কন্সপিরেসি থিওরি


কন্সপিরেসি থিওরি বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জনপ্রিয়তার পেছনে বেশ অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর হল অবিশ্বাস। মানুষ যখন অফিশিয়াল বক্তব্য বিশ্বাস করতে পারে না, তখন কন্সপিরেসি থিওরির দিকে ঝোঁকে। অফিশিয়াল বক্তব্য যখন বারবার মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষ অফিশিয়াল সব বক্তব্যকে মিথ্যা বলে ধরে নেয়।

কন্সপিরেসি থিওরি নিয়ে আগ্রহ বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এই আগ্রহ নির্দোষ, কিছু ক্ষেত্রে বিপদজনক। আবার কন্সপিরেসি থিওরি নিয়ে নাক সিটকাতে গিয়ে দুনিয়াতে যে সত্যিকার কন্সপিরেসি (ষড়যন্ত্র) আছে সেটা উপেক্ষা করে যাওয়াও একটা বড় ধরনের সমস্যা। কন্সপিরেসি থিওরি নিয়ে বেশি মনোযোগ দেয়ার একটা খুব কমন এবং বিপদজনক একটা দিক হল – ‘কী করা উচিৎ’ – এ নিয়ে কনফিউযড হয়ে যাওয়া। বিশ্ব কিংবা দেশের ঘটনাপ্রবাহ সবসময় কন্সপিরেসি থিওরির আলোকে দেখতে গেলে অনেকক্ষেত্রেই হিসেবনিকেষ উল্টো যায়। সাধারণ অবস্থায় যেটা সঠিক বলে মনে হয়, ষড়যন্ত্রের লেন্সে দেখলে সেটাকে মনে হয় বোকামি।

করোনা কি বায়োলজিকাল উইপেন? অ্যামেরিকার তৈরি? চীনের তৈরি?

এটা কি পৃথিবী জনসংখ্যা কমানোর পরিকল্পনার অংশ?

এটা কি সারা পৃথিবীজুড়ে সার্ভেইলেন্স বাড়ানোর জন্য চাল?

আসলে কি করোনা বলে কিছু আছে? নাকি সবই মিডিয়ার সৃষ্টি?

বিশ্বে বড় বড় যতো ঘটনা ঘটে সব কি বিশাল কোন ষড়যন্ত্রের অংশ?

সব কি ‘ওদের’ প্ন্যান বাস্তবায়নের জন্য এক একটা চাল?

সবই যদি দাজ্জাল কিংবা ইলুমিনাটির প্ল্যান হয় তাহলে আমার আসলে কী করার আছে?

সবাই যদি অ্যামেরিকার সৃষ্টি হয়, কিংবা রথসচাইল্ডদের দাস হয় তাহলে হক্বপন্থী কে?

সবই যদি নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের অংশ হয় তাহলে সব ছেড়েছুড়ে একলা বসে থাকা (আর কন্সপিরেসি থিওরি পড়া) ছাড়া উপায় কী?

অনেক মানুষ, অনেক মুসলিম এ জায়গাটাতে আটকে যান। বাস্তবতা সম্পর্কে যখন নিশ্চিত হওয়া যায় না, তখন করণীয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়াটা কঠিনই বটে। তবে এই সমস্যার এবং এসব প্রশ্নের একটা সহজ সমাধান আছে। আমাদের কাছে এমন দুটো সোর্স আছে যা সব অবস্থায় সঠিক তথ্য দেয়। এমন সোর্স যেগুলোর বক্তব্যের ওপর যেকোন অবস্থায় বিশ্বাস করা যায় চোখ বন্ধ করে। পৃথিবীর বুকে আজ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যা-ই হোক না কেন – যতো অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য, বিচিত্র ঘটনাই ঘটুক না কেন – এই দুটো সোর্স থেকে আমরা কঙ্ক্রিট, সত্য নির্দেশনা পাবো। এই সোর্স দুটো হল কুরআন এবং সুন্নাহ। কুরআন এবং সুন্নাহ আমাদের সুনিশ্চিত জ্ঞান দেয়। অন্যদিকে যতো থিওরি-কন্সপিরেসি থিওরি, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বক্তব্য, অলটারনেটিভ মিডিয়ার বক্তব্য – যতো যাই যাছে সবই, স্পেকুলেটিভ। এগুলো আমাদের কিছু তথ্য দিতে পারে, কিছু ধারণা দিতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত সত্য জানাতে পারে না।

কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে অপ্রয়োজনীয় অনেক আলাপ বাদ দিয়ে মূল জায়গাগুলো স্পষ্ট করা যায়। কিভাবে চিন্তা করা উচিৎ, বিশ্লেষণ করা উচিৎ, কী করা উচিৎ, কিভাবে করা উচিৎ – মেলে এসব প্রশ্নের উত্তর। এক্ষেত্রে অনেক আয়াত এবং হাদিসের কথা বলা যায়, আমি এখানে দুটো আয়াত আর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর একটি হাদিস এর কথা বলছি।

আয়াত ১ – وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّـهُ ۖ وَاللَّـهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
তরজমা – আর তারা (কাফিরেরা) ষড়যন্ত্র করেছিল ও আল্লাহও কৌশল করলেন এবং আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী। [আলে ইমরান, ৫৪]

আয়াত ২ – الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
তরজমা – … আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিআমাত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবূল করে নিলাম।…[আল-মা’ইদা, ৩]

রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীসের তরজমা –
এই দ্বীন সর্বদা কায়েম থাকবে। মুসলমানের একটি দল এই দ্বীনের সংরক্ষণের জন্য কিয়ামাত পর্যন্ত কিতাল (يُقَاتِلُ যুদ্ধ) করতে থাকবে। [সাহিহ মুসলিম; কিতাবুল ইমারাহ]

প্রথম আয়াতের কারণে আমরা নিশ্চিত হই – যে যতো পরিকল্পনাই করুক না কেন – শেষ পর্যন্ত তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে। কন্সপিরেসি অনেক বড়, অনেক সূক্ষ, অনেক গভীর হতে পারে। কিন্তু দিনশেষে আল্লাহ্‌র দ্বীন বিজয়ী হবে, মুমিনরা বিজয়ী হবে। আল্লাহ্‌ সর্বোত্তম কৌশলী।

দ্বিতীয় আয়াত থেকে আমরা নিশ্চয়তা পাই – এ দ্বীন, এই শরীয়াহ পরিপূর্ণ। কিয়ামত পর্যন্ত এতে কোন পরিবর্তন হবে না। এতে যোগবিয়োগের কোন সুযোগ নেই। যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন, আমাদের দায়িত্ব হল শরীয়াহ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া। এমন কোন পরিস্থিতি তৈরি হবে না যেখানে শরীয়াহর নির্দেশনা, শরীয়াহর মূলনীতিগুলো কার্যকরী হবে না। তাই বিষয়গুলোকে খুব বেশি জটিল করে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। প্রচণ্ড ঝড়ে যদি চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়, তবু যতোক্ষণ আমরা কুরআন এবং সুন্নাহ অনুসরণ করবো ততোক্ষণ আমরা ঠিক পথে থাকবো।

আর রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদীস থেকে আমরা এই নিশ্চয়তা পাই যে, কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ্‌র এমন বান্দারা থাকবেন যারা হক্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সব ফলস ফ্ল্যাগ, সব ডিসইনফরমেইশান, সব প্রপাগ্যান্ডা, সব প্রক্সি ওয়ারের কথাবার্তার পর এটা হল বটম লাইন। এমন কিছু বান্দা সবসময় থাকবেন যারা হক্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর তাঁদের পথ ও পদ্ধতি কী হবে সেটাও হাদীসে বলে দেয়া আছে।

কাজেই কারা সত্যের ওপর আছেন, কী করতে হবে, কিভাবে করতে হবে, সংশয়ে পড়লে কাদের দিকে তাকাতে হবে – এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা অসম্ভব না। আল্লাহ্‌ চাইলে অনেক সহজ, আলহামদুলিল্লাহ। আমি এখানে শুধু দুটো আয়াত আর একটি হাদীসের কথা বললাম, এমন অনেক আয়াত এবং হাদীস আছে, যেগুলোর লেন্সে চিন্তা করলে, অনেক জটিল হিসেবেr জট সহজে খোলা যাবে। তবে শর্ত হল পত্রিকার আন্তর্জাতিক পাতা আর কলাম লেখকের বিশ্লেষণ ছেড়ে আমাদের উত্তর খুজতে হবে কুরআন সুন্নাহর মাঝে। বিশ্লেষণ করতে হবে কুরআন-সুন্নাহর মাপকাঠিতে।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *