করোনা ভাইরাসের বিপদ মাথায় নিয়ে জানাযা কিংবা মসজিদে সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড়টাকে আমরা একটা নির্দিষ্টভাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ‘বোকা বাঙ্গালী, বুঝে না। আম জনতা গর্দভ। ধর্মান্ধ। কাঠমোল্লা আর ধর্মব্যবসা’ – ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা মোটামুটি বুদ্ধিমান মানুষরা যে বিষয়টা খুব সহজে বুঝতে পারছি, এই বোকা মানুষগুলো কেন সেটা বুঝছে না, তা নিয়ে আমরা অবাক এবং বিরক্ত। কিন্তু ব্যাপারটা হয়তো অতোটা সোজা সাপ্টা না। ব্যাপারটা হয়তো বুদ্ধিমত্তা, বিবেচনাবোধ কিংবা কমনসেন্সের না। হয়তো আমরা মোটামুটি বুদ্ধিমান মানুষরা যে জায়গা থেকে পৃথিবীটা দেখছি বোকা বোকা আম জনতা হয়তো সেভাবে দেখছেন না।
একটু ভেবে দেখুন – ভাইরাস ছড়ানো, অনেক অসুস্থ রোগীর মধ্যে উপসর্গ দেখা না দেয়া, প্রতি একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে গড়ে আরো ৩/৪ আক্রান্ত হওয়া – এই তথ্যগুলো আমরা কিভাবে পাচ্ছি? কোন সূত্রে? বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে। তাই না? প্রশ্ন হল, বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর সবার কি একই রকম বিশ্বাস থাকে?
সায়েন্টিফিক মেথড কিভাবে কাজ করে একটা মোটামুটি লম্বা সময় নিয়ে আমরা সেটা শিখেছি। আমি বা আপনি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝতে শিখেছি যে এমন অনেক বিষয় আছে যেখানে বিজ্ঞান আমাদের সুনিশ্চিত জ্ঞান দিতে পারে। তাই বিজ্ঞান যখন বলে একটি অক্সিজেন পরমাণু আর দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে এক অণু পানি পাওয়া যায়। তখন আমি সেটাকে সত্য বলে মানি। আমরা অনেকে হয়তো এর চাক্ষুস প্রমাণও দেখেছি। কিন্তু এটা কি অন্য সবার ক্ষেত্রে সত্য? বিজ্ঞান সুনিশ্চিতভাবে বলছে তাই মেনে নেয়া উচিৎ – এটা কি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে? আলোর গতি, মহাকর্ষজ ধ্রুবকের মান, নিউটনের সূত্র, থার্মোডায়নামিক্সের সূত্র – এগুলোর অর্থ, ব্যাখ্যা আপনি মানেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ কি মানে?
মানা না মানার চেয়ে বড় কথা হল এই তথ্যগুলো প্রসেস করার কোন মেকানিযম তার কাছে কি আছে? এসব তথ্যের আদৌ কোন গুরুত্ব কি তার কাছে আছে? এগুলো কি তার কাছে নিছক কিছু লম্বা লম্বা অর্থহীন শব্দ না, দৈনন্দিন জীবনে যেগুলো সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন? বিষয়গুলো ঠিক না বেঠিক, ভুল না শুদ্ধ সেটা আমার প্রশ্ন না। আমি জানতে চাচ্ছি আপনি কি মনে করেন এই তথ্যগুলো আপনার জন্য যে অর্থবহন করে, বাংলাদেশের ৮০% মানুষের জন্য সেই একই অর্থ বহন করে?
এই মানুষগুলো কিন্তু বোকা না। সে জ্বলন্ত বাড়ির দিকে দৌড়ে যায় না। চলন্ত ট্রাকের সামনে শুয়ে পড়ে না। সে এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ শুনলে গাঁ ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করে। ডেঙ্গু সিযনে অভাবের সংসারের মশারি কেনে। সে তার পাড়ার, মহল্লার কিংবা সমাজের মানুষের ক্ষতি চায় না। সে নিজে বিপদে পড়তে চায় না। অন্যকেও ফেলতে চায় না। কারো ওড়না রিকশার চাকায় প্যাচিয়ে গেলে সে ঠিকই হাকডাক করে সতর্ক করে। সে নিজের জীবন, নিজের পরিবারে জীবন নিয়ে কেয়ার করে। সে সতর্কতা গ্রহণ করে। নিজেকে এবং দশজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পার্থক্য হল অন্যসব ক্ষেত্রে সে যেমন ইমিডিয়েট থ্রেট দেখতে পাচ্ছে, হুমকিটাকে বাস্তব মনে করছে, সেটা করোনার ক্ষেত্রে হচ্ছে না।
করোনা ভাইরাস খালি চোখে দেখা যায় না। কে কার কাছ থেকে, কিভাবে আক্রান্ত হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় নেই। আক্রান্তদের বিশাল একটা অংশের মধ্যে কোন উপসর্গ দেখা যায় না। ৮০% রোগির জন্য করোনা হল সাধারণ সর্দি-কাশির সমমাত্রার অসুস্থতা। কলেরা কিংবা ডেঙ্গুর মতো বিশাল সংখ্যক মৃত্যু করোনার কারণে মানুষ এখনো দেখেনি। অধিকাংশ মানুষ হয়তো এখনো তার পরিচিত কাউকে করোনাতে মারা যেতে দেখেনি। সে দেখছে সারা বিশ্বে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা অনেক দূরবর্তী একটা বিষয়। এই অবস্থায় কিভাবে আপনি সাধারণ মানুষকে বোঝাবেন এটা সবার জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি?
একজন ছাপোষা মানুষের কাছে যদি এটাকে একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট কিংবা এসোটেরিক হুমকি মনে হয়, তাহলে কি তাকে দোষ দেয়া যায়? যখন সে চাক্ষুস প্রমাণ পাবে, তখন বুঝবে। যতক্ষণ সে বিপদের প্রকৃত মাত্রা উপলব্ধি করতে পারবে না ততক্ষণ – ‘বিজ্ঞানীরা বলেছে’ – এই কথার মূল্য তার কাছে নেই। সে কথাগুলