ব্রুনেই-এর সমকাম বিরোধী আইন এবং নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার


মাফিয়া বা কোসা নোস্ট্রার কিছু অলিখিত নিয়ম বা কোড আছে। যতো তুচ্ছ বিষয়ই হোক, এ নিয়মের বাইরে যাওয়া যায় না। মহল্লার সবচেয়ে গরীব সবজি বিক্রেতা চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে একজন মাফিয়া গডফাদারের সেটা নিয়ে চিন্তা করার কোন কারণ নেই। সবজিওয়ালার অল্প কিছু টাকা নেয়া না নেয়াতে তার কিছু যায় আসে না। কিন্তু কোড বলে বিরোধিতা যতো ছোটই হোক সেটাকে দমন করতে হবে শক্ত হাতে। এক সবজিওয়ালার অস্বীকৃতি যদি আরো দশজনকে উদ্বুদ্ধ করে? তাই গডফাদারের নির্দেশে তুচ্ছ সবজি বিক্রেতাকে শাস্তি পেতে হয়। টাকাটা এখানে মুখ্য না, গুরুত্বপূর্ণ হল মেসেজটা – যদি মাফিয়ার বিরুদ্ধে যাও, তাহলে শাস্তি পেতে হবে।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় কোন দেশ অ্যামেরিকান নিয়ন্ত্রণ বলয়ের বাইরে চলে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও, শক্ত হাতে তাদের দমন করা হতো। সেই দেশ যতো ছোট, অ্যামেরিকা থেকে যতো দূরেই হোক না কেন। অ্যামেরিকান মিডিয়ার তোলপাড় শুরু হয়ে যেতো, অমুক দেশ অ্যামেরিকার বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেছে। এখানেও কাজ করতো সেই একই নীতি। একই কোড। অবাধ্যতা, বিরোধিতা, ছকের বাইরে যাওয়া – তা যতো তুচ্ছ ব্যাপারেই হোক – শক্ত হাতে দমন করতে হবে।

অ্যামেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সাথে মাফিয়ার অনেক মিলের মধ্যে এটা হল একটা।

প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে বিশাল এক কোঅর্ডিনেইটেড মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে ব্রুনেই এর বিরুদ্ধে। নিউইয়র্ক থেকে ঢাকা পর্যন্ত পত্রিকাগুলো বলে যাচ্ছে একই সুরে, একই ধাচে, একইধরণের কথা। মিডিয়ার এতো ক্ষুব্ধ হবার কারণ হল ব্রুনেই সমকামীদের জন্য রজমের বিধান জারি করেছে। ব্যস এটুকুই। মাত্র ১৯৮৪ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ব্রুনেইকে এখনো পশ্চিমা শক্তিগুলোর একটা কলোনি বলা যায়। সামরিক সেন্সে না হলেও অর্থনৈতিক সেন্সে তো অবশ্যই। কোন দিক থেকে ব্রুনেই পশ্চিমের জন্য কোন ধরণের হুমকি না। তবুও শুধু এই এক আইনের জন্য ফিরিঙ্গিদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। লেলিয়ে দিয়েছে তাদের মিডিয়ার প্রশিক্ষিত কুকুরের দলকে।

এখানেও সেই একই কোড। ছকে বাইরে কেউ যেতে পারবে না। যখন র‍্যান্ড কর্পোরেইশানের মতো অ্যামেরিকান থিংক ট্যাংকগুলো একের পর এক পলিসি পেইপার বানিয়ে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে মুসলিমদের গণতন্ত্রের দিকে এবং শরীয়াহ প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে সরিয়ে আনতে চাচ্ছে, তখন কোন মুসলিম ভূখন্ডের শাসকের এধরণের সিদ্ধান্ত অবশ্যই তাদের পছন্দ হবার কথা না। এখন তো আর আগের মতো আর্মি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার সেই দিন নেই, বিশেষ করে ইরাক আর আফগানিস্তানে গো-হারা হারার পর, তাই এখন আগ্রাসন চলছে মিডিয়ার দিক থেকে।

ব্রুনেই এর শাসকগোষ্ঠীর ব্যাপারে যা জেনেছি তা থেকে সমর্থন করার মতো কিছু পাইনি। চোখে পড়েনি আরব শাসকদের সাথে মৌলিক তেমন কোন পার্থক্য। কিন্তু আজ মিডিয়ার দিক থেকে যে বিরোধিতা করা হচ্ছে সেটার কারণ ব্রুনেই কিংবা এর শাসকগোষ্ঠী না। সুলতানের হেরেমে কতো মেয়ে আছে, সেটাও আসলে ইস্যু না। নিজেদের লাভ থাকলে খোদ ট্রাম্প কিংবা অ্যামেরিকান কংগ্রেসের যেকোন সদস্য হাসিমুখে, খুশিমনে নিজের স্ত্রী কিংবা মেয়েকে সুলতানের হেরেমে পাঠিয়ে দিতে পারে। লম্পট পশ্চিম আর তাদের আরো লম্পট মুক্তমনা বাদামী চামড়ার আদর্শিক জারজদের কাছ থেকে এই ইস্যুতে নৈতিকতার বুলি শোনাটা হাস্যকর। এগুলো সবকিছুই অপ্রাসঙ্গিক।

