দ্বিতীয় পর্যায়: ‘স্বাস্থ্য সেবা’ থেকে ‘অধিকার’ – যৌন অধিকার, যৌন সংখ্যালঘু, যৌন বৈচিত্র্য
বাংলাদেশে এলজিবিটি অ্যাক্টিভিসমের প্রথম দশ বছর কাজক্রম চলে ‘এইডস প্রতিরোধ’ আর ‘যৌন স্বাস্থ্য সেবা’র ব্যানারে। পরিবর্তন আসতে শুরু করে ২০০৬/০৭ এর দিকে। এ সময় থেকে সেবা প্রদানের পাশাপাশি সমকামীদের ‘যৌন সংখ্যালঘু’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ‘যৌন অধিকার’ এর দাবি নিয়ে আলাপ তৈরি করা হয়। বলা বাহুল্য এখানে অধিকার দেয়া বলতে বিকৃত যৌনতার স্বাভাবিকীকরণ এবং বৈধতার কথা বলা হচ্ছে।
যৌন স্বাস্থ্য এবং এইডস সচেতনতার ব্যানার থেকে বের করে এনে বিকৃত যৌনতার প্রশ্নকে অধিকারের আলাপ হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ব্র্যাক। বিশেষ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেইমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ। Section 377, same-sex sexualities and the struggle for sexual rights in Bangladesh, শিরোনামের নিবন্ধে গবেষক আদনান হোসেইন মন্তব্য করেছেন,
“সেবা প্রদানের মডেল থেকে সরে এসে যৌন অধিকারের ব্যাপারে জনপরিসরে আলাপ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রনী ভূমিকা রাখে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেইমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর প্রচেষ্টাগুলো।”[1]
সমকামী অধিকার নিয়ে ব্র্যাকের এই সময়কার কার্যক্রমের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে ২০১১ সালে প্রকাশিত Creating A Public Space And Dialogue On Sexuality And Rights: A Case Study From Bangladesh নামের নিবন্ধে।[2] এ নিবন্ধের লেখকরা সবাই ব্র্যাকের জেইমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে কার্যরত ছিলেন অথবা আছেন। এই নিবন্ধ থেকেই তাদের কার্যক্রমের বিবরণ দেখবো আমরা। প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ আমি অনুবাদ করে দিচ্ছি, তবে আমি জোরালো অনুরোধ থাকবে, যাদের পক্ষে সম্ভব তারা যেন মূল প্রতিবেদনটি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েন।
সূচনা:
Creating A Public Space And Dialogue On Sexuality And Rights: A Case Study From Bangladesh শিরোনামের নিবন্ধের লেখকদের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সালে সমকামী অধিকার নিয়ে যুক্তরাজ্যে আয়োজিত এক গবেষণা কনসোর্টিয়ামে অংশগ্রহণ করার পর বাংলাদেশেও এ ধাচে কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তারা। আবারও সেই পশ্চিমা কানেকশন। সমকামীতাসহ অন্যান্য বিকৃত যৌনতা নিয়ে (তাদের ভাষায় ‘যৌন বৈচিত্র্য’ নিয়ে) সমাজে আলাপ তোলার জন্য ২০০৭ থেকে ব্র্যাক বিভিন্ন মিটিং, ওয়ার্কশপ এবং মতবিনিময় সভার আয়োজন করতে শুরু করে। বিষয়টাকে তারা উপস্থাপন করে মানবাধিকারের কাঠামোতে ফেলে। সমকামীতার সামাজিকীকরণের প্রচেষ্টাকে বলা হয় ‘যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার’ (Sexual And Reproductive Health & Rights -SRHR) নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা। ব্র্যাকের গবেষকদের ভাষায়,
“এই এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সুনির্দিষ্ট অনুপ্রেরণা আসে ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিসে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সভা থেকে। (এ নিবন্ধের) প্রথম লেখক এতে অনুপ্রাণিত হন এবং ঢাকায় ফিরে আসার পর আগ্রহী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে প্রথম পদক্ষেপ নেন। ২০০৭ এর জানুয়ারিতে একটি ছোট স্থানীয় ওয়ার্কশপ আয়োজন করেন তিনি।”[3]
