২০০ টি মার্বেল নিন। প্রতিটির গায়ে ১, ২, ৩… এভাবে একটি করে সংখ্যা লিখুন। একটা বড় টেবিল নিন। টেবিলে ২০০টি মার্বেল সাইযের গর্ত করুন। প্রতিটি গর্তের জন্য একটি করে সংখ্যা অ্যাসাইন করুন।
এখন আপনার কাছে ১-২০০ লেখা ২০০টি মার্বেল এবং টেবিলে ২০০টি গর্ত আছে। মার্বেলগুলোকে টেবিলে ছুড়ে দিন। প্রতিটি মার্বেলের কোন না কোন গর্তে পড়ার সম্ভাব্যতা কত? আর প্রতিটি মার্বেল গর্তে পড়বে এবং মার্বেলের গায়ে যে নাম্বারটি লেখা সেই নাম্বারের গর্তেই পড়বে (অর্থাৎ ১ লেখা মার্বেল পড়বে ১ লেখা গর্তে, ২ লেখা মার্বেল পড়বে ২ লেখা গর্তে – এভাবে ২০০ পর্যন্ত) – এর সম্ভাব্যতা কত? আচ্ছা যদি আপনি ২০০ বার এই কাজটা করেন, অর্থাৎ মার্বেল ছুড়ে দেন, তাহলে দুইশবারই এই ভাবে সঠিক নাম্বারের গর্তে সঠিক নাম্বারের মার্বেল পড়ার সম্ভাব্যতা কত?
হিসেবটা করতে থাকুন। ততক্ষণে আসুন অবিশ্বাসের বিশ্বাস নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যাক।
হাবল টেলিস্কোপের ডেইটার ভিত্তিতে ধারণা করা হয় দৃশ্যমান মহাবিশ্বে (বা মহাবিশ্বের যতোটুকু আমরা দেখতে সক্ষম হয়েছি) গ্যালাক্সির সংখ্যা ২০০ বিলিয়ন। (যদিও সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা অনুযায়ী সংখ্যাটা আরো দশগুণ বেশি হতে পারে[1]) নাসার ভাষ্যমতে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সীতে গ্রহের সংখ্যা ১০০ বিলিয়ন। আর দৃশ্যমান মহাবিশ্বে গ্রহের সংখ্যা হল কারও মতে ১ অক্টলিয়ন = ১ এর পর ২৭টি শূন্য, আর কারও মতে ১ সেপ্টিলিয়ন = ১ এর পর ২৪টি শূন্য । (তবে মহাবিশ্বে গ্যালাক্সীর সংখ্যা যদি ২০০ বিলিয়নের জায়গায় ২০০০ বিলিয়ন হয় তাহলে গ্রহের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে।)
ষাটের দশকে ধারণা করা হত, কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার জন্য শুধু দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের প্রয়োজনঃ
১) সঠিক ধরনের নক্ষত্র (star), এবং
২) সেই সঠিক ধরনের নক্ষত্র থেকে সঠিক দূরত্বে অবস্থিত একটি গ্রহ।
সঠিক ধরনের নক্ষত্র বলার কারন হল যে কোন ধরনের নক্ষত্র হলেই তা প্রাণের জন্য সহায়ক হবে না। আর সঠিক দূরত্ব বলার কারন হল, প্রাণের জন্য গ্রহের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট রেইঞ্জের মধ্যে থাকতে হবে। তাই যদি কোন গ্রহ, নক্ষত্রের খুব বেশি কাছে বা খুব বেশি দূরে হয় তাহলে সেই গ্রহের তাপমাত্রা প্রাণের জন্য সহায়ক হবে না। অর্থাৎ কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার জন্য এই দুটি চলকের (variable) নির্দিষ্ট (অথবা নির্দিষ্ট রেইঞ্জের মধ্যে) মান থাকা আবশ্যক।