এখানে বিরোধিতার মূল কারণ হল শরীয়াহ। পশ্চিমা মিডিয়া এবং বিশ্বজুড়ে পশ্চিমা চিন্তার লোকেরা উঠেপড়ে ব্রুনেইয়ের বিরোধিতা করছে কারণ ব্রুনেই একটা দিকে অল্পস্বল্প হলেও শরীয়াহ পালনের চেষ্টা করছে। সিম্পল অ্যায দ্যাট।

তাই ব্রুনেই এর সুলতান কিংবা শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন না করলেও পশ্চিমা, সেক্যুলার, মুক্তমনা এবং পশ্চিমের অনুকরণে ব্যস্ত হয়ে সমালোচনায় সুর মেলানো মডারেট মূর্খদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা এ সিদ্ধান্তকে ডিফেন্ড করি। ঠিক যেমন সাউদি রাজপরিবারের প্রতি বিন্দুমাত্র সমর্থন না থাকলেও কেউ যদি চুরি, যিনা কিংবা হত্যার ব্যাপারে সাউদি আরবের পেনাল কোডের বিরোধিতা করে তখনো আমরা সেটাকে ডিফেন্ড করি। এর উদ্দেশ্য শাসকগোষ্ঠীকে ডিফেন্ড করা না, বরং শরীয়াহর বিধানের পক্ষে কথা বলা। একইভাবে আমরা এটাও মনে করি না যে ব্রুনেই আজকে সমকামীদের বিরুদ্ধে রজম করতে শুরু করলে কাল দুনিয়াজুড়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। পৃথিবীতে কেউ এমনটা ভাবতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

কিন্তু যখন প্রকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন এবং মুসলিমদের হীনমন্যতা এতো তীব্র পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তথাকথিত ‘ইসলামিস্ট’ আর ‘স্কলার’-রাও নানান ধরণের বাতেনী ব্যাখ্যা দিয়ে শরীয়াহ প্রতিষ্ঠার বিষয়টাকে হয় অকার্যকর, অথবা মুলতবি অথবা ভুলে যেতে চাইছে, তখন এধরণের একটা ঘটনা ইতিবাচক। কোন দীর্ঘমেয়াদী স্ট্র্যাটিজিক সেন্সে না। শরীয়াহর এবং ইসলামের প্রতি পশ্চিমা বিশ্ব এবং সাদা-কালো-বাদামী-হলুদ সবরকমের চামড়ার মুক্তমনা, সেক্যুলারদের সহজাত বিদ্বেষের কথা মুসলিমদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য। এটা বোঝার জন্য খুব সুক্ষ বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না, বরং যাদের বুদ্ধি সুক্ষ হতে হতে বাতাসে মিলিয়ে গেছে তারা বাদে বাকি সবাই ইন্সটিংক্টিভলি এটা বুঝতে পারছে।

এ পুরো ফিয়াস্কো আমাদের একটা বিষয় ভালোমতো বুঝে নেয়া দরকার। দেখুন কলোনিয়াল পশ্চিমা শক্তিগুলোর মোটামুটি আজ্ঞাবহ একটা সরকারও যখন শরীয়াহর অল্প একটু অংশ বাস্তবায়ন করতে যায় তখন কিভাবে তাদের বিরোধিতা করা হচ্ছে। মিডিয়া কতো হিংস্রভাবে একের পর এক প্রপাগ্যান্ডা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে। কিভাবে রাতারাতি এতো দিনের বিশ্বস্ত মিত্রকে আজ একসাথে লম্পট, বর্বর, স্বৈরাচার বানিয়ে দিয়েছে।

এবার তাহলে চিন্তা করে দেখুন যারা আসলেই পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা, নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সর্বাত্বক চেষ্টা করে পরিপূর্ণ শরীয়াহ বাস্তবায়নের, পশ্চিমা মিডিয়া এবং তাদের দেশীয় তোতাপাখিরা কিভাবে তাঁদের উপস্থাপন করবে? কিংবা গত প্রায় ২০ বছর ধরে করছে?

ভাবুন। সময় নিয়ে ভাবুন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *