কাজ করা। তবে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বিবেচনা করে জনপরিসরে এনজিওগুলো সরাসরি সমকামী বা হোমোসেক্সুয়াল শব্দ ব্যবহার না করে MSM ব্যবহার করে। MSM হল Men who have sex with men (এমন পুরুষ যে অন্য পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়) এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
শিবানন্দ খান ও বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি:
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে উপমহাদেশে এলজিবিটি নেটওয়ার্ক তৈরিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে ভারতীয় সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট শিবানন্দ খান। ছোটবেলা থেকে ব্রিটেনে পড়াশোনা করা শিবানন্দ খানের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল সমকামী অ্যাক্টিভিসমে। ব্রিটেনে থাকা অবস্থায় সেখানকার দক্ষিণ এশীয় সমকামী নারী ও পুরুষদের নিয়ে ‘শক্তি’ নামে একটি সংগঠনও তৈরি করেছিল সে।[4]
উপমহাদেশে এলজিবিটি নিয়ে কাজ করার জন্য শিবানন্দ নায ফাউন্ডেশন (NAZ Foundation International) নামে এনজিও তৈরি করে।[5] দেশে দেশে ঘুরে শুরু করে নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ। আসে বাংলাদেশেও। শিবানন্দের উৎসাহে সমকামী পুরুষদের ‘ যৌন স্বাস্থ্যসেবা’ ও ‘সচেতনতা বৃদ্ধ’র লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে তৈরি হয় বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। প্রতিষ্ঠানটি সরকারী রেজিস্ট্রেশন পায় ১৯৯৭ সালে।[6]
গবেষক আদনান হোসেইনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী নায ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি শুরুতে বন্ধু-কে সহায়তা করেছিল ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি অ্যামেরিকান এনজিও।[7] অন্যদিকে বন্ধু-র ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ৯৬-এ শিবানন্দ খান যে প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল সেটাতে সহায়তা দিচ্ছিল অ্যামেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন।[8]
নায ফাউন্ডেশনের এ প্রকল্পে প্রজেক্ট অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ করেছিল বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতারা।[9]
অর্থাৎ শুরু থেকেই বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলন আমদানী করা হয়েছিল বিদেশী, বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মদদে। সাথে ছিল ভারতীয় কানেকশন। পরবর্তীতে এই প্যাটার্ন বারবার আমরা দেখতে পাবো।
বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি-র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরের এক সাক্ষাতকার থেকে এনজিও-টি গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট সম্পর্ক জানা যায়। সাক্ষাতকারে বন্ধুর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বলেছে,
‘শিবের সাথে আমার প্রথম দেখা ১৯৯৬ সালে। সে তখন বাংলাদেশে পুরুষদের সাথে যৌন সম্পর্ক করা পুরুষদের যৌনতা, যৌন স্বাস্থ্য, এইচআইভি এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য বাংলাদেশ সফর করছিল। আনিসুল ইসলাম হিরো, বন্ধু-র বর্তমান চেয়ারপারসন, ওর (শিবানন্দ) সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। শিব নায ফাউন্ডেশনে কাজ করতো, আর আনিসুল ছিল নায ফাউন্ডেশনের প্রধানের বন্ধু…
সেই সময় বাংলাদেশের এমএসএম (MSM) সম্প্রদায় যৌনবাহিত রোগ এবং যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে গুরুতর সমস্যায় ভুগছিল। আমার মনে আছে আমি শিবের সাথে এমএসএম সম্প্রদায়ের যৌন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত দুরবস্থা নিতে কথা বলেছিলাম। শিব তখন এই কমিউনিটির জন্য কাজ করা আইডিয়া দিল…
আমার জন্য শিব ছিল শিক্ষকের মতো, গুরুর মতো। আমি তখন কেবলই একজন ছাত্র। মাত্র মাস্টার্স শেষ করেছি। এনজিও, কিংবা সিএসও (সিভিল সোসাইটি অর্গানাইযেইশান) নিয়ে, কিভাবে এই সিস্টেমগুলো কাজ করে এবং এরকম অন্যান্য বিষয় নিয়ে আমার কোন ধারণা ছিল না। এ সব কিছু শিব আমাকে শিখিয়েছে। এমনকি আমার মনে আছে প্রফেশনাল ইমেইল কিভাবে লিখতে হয়, সেটাও আমি শিখেছি শিবের কাছে। আমি এটা বলতে পারি যে আমি আজ যা কিছু হয়েছি তার পুরোটাই শিবের জন্য।’[10]
[1] I remembered him often saying, “I feel proud to be a part of history. We are working against the stigma, against the odds.” APCOM
https://www.apcom.org/i-feel-proud-to-be-a-part-of-history/
উল্লেখ্য এই সাক্ষাতকারটি নিয়েছে অ্যাপকম নামের একটি এনজিও। এমন অ্যাপকমেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হল শিবানন্দ খান।[11]
যেহেতু বিকৃত যৌনতায় লিপ্ত পুরুষদের এইডস আক্রান্ত হবার আশংকা সবচেয়ে বেশি, তাই এইডস মহামারী প্রতিরোধের অংশ হিসেবে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সাথে সহজেই বন্ধু-র মতো এনজিওগুলো কাজ করার সুযোগ পায়। এই সময়টাতে কেয়ার বাংলাদেশ (CARE Bangladesh) এর সহযোগী হিসেবেও কাজ করতে শুরু করে বন্ধু। পরবর্তী কয়েক বছরে বন্ধু ফান্ডিং পায় ইউএসএইড, নেদারল্যান্ডের দূতাবাস এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ (DFID) থেকে।[12]
অল্প সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন বিভাগে ছড়িয়ে পড়ে তাদের কার্যক্রম। কিছুদিনের মধ্যে সমকামী পুরুষদের জন্য ড্রপ ইন সেন্টার (ডিআইসি) নামে ওয়ান স্টপ ক্লিনিক খোলে বন্ধু এবং অন্যান্য এনজিওগুলো। মেডিকাল চেকআপের পাশাপাশি সমকামীদের ‘নিরাপদ’ পায়ুসঙ্গমের জন্য বিনামূল্যে কনডম এবং লুব্রিকেন্ট বিতরণ করা হয় এসব সেন্টারে। এছাড়া যৌন সঙ্গী খুজতে এবং নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য নিয়মিত এসব ক্লিনিকে আসাযাওয়া শুরু করে সম লিঙ্গের সাথে যৌনতায় লিপ্ত পুরুষরা। অনেক ড্রপ ইন সেন্টার সমকামী পুরুষদের একত্রে নাচগান এবং ক্রসড্রেসিং (নারী সাজা) এর মতো কাজের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে।[13]
অর্থাৎ বাহ্যিকভাবে যৌন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য তৈরি হলেও এই সেন্টারগুলো প্রচারণা, গণসংযোগ, নেটওয়ার্কিং এবং বিকৃতি চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠে। পৃথিবীর অন্যান্য আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও এধরণের এনজিওগুলোর অফিস,
‘…কেবল যৌন উত্তেজক কাজকর্ম না, বরং কমিউনিটি তৈরির স্থান হিসেবেও কাজ করে’[14]
এসময় আইসিডিডিআরবি-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও সমকামীদের যৌনতা ও যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে জনপরিসরে আলাপ তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০০০ সাল থেকে হিজড়া সম্প্রদায়কে নিয়েও কাজ করে শুরু করে কেয়ার বাংলাদেশ এবং বন্ধু-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। পরবর্তীতে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ এর প্রচারের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তবে সে আলোচনাতে আমরা যাবো আরেকটু পর।
২০০৭ সাল নাগাদ আইনী ও প্রশাসনিক সমস্যার ক্ষেত্রে সমকামী ও হিজড়াদের সহায়তা করার জন্য ছয় জেলায় উকিলদের গ্রুপ তৈরি করে বন্ধু। এই উদ্যোগেরও অর্থায়ন আসে পশ্চিম থেকে।[15] বর্তমানে বন্ধু বাংলাদেশের ত্রিশটির বেশি জেলায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯৭ থেকে শুরু করে গত সাতাশ বছরে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ড্রপ ইন সেন্টারের মাধ্যমে ৫০ লাখেরও বেশি কন্ডম এবং লুব্রিকেন্ট বিতরণ করেছে সমকামীদের মধ্যে।[16] পাশাপাশি ভূমিকা রেখেছে সমকামীদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলায়।
