বলুন তো ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী অ্যাথলিটের নাম কী?
মেসি? লেব্রন জেইমস? টাইগার উডস? রোনালদো?
না। সঠিক উত্তরের জন্য আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। প্রায় দু হাজার বছর পেছনে। ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী অ্যাথলিট হল গায়াস অ্যাপুলেইয়াস ডায়োক্লিস নামের এক স্প্যানিয়ার্ড। ডায়োক্লিসের পছন্দের খেলা ছিল রথচালনা – আজকের ফর্মূলা ওয়ান রেইসিং এর মতো, শুধু গাড়ির বদলে ঘোড়ায় টানা রথ দিয়ে। প্রাচীন রোমের এই সেলিব্রিটি সারথি ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে আয় করেছিল প্রায় সাড়ে তিন কোটি রোমান সিস্টার্সিস। আজকের বাজারে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার।
দেখা যাচ্ছে দক্ষ ও জনপ্রিয় খেলোয়ারদের পেছনে টাকার পাহাড় ওড়ানোর প্রবণতা বরং বেশ পুরনো। কিন্তু কেন? খেলা আর খেলোয়ারের পেছনে এতো টাকা ওড়ানোর পেছনে কারণ কী? নিছক বিনোদন? সস্তা, সাময়িক উত্তেজনার জন্য খরচটা একটু বেশি হয়ে গেল না?
মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শরীরের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল তার চিন্তা ওপর কবজা। এই চিন্তাকে নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য রোমের রাজনীতিবিদরা বের করেছিল চমৎকার এক বুদ্ধি। জাকজমকপূর্ণ বিশাল সব স্পোর্টিং ইভেন্টস। কোন অসন্তোষ দেখা দিলেই নতুন কোন উত্তেজক ইভেন্ট হাজির করতো শাসকেরা। উদ্দেশ্য – গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো থেকে মানুষের মনোযোগ সরিয়ে রাখা, সহজলভ্য বিনোদনের বন্যায় অনুভূতিগুলোকে অবশ করে দেয়া। গ্ল্যাডিয়েটর টুর্নামেন্ট, চ্যারিয়ট রেইসিং, ড্যামনেশিও অ্যাড বিসটিয়াস – বিশ্বকাপ, লা লিগা, ফর্মুলা ওয়ান, টি-টোয়েন্টি, ইউএফসি। ব্রেড অ্যান্ড সার্কাসেস।
রোমান সাম্রাজ্যের সাথে, বিশেষ করে এ সাম্রাজ্যের অবনতির পর্যায়ের সাথে আমাদের এ সভ্যতার বেশ অনেকগুলো মিল আছে। অধিকারগুলো যখন ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে আসে, যখন আইনের শাসনের মৌলিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে, ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য, অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে, মানুষ যখন ফুঁসতে থাকে রাগে, যখন মিডিয়ার মায়াজালের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয় – তখনই সম্রাট হাজির হয়ে যায় নতুন কোন কলৌসিয়াম, নতুন কোন বিশ্বকাপ, নতুন কোন গ্ল্যাডিয়েটর, নতুন কোন ইভেন্ট, স্ক্যান্ডাল কিংবা মুভি নিয়ে। খরচ করা হয় লক্ষ কোটি টাকা।
বাস্তবতাকে মিউট করে সভ্যতার দাসেরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বোকা বাক্সের দিকে চেয়ে থাকে। শক্ত করে দরজা-জানালা বন্ধ করে, নরম গদিতে আধশোয়া হয়ে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হয় কল্পনার রাজ্যে। যেখানে আর্জেন্টিনা হারলে মানুষের আত্মহত্যা, জমি বিক্রি করে জার্মানির পতাকা, নিয়ম করে নব্বই মিনিট দৌড়ে বেড়ানো ছোকরার পেছনে ওড়ানো কোটি কোটি ডলার, জেনোসাইডকে ছাপিয়ে যাওয়া খেলা, কুকুরের মতো রাস্তায় মার খাওয়া ছাত্রদের ছাপিয়ে বিশ্বকাপ ড্রিম টিম বানানো অ্যাপ, আর পুরো বিশ্বকে ভুলে গিয়ে ‘টাইগারদের বিজয়’ নিয়ে উল্লাস অর্থবোধক হয়। পরিতৃপ্তি দেয়।
মানুষ আর মানুষ থাকে না, পরিণত হয় তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে আচ্ছন্ন, উন্মত্ত ফ্যান আর দর্শকে। সত্য শোনার সময় তাদের হয় না। ইচ্ছে হয় না চোখ খুলে বাস্তবতাকে দেখার, চিন্তা করার, পরোয়া করার। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে অবহেলা ভরে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় মুক্তির পথ থেকে। সে নিয়ন্ত্রিত হয়, ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত হতে হতে ব্যবহৃত হওয়াতেই আনন্দ খুঁজে পায়, খুঁজে পায় জীবনের উদ্দেশ্য। বিনোদন পরিণত হয় অস্তিত্বে, মানসিক দাসত্ব টিকিয়ে রাখার সাম্রাজ্যের নিপুন হাতিয়ারে।
ব্রেড অ্যান্ড সার্কাসেস।
ভোগ আর শরীরের সাধন। মনোরঞ্জন – বিক্ষিপ্ত, অবশ আর অন্ধ করার। সভ্যতার অধঃপতন।