এটা ছিল ষাটের দশকের ধারণা। অ্যাস্ট্রোনমার কার্ল স্যাইগান ১৯৬৬ প্রথম এই ধারনার কথা ঘোষণা করেন। স্যাইগান এবং তার রিসার্চ টিম হিসেব করে দেখেছিলেন এই দুটো প্যারামিটার অনুযায়ী মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রের (Star) মধ্যে ০.০০১% নক্ষত্রের পক্ষে প্রাণের জন্য সহায়ক হওয়া সম্ভব। স্যাইগানের ভাষায় –
“মহাবিশ্বে গ্রহ আছে ১ অকটিলিয়নের মতো – অর্থাৎ একের পর ২৪টি শূন্য। সুতরাং প্রাণের জন্য সহায়ক গ্রহের সংখ্যা হওয়া উচিৎ ১ সেপটিলিয়নের মতো – অর্থাৎ ১ এর পর ২১টি শূন্য[2]।”
পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতকে প্রাণের অস্তিত্বের জন্য আবশ্যক এরকম আরো দুইশটি প্যারামিটার/চলক খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা । অর্থাৎ স্যাইগানের দাবিমতো ২টি নয়, বরং কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের জন্য ২০০টির মত চলকের সুনির্দিষ্ট মান থাকা আবশ্যক।
এরকম কিছু প্যারামিটারের উদাহরণ দেওয়া যাক। যেকোন ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি প্রাণের জন্য সহায়ক হবে না। গ্যালাক্সাটিকে একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি হতে হবে (যেমন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি)। গ্যালাক্সিটিকে একটি নির্দিষ্ট আকারের হতে হবে, তার চাইতে বড় কিংবা ছোট হলে হবে না। গ্যালাক্সিটিকে একটি নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে।
স্যাইগানের দুটো প্যারামিটারের সাথে শুধু এই নতুন প্যারামিটারগুলো বসাবার পরই হিসেব থেকে মহাবিশ্বের মোট গ্যালাক্সির প্রায় ৯০ শতাংশকে বাদ দিতে হয়।
এছাড়া শুধু নির্দিষ্ট ধরনের গ্যালাক্সিতে সঠিক ধরনের নক্ষত্র হলেই হবে না, সেই নক্ষত্রকে ঐ স্পাইরাল গ্যালাক্সির সঠিক অঞ্চলে অবস্থিত হতে হবে। নক্ষত্রের আকার একটি নির্দিষ্ট রেইঞ্জের মধ্যে হতে হবে, তার ভর একটি নির্দিষ্ট রেইঞ্জের মধ্যে হতে হবে। শুধু তাই না, প্রাণের জন্য সহায়ক হতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ধরনের সৌরজগত লাগবে, নির্দিষ্ট ধরনের গ্রহ লাগবে, নির্দিষ্ট ধরনের উপগ্রহ লাগবে, ঐ গ্রহের আশেপাশের গ্রহগুলোকে কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে হবে। এভাবে লিস্ট লম্বা হতেই থাকে।
এরকম আরো কিছু প্যারামিটারের জন্য দেখতে পারেন –
http://www.reasons.org/articles/fine-tuning-for-life-on-earth-june-2004
http://www.konkyo.org/English/DoesLifeExistOnAnyOtherPlanetInTheUniverseAnotherLookAtSETI
মনে রাখবেন স্যাইগানের দুটো প্যারামিটারের কারনে মহাবিশ্বের সব নক্ষত্রের (Star) মধ্যে প্রাণের জন্য সহায়ক হওয়া সম্ভব এমন নক্ষত্রের সংখ্যা নেমে এসেছিলে ০.০০১% -এ। দুশোটা প্যারামিটারের জন্য হিসেবটা কি হবে?
অ্যাস্ট্রোফিযিসিস্ট ডঃ হিউ রসের হিসেব অনুযায়ী ৩২টি প্যারামিটার জন্য, অর্থাৎ কোন একটি গ্রহের ৩২ টি প্যারামিটার পূর্ণ করার সম্ভাবনা হল ১/১ ট্রেডেকসিলিয়ন [১ ট্রেডেকসিলিয়ন = ১ এর পর ৪২টি শূন্য]। অবশ্যই ডঃ রসের হিসেব সম্পর্কে আপত্তি তোলা যেতে পারে। কারন কোন নির্দিষ্ট প্যারামিটারের জন্য তার এস্টিমেশানের হয়তো অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে মিলবে না। কিছু প্যারামিটারের ক্ষেত্রে হয়তো অন্যান্য বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্যতার মানকে ভিন্ন ভাবে ধরবেন। কিন্তু তাতেও এই সত্যটা বদলায় না যে এই মহাবিশ্বের কোন একটি গ্রহে প্রাণের বিকাশের জন্য (জটিল ও বুদ্ধিমান প্রাণের কথা বাদই দিলাম) বিস্ময়কর ধরনের সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটের প্রয়োজন। কাকতালীয়ভাবে সঠিক সিকোয়েন্সে একের একের পর এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে এরকম একটি ফলাফল পাওয়া গেছে – যেকোন সাধারন বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এটা বিশ্বাস করতে ভালো রকমের কষ্ট করতে হবে।
যতোই সময় যাচ্ছে, এলেমেলো বিস্ফোরণ এবং মহাবিশ্বের random বিবর্তনের বদলে বিজ্ঞানীর বরং মহাবিশ্বের মাঝে একটি ফাইন টিউনিং লক্ষ্য করছেন। যার ফলে পৃথিবীতে জটিল ও বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণের বিকাশ সম্ভব হয়েছে। আমরা এখানে শুধুমাত্র মহাবিশ্বের কোন একটি গ্রহের প্রাণের জন্য সহায়ক হবার জন্য প্রয়োজনীয় ফাইন টিউনিং সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় ফাইন টিউনিং এর গল্পটা আরো অনেক, অনেক বিস্ময়কর। কিন্তু সেটা আরেক দিনের জন্য তোলা থাক।
বলা যায় একজন মানুষকে একটা বিশেষ ধরনের ইন্ডক্ট্রিনেশানের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে সাধারন বিবেচনাবোধকে উপেক্ষা করে এমন অতিপ্রাকৃত এবং সত্যি কথা বলতে, অলৌকিক একের পর এক দুর্ঘটনা randomly ঘটেছে এমনটা বিশ্বাস করার জন্য।
আর নাস্তিকতার প্রস্তাবনা ঠিক এটাই। তাদের বক্তব্য হল একের পর এক সুনির্দিষ্ট দুর্ঘটনার ফলে দৈবক্রমে এই সুনির্দিষ্ট ফলাফল এসেছে। আমাদের প্রথম প্রশ্নে ফেরত যাওয়া যাক। এই উদাহরনের ক্ষেত্রে যদি আমি আপনাকে বলি দুইশো বার মার্বেল ছুড়ে দেবার পর দুইশোবারই সঠিক নাম্বারের গর্তে সঠিক নাম্বারের মার্বেল পড়বে, এবং এটাই স্বাভাবিক- তাহলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন? অবশ্যই না। কারন স্বাভাবিক ভাবে কখনোই এমনটা ঘটে না। আমরা – অর্থাৎ মানবজাতি- কখনোই এমনটা ঘটতে দেখি না, দেখি নি।
যদি আপনি সায়েন্টিফিক মেথডের কথা চিন্তা করেন তাহলে প্রথমে পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে হাইপোথিসিস তৈরি করা হবে। আর তারপর সেই হাইপোথিসিসকে পরীক্ষা (Experiment) করতে হবে । কোন হাইপোথিসিস বা ধারণার সত্য হবার জন্য অবশ্যই পরীক্ষায় পর্যবেক্ষণীয় উপাত্তকে (Observable Data) আপনার হাইপোথিসিসের সাথে ম্যাচ করতে হবে, এবং এই পরীক্ষাকে পুনরাবৃত্তি করে একই ফলাফল আনতে পারতে হবে (results of the experiment must be repeatable)।
এখন চিন্তা করে দেখুন দৈবক্রমে একের পর এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে ফাইন টিউনড মহাবিশ্বে একটি ফাইন টিউনড গ্রহে জটিল ও বুদ্ধিমান প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত হাইপোথিসিস বা ধারণা কি আমাদের পর্বেক্ষনীয় উপাত্ত বা Observable Data দ্বারা সমর্থিত? এই হাইপোথিসিস কি আদৌ পরীক্ষা করা সম্ভব? কোন এক্সপেরিমেন্টের মাধ্যমে সত্যায়ন করা সম্ভব? সেই পরীক্ষার ফলাফলের কি পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব?
পরিষ্কারভাবেই নিছক দুর্ঘটনাবশত এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং একের পর এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে by chance প্রাণের উদ্ভব ও বিকাশের ব্যাপারে নাস্তিকদের প্রস্তাবনা এই প্রস্তাবনা একটি হাইপোথিসিস ছাড়া আর কিছুই না। এবং বেশ দুর্বল হাইপোথিসিস। কিন্তু নাস্তিকরা এই দুর্বল হাইপোথিসিসকে বাস্তব সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে। যদিও তাদের এই বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই, এবং সাধারণ বিবেচনাবোধের সাথে এই বিশ্বাস সাংঘর্ষিক। শুধু তাই না তারা এই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বিশ্বাসকে বিজ্ঞানসম্মত বলেও প্রচার করে, এবং তাদের এই অযৌক্তিক বিশ্বাসকে বুদ্ধিবৃত্তির শিখর মনে করে আত্মবিভ্রমে ভোগেন।
আর যখন তাদেরকে বলা হয় তাদের এই বিশ্বাসের স্বপক্ষে যুক্তি পেশ করার তখন তারা কেন অন্যদের বিশ্বাস ভুল তা প্রমানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এক কথায় এটাই নাস্তিকতার সবচেয়ে বড় এবং সফল বুদ্ধিবৃত্তিক হাতসাফাই। তারা সফলভাবে অন্য বিশ্বাসগুলোকে আক্রমণ করার মাধ্যমে তাদের নিজেদের বিশ্বাসের পক্ষে কোন প্রমাণ পেশ করার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, এবং নিজেদের অযৌক্তিক এবং ম্যাজিকাল বিলিফ সিস্টেমকে যৌক্তিকতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার পোশাক পড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। আর এটা করতে তারা সক্ষম হয়েছে নিজ ধর্মের প্রতি ধর্ম বিশ্বাসীদের রক্ষণাত্মক মনোভাবের কারনে।
যদি আমি দাবি করি আমি সঠিক তাহলে বাকি সবাইকে ভুল প্রমাণ করা আমার পক্ষে প্রমাণ না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার দাবির পক্ষে অকাট্য প্রমাণ না আনতে পারছি ততক্ষণ আমার দাবি সঠিক প্রমাণিত হয় না। যদিও অন্য সবার দাবি ভুল হয়।
আস্তিকদের এই বিষয়টি উপলব্ধি করা উচিৎ যে নাস্তিকদের আবশ্যক দায়িত্ব তাদের প্রস্তাবনাকে সত্য প্রমাণ করা। বিশ্বাসীদের দায়িত্ব না তাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে নাস্তিকদের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দেওয়া। নাস্তিকরা নিত্যনতুন নকশা করবে আর বিশ্বাসীরা মনযোগ দিয়ে, সময় ব্যয় করে তাদের অসংলগ্ন কথাবার্তা, লজিকাল ফ্যালাসি, লিঙ্গুইস্টিক প্যারাডক্সের উত্তর দেবে – এটার কোন মানেই হয় না। যদি নাস্তিকরা আসলেই তাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে সিরিয়াস হয় তাহলে অবশ্যই তাদেরকে তাদের দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। যদি তারা তা না পারে তাহলে তাদেরকে অক্ষমতা স্বীকার করে নিতে হবে। যদি তারা কোনটাই না করে এবং জোর করে নিজেদের অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক, ম্যাজিকাল বিলিফ সিস্টেমকে সত্য বলে চালিয়ে দিতে চায় তাহলে তাদের বালকসুলভ ন্যুইসেন্সকে, ন্যুইসেন্স হিসেবেই গণ্য করা হবে।
আর তাই নাস্তিকদের আমরা বলি – যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে প্রমাণ উপস্থিত কর।
[1] https://www.spacetelescope.org/news/heic1620/
[2] স্যাইগান ভুল করেছেন। ১ অক্টলিয়ন = ১ এর পর ২৭টি শূন্য, ১ সেপ্টিলিয়ন = ১ এর পর ২৪টি শূন্য, ১ সেক্সটিলিয়ন = ১ এর পর ২১টি শূন্য।