***
এভাবে শুরু হয় বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলনের প্রথম ধাপ। নায ফাউন্ডেশন পরবর্তীতে ভারতীয় আদালতে সেকশন ৩৭৭-কে চ্যালেঞ্জ করবে। দীর্ঘদিন রোগে (এইডস?) ভোগার পর শিবানন্দ খান মারা যাবে ২০১৩ সালে। অনেকে বলবে শিবানন্দ আত্ম্যহত্যা করেছিল।[17] অন্যদিকে ১৯৯৬ সালে কাজ শুরু করার অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার পরিণত হবে সমকামীদের নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানে।
[1] Bernstein, Mary. “Identity politics.” Annu. Rev. Sociol. 31 (2005), 560
[2] International Lesbian, Gay, Bisexual, Trans and Intersex Association (ILGA) – ১৬০টিরও বেশি দেশ মিলিয়ে মোট ১৭০০টিরও বেশি সংস্থার সাথে কাজ করা এই এনজিও জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের উপদেষ্টার পদমর্যাদা উপভোগ করে।
[3] Bernstein, ‘Identities and Politics’, 558
[4] Remembering Shivananda Khan, APCOM’s founder on Human Rights Day, Dennis Altman https://www.apcom.org/remembering-shivananda-khan-apcoms-founder-on-human-rights-day-2/
[5] https://www.naz.org.uk/who-we-are#
https://queerbio.com/wiki/index.php/Shivananda_Khan
[6] https://www.bandhu-bd.org/about-bandhu
Bandhu Social Welfare Society (BSWS), Annual Report 2021, p. 10
[7] Hossain, A. “Bangladesh: Review of LGBT situation in Bangladesh.” The Greenwood Encyclopedia of LGBT Issues Worldwide (2010): 333-346.
[8] https://www.bandhu-bd.org/about-bandhu
[9] Prior to the establishment of the Society, Ahmed worked as a Project Associate at the Naz Foundation. During his professional life, he conducted a survey named “Strategic Response to the Reproductive and Sexual Health Needs of MSM in Dhaka.”
https://www.ashoka.org/en-sg/fellow/shale-ahmed
https://www.thedailystar.net/news-detail-80569
[10] I remembered him often saying, “I feel proud to be a part of history. We are working against the stigma, against the odds.” Shale Ahmed, Executive Director, Bandhu Social Welfare Society (Bandhu)
[11] Remembering the Legacy of Shivananda Khan (1948 – 2013), the Founder of APCOM,
[12] “Around the same time, The Society was accepted as a partner of Care Bangladesh; and later, through the support of USAID, The Netherlands Embassy and DFID, the Society was able to expand its work to different areas of the country.”
https://www.ashoka.org/en-sg/fellow/shale-ahmed
[13] Hossain, Adnan. “Section 377, same-sex sexualities and the struggle for sexual rights in Bangladesh.” Austl. J. Asian L. 20 (2019): 115.
[14] Hossain, Adnan. “Section 377,
Wilson, Ara. “NGOs as erotic sites.” Development, sexual rights and global governance 29 (2010): 86.
Hall, Kira. “Intertextual sexuality.” Journal of Linguistic Anthropology 15, no. 1 (2005): 125-144.
[15] Hossain, Adnan. “Section 377,
[16] A tale of two decades 20-year achievements leading to impacts 1996-2016, Bandhu Social Welfare Society , Executive Summary, p 8
[17] Khan himself faced declining health, and it is believed he died by committing suicide at this home.
https://queerbio.com/wiki/index.php/Shivananda_Khan#Birth_-_Death