মোট ত্রিশ জনের মতো গবেষক, সমকামী, এবং অ্যাকটিভিস্ট অংশগ্রহণ করে। আলোচনা হয় বাংলাদেশে সমকামীতা ও অন্যান্য বিকৃত যৌনতার সামাজিকীকণের কাজকে এগিয়ে নেয়ার সম্ভাব্য পদ্ধতি নিয়ে। নিবন্ধের ভাষ্যমতে,
“এই মিটিং থেকে উপলব্ধি ছিল যে নীরবতা সত্ত্বেও যৌনতার আলোচনাকে জনপরিসরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক উৎসাহ ও সমর্থন ছিল।“[4]
এই ওয়ার্কশপটির ফান্ডিং করে ব্রিটেনের DFID (Department of International Development), ওয়ার্কশপের বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত একটি প্রতিবেদন ব্রিটেনের সরকারী সাইটে বিদ্যমান আছে।[5]
প্রথম ওয়ার্কশপের সাফল্য থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছয় মাস পর ২০০৭ এর জুলাইয়ে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেইমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের উদ্যোগে ব্র্যাক সেন্টারে ‘জেন্ডার অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটি’ (লিঙ্গ ও যৌনতা) এর ওপর একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন করা হয়। কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান তুরস্ক, কেনিয়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন বক্তা ও অ্যাক্টিভিস্ট। আলোচনা হয় সমকামীদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসহ এলজিবিটি সংক্রান্ত নানা বিষয়ে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে আয়োজিত হবার কারণে এ কনফারেন্স ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। এনজিও, নারীবাদী এবং সমকামী গ্রুপের প্রতিনিধিদের পাশাপাশি এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করে দেশের পলিসিমেকার, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়ার সাথে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তি।
“যেহেতু কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্র্যাক সেন্টারে এবং আয়োজক ছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, তাই (কনফারেন্সের) বিষয়বস্তু বৈধতা এবং গ্রহণযোগ্যতা পায়। আমরা তাই নীতি নির্ধারক এবং প্র্যাকটিশানারদের (নারীবাদী, অ্যাক্টিভিস্ট, গবেষক, অ্যাকাডেমিক, মিডিয়া প্রফেশনাল, ছাত্র, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, এনজিও, সমকামী, লেসবিয়ান এবং ট্র্যান্সজেন্ডার) বিভিন্ন গ্রুপকে আমন্ত্রন জানানোর সিদ্ধান্ত নেই।“[6]
এই কনফারেন্সের অল্প কিছুদিন পর ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স হেলথ কোয়ালিশন (IWHC) নামে একটি এনজিও ব্র্যাকের জেইমস পি গ্র্যান্ট পাবলিক স্কুল অফ হেলথের সাথে যোগাযোগ করেজানায়, তারা বাংলাদেশে ‘যৌন অধিকার’ সংক্রান্ত কার্যক্রমে অনুদান দিতে আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্রের এই এনজিওটি জাতিসঙ্ঘের পপুলেশন ফান্ড (UNFPA) এবং বিশ্বব্যাংকের সাথে কাজ করে দীর্ঘদিন ধরে। এ প্রতিষ্ঠানের গভীর সম্পর্ক আছে অ্যামেরিকার রকাফেলার এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাথেও।[7] ইন্টারন্যাশনাল উইমেন্স হেলথ কোয়ালিশন (IWHC) এর দেয়া অনুদানের অর্থ দিয়ে তিনটি কর্মশালা আয়োজন করে ব্র্যাকের গবেষকরা। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশিক্ষণের জন্য আর তৃতীয়টি ছিল ফলোআপ। প্রশিক্ষণের তিন ধরণের মানুষকে টার্গেট করা হয়,
‘একটি গ্রুপ ছিল ঢাকার বাইরের অ্যাকাডেমিকরা। যাতে তারা ঢাকার বাইরে যৌনতা প্রচারসংক্রান্ত কার্যক্রম (sexuality dissemination activities) ডেভেলপ করতে উৎসাহিত হন এবং ঢাকার বাইরের অ্যাকাডেমিক ও ছাত্রদের আলোচনা করার জায়গা করে দেন…
আরেকটি গ্রুপ ছিল সাংবাদিক এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা। যাতে করে তারা যৌনতা নিয়ে লিখতে উৎসাহিত হন এবং মিডিয়া ও বিজ্ঞাপনে যৌনতার নির্মান এবং উপস্থাপনা (এবং যথাযথ উপস্থাপনার অনুপস্থিতি) নিয়ে আলোচনা করেন…
তৃতীয় গ্রুপটি ছিল এলজিবিটি সম্প্রদায়, যারা মূলত ছিল আন্ডারগ্রাউন্ড। (বাংলাদেশে) কেবল অল্প কিছু এমএসএম এবং ট্র্যান্সজেন্ডার গ্রুপ আছে যারা এইচআইভি/এইডস সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে কাজ করে। (তাদের টার্গেট করার) উদ্দেশ্য ছিল এই non-conforming যৌন গ্রুপগুলোকে সক্ষমতা ও জায়গা করে দেয়া, যাতে তারা তাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে লড়াই করার জন্যে নিজস্ব এজেন্ডা গঠন, প্রশিক্ষণ, অ্যাডভোকেসি করতে পারে।[8]
অর্থাৎ একদিকে ব্র্যাক অ্যাকাডেমিক ও মিডিয়ার লোকজনকে এলজিবিটির পক্ষে কথা বলতে উৎসাহিত করছিল, অন্যদিকে সমকামীদের বিভিন্ন সংগঠনকে দিচ্ছিল কাজ করার সুযোগ ও প্রশিক্ষণ।
বিস্তার:
ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে কার্যক্রম। ২০০৭ সালের কনফারেন্সের আলোচনার নির্যাস বুকলেট আকারে ছাপিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় সারা বাংলাদেশের ১৫০ জন ‘স্টেকহোল্ডারের’ কাছে। যৌন অধিকার নিয়ে কোন ধরণের গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিৎ তা নিয়ে আলোচনার জন্য ২০০৮ সালে অ্যাকাডেমিক, এলজিবিটি সমর্থক এবং বিভিন্ন স্থানীয় সংস্থার সদস্যদের নিয়ে একটি মিটিং করে ব্র্যাকের গবেষকরা। এরই ধারাবাহিকতায় এলজিবিটি ইস্যু নিয়ে আরও গোছানো এবং সমন্বিতভাবে কাজ করার জন্য ২০০৮ সালে ব্র্যাকের জেইমস পি গ্র্যান্ট পাবলিক হেলথ স্কুল আলাদা একটি সেন্টার বা কেন্দ্র তৈরি করে, যার নাম Centre of Excellence for Gender, Sexual and Reproductive Health Rights। এই কেন্দ্র তৈরির ফান্ডিং আসে জাতিসংঘের একটি সংস্থার কাছ থেকে।[9]
২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়টার কাজকর্মের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে আলোচ্য প্রবন্ধ থেকে,
“এই পুরো সময় জুড়ে,আমরা বিভিন্ন ছোট ছোট মিটিং এবং ফোরাম শুরু করি। আমরা যৌন বৈচিত্র্যের ওপর কিছু সিনেমা (প্রদর্শনের) আয়োজন করি। অংশীদারদের এবং ছাত্রদের আমন্ত্রন জানাই। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা-র ধারার তাৎপর্য নিয়েও একটি মিটিং আয়োজন করি আমরা। সম্প্রতি দক্ষিন এশিয়া জুড়ে এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্য একটি দক্ষিণ এশীয় নেটওয়ার্ক নিয়েও আমরা মিটিং আয়োজন করেছি।”[10]
ব্র্যাকের কার্যক্রম এবং নেটওয়ার্কিং এর প্রভাব ছড়িয়ে যেতে থাকে সাড়া বাংলাদেশ জুড়ে। ২০০৭ এর কনফারেন্স এবং ২০০৯ এর কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে ঢাকার বাইরের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমকামীতা ও অন্যান্য বিকৃত যৌনাচারের অধিকার নিয়ে সংক্ষিপ্ত কোর্স বা মডিউল চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন তারা। আগ্রহ দেখান নিজ নিজ অঞ্চলে যৌন বিকৃতির অধিকার নিয়ে আলাদা কনফারেন্স আয়োজনেও। অ্যাকাডেমিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের, বিশেষ করে ঢাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কিছু শিক্ষার্থী এলজিবিটি সামাজিকীকরণ সংক্রান্ত কার্যক্রমের এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে পড়ে।
মিডিয়াতে সমকামীতাকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার দিকেও মনোযোগী হয় ব্র্যাকের গবেষকরা। এ জন্য অভিনব এক কৌশল গ্রহণ করে তারা। এ কৌশলের ব্যাপারে তাদের নিজেদের মুখ থেকে শোনা যাক,
“এছাড়া, যৌনতা এবং অধিকার নিয়ে স্থানীয় ও আঞ্চলিক পত্রপত্রিকাতে সাংবাদিকদের লেখালেখি করতে উৎসাহিত করার জন্য আমরা প্রকাশিত প্রতিটি নিউস আইটেম বা গল্পের জন্য সামান্য কিছু আর্থিক পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা চালু করি। প্রাথমিক প্রতিবেদনগুলো ইঙ্গিত করে যে অন্তত পাঁচজন আঞ্চলিক সাংবাদিক যৌনতা এবং অধিকারের উপরে লিখেছেন, এবং সেগুলো স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আর একজন সাংবাদিক রেডিওতে প্রচার করার জন্য একটি গল্প তৈরি করেছেন।” [11]
‘আর্থিক পুরস্কার’ এর মাধ্যমে এলজিবিটি আন্দোলনের পক্ষে ইতিবাচক লেখালেখি এবং সংবাদ প্রকাশের এই পদ্ধতি পরবর্তীতে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটিও কাজে লাগাবে বাংলাদেশে ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রচারণায়।
প্রভাব:
ব্র্যাকের উদ্যোগ বাংলাদেশের এলজিবিটি আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর আগে সমকামী তথা এলজিবিটি আন্দোলনের কার্যক্রম চলছিল ‘এইডস প্রতিরোধ’ আর ‘সচেতনতা’ সংক্রান্ত কার্যক্রমের আড়ালে। কাজ হচ্ছিল যৌন স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য সেবার ব্যানারে। ব্র্যাক এসে কাজ শুরু করে মানবাধিকারের কাঠামোকে সামনে রেখে। সরাসরি সমকামী শব্দটা ব্যবহার না করে জোর দেয় ‘যৌন অধিকার’, ‘যৌন বৈচিত্র্য’, ‘যৌন শিক্ষা’ এবং ‘জেন্ডার আইডেন্টিটি’র মতো পরিভাষার ওপর। যদিও ঘুরেফিরে এই সব বুলির পেছনে মূল বক্তব্য এক – যৌন বিকৃতির সামজিকীকরণ ও বৈধতা। ব্র্যাকের কর্মপদ্ধতি এলজিবিটি এজেন্ডা প্রতিষ্ঠা নিয়ে জনপরিসরে আলাপ তোলার কাজটা এগিয়ে নিয়ে যায় অনেক দূর।
ব্র্যাকে কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি এবং ফলাফল নিয়ে তাদের নিজেদের মূল্যায়ন দেখা যাক। ২০০৭ সালে শুরু করা কার্যক্রমের ব্যাপারে তাদের নিবন্ধে বলা হয়েছে,
“...(এ উদ্যোগের) লক্ষ্য ছিল যৌনতা এবং অধিকার নিয়ে জনপরিসরে বিতর্ক উত্থাপন করা এবং (বাংলাদেশের) চ্যালেঞ্জিং প্রেক্ষাপটে নীতি নির্ধারকসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্টেইকহোল্ডারদের সামনে বৈষ্যমের মতো ইস্যুগুলোকে আরও দৃশ্যমান করে তোলা।“[12]
অর্থাৎ তাদের নিজেদের বক্তব্য অনুযায়ীই- ব্র্যাকের কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল জনপরিসরে সমকামীতা এবং অন্যান্য যৌন বিকৃতির (তাদের ভাষায় ‘যৌনতা ও অধিকার’) আলাপ তোলা, এবং নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে যৌন বিকৃতির সামাজিকীকরণ। আর এই কাজটা তারা করেছে অধিকারের বুলি ব্যবহার করে। তাদের ভাষায়,
“…ইতিবাচক এবং মানবাধিকারের ফ্রেইমিং ব্যবহার করে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে যৌনতা নিয়ে আলোচনা শুরু করার জন্য (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা) টিমটি বিভিন্ন মিটিং, ওয়ার্কশপ, ফোরাম এবং জনসংলাপের আয়োজন করেছে…।“[13]
এক্ষেত্রে ঢাল হিসেবে কাজ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও হিসেবে ব্র্যাকের পরিচয় ও প্রভাব। পাশাপাশি পুরো ব্যাপারটাকে মুন্সিয়ানার সাথে দেখানো হয়েছে ‘নিরীহ’ গবেষনা হিসেবে। ‘সমকামীতার বৈধতা চাই’ বলা হলে যেভাবে বাঁধা তৈরি হতো ‘গবেষণা’র ক্ষেত্রে তা হয়নি, বরং এভাবে তুলে ধরার ফলে অনেকের কাছে বিষয়টা গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় এবং এলজিবিটি অ্যাক্টিভিসমকে সমকামীতার মোড়কে উপস্থাপন করার ইতিবাচক দিকের কথা উল্লেখ করে এ নিবন্ধে বলা হয়েছে,
“…এটি অনুভূত হয়েছিল যে, (একটি বিশ্ববিদ্যালয়) এর জনস্বাস্থ্য অনুষদ হিসাবে এই ধরণের ভূমিকা পালনে অ্যাকাডেমিক বৈধতার দিক থেকে আমরা ভাল অবস্থানে ছিলাম…”[14]
এই উদ্যোগের ফলে কী কী অর্জিত হয়েছে তার আলোচনা করতে গিয়ে ব্র্যাকের গবেষকরা তিনটি কাঠামোগত ক্ষেত্রে অগ্রগ্রতির কথা উল্লেখ করেছেন।
- প্রথমত, এই উদ্যোগের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বিভিন্ন মানুষকে একত্রিত করা গেছে যারা নিজেদের অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে (যেমন মিডিয়ার লোকজন)। এতে ‘যৌনতা এবং অধিকারের’ (পড়ুন, এলজিবিটি এজেন্ডা বাস্তবায়নের) জন্য সমর্থনের ভিত্তি মজবুত এবং প্রসারিত হয়েছে।
- দ্বিতীয়ত, এই উদ্যোগের ফলে মিডিয়া, সমকামী অ্যাক্টিভিস্ট, গবেষক এবং এলজিবিটি গ্রুপগুলোর মধ্যে ‘মৈত্রী’ এবং ‘অংশীদারিত্বের সম্পর্ক’ গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে তাদের একত্রিত হবার এবং আলোচনার করার প্ল্যাটফর্ম ও জায়গা করে দিয়েছে ব্র্যাক ।
- তৃতীয়ত, এই উদ্যোগের মাধ্যমে জনপরিসরে এলজিবিটি সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে আরও খোলামেলাভাবে কথা বলার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যা যৌনতার ব্যাপারে সামাজিক চিন্তা এবং নিয়মগুলো পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।[15]
ব্র্যাকের এই গবেষকরা তাদের কাজের ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,
“আমরা দেখেছি যে এলজিবিটি গ্রুপ, গবেষক, অ্যাকাডেমিক, এনজিও, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী, সাংবাদিক এবং নীতিনির্ধারকদের মতো বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের একত্রিত করে, জনপরিসরে যৌনতার উপস্থাপনাকে সফলভাবে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে, বাংলাদেশের মতো রক্ষনশীল এবং চ্যালেঞ্জিং পরিবেশেও যৌনতা এবং অধিকার নিয়ে জনপরিসরে জায়গা তৈরি করা এবং আলাপ তোলা সম্ভব।”[16]
এই ‘অবদানের’ স্বীকৃতিও পায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৩ সালে বিলিয়েনেয়ার জর্জ সরোসের ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন ১ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল তৈরি করে। এই তহবিলের জন্য পৃথিবীর ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়কে মনোনীত করা হয় যার মধ্যে একটি ছিল ব্র্যাক।[17]
এরপর থেকে ‘যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার’ নিয়ে ব্র্যাকের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হয়েছে। উল্লেখ্য জর্জ সরোস বর্তমান পৃথিবীতে এলজিবিটি আন্দোলনের পেছনে সবচেয়ে বড় দাতাদের একজন।
***
ব্র্যাকের উদ্যোগের পর ক্রমশ বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলনের গতি বাড়তে থাকে। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্র্যাকের আনা মানবাধিকার ও ‘যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার’-এর আলাপ তাদের প্রচারণা এবং কার্যক্রমের মধ্যে যুক্ত করে নেয়। মিডিয়া, অ্যাকাডেমিক এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এলজিবিটি এজেন্ডার সমর্থনে কিছু মানুষ তৈরি হয়। পাশাপাশি বিকৃত যৌনতায় লিপ্ত লোকেরা অ্যাডভোকেসি এবং অ্যাকটিভিসম সংক্রান্ত জরুরী প্রশিক্ষণ পায় ব্র্যাকের ওয়ার্কশপগুলোতে। সক্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন এলজিবিটি সংগঠন। এদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ আগ্রহী হয় বাংলাদেশে প্রকাশ্যে সমকামী আন্দোলন শুরু করার প্রতি। আর এভাবে শুরু হয় বাংলাদেশের এলজিবিটি আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়।
[1] Hossain, Adnan. “Section 377, same-sex sexualities and the struggle for sexual rights in Bangladesh.” Austl. J. Asian L. 20 (2019): 115.
[2] Rashid, Sabina Faiz, Hilary Standing, Mahrukh Mohiuddin, and Farah Mahjabeen Ahmed. “Creating a public space and dialogue on sexuality and rights: a case study from Bangladesh.” Health Research Policy and Systems 9, no. 1 (2011): 1-9.
[3] Ibid, p 4
[4] Ibid
[5] https://www.gov.uk/research-for-development-outputs/summary-report-sexuality-and-rights-workshop-january-2007
ওয়ার্কশপের সামারি রিপোর্টের পিডিএফ – https://assets.publishing.service.gov.uk/media/57a08ba8ed915d622c000e07/monograph_sexualityrights.pdf
[6] Rashid et al, Creating, p 4
[7] আইডাব্লিউএইচসি-র প্রতিষ্ঠাতা দুইজন, জোঅ্যান ডানলপ (Joan Dunlop) এবং অ্যাড্রিয়েন জার্মেইন (Adrienne Germain)। প্রথম জন এই প্রতিষ্ঠান শুরুর আগে রকাফেলার ফাউন্ডেশনে কাজ করতো। দ্বিতীয় জন কাজ করতো ফোর্ড ফাউন্ডেশনে। আইডাব্লিউএইচসি বিভিন্ন সময়ে রকাফেলার এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানও পেয়েছে।
[8] Rashid et al, Creating, p 4
[9] “In 2008, I established a Centre for Gender and Sexual and Reproductive Health and Rights with seed funding from a UN organization, pushing for laws to stop child marriage; providing a safe space for LGBTQI communities and working to develop online resources on sensitive topics that bypass traditional gatekeepers such as parents and teachers.”
[10] Rashid et al, Creating, p 5
[11] Ibid, p 7
[12] Ibid, p 1
[13] Ibid, p 2
[14] Ibid, p 3
[15] Ibid, p 7
[16] Ibid, p 7
[17] The Buinesss Standard, Brac Uni to be early recipient from Soros’s $1 billion fund, 2020
https://www.tbsnews.net/bangladesh/education/brac-uni-be-early-recipient-soross-1-billion-fund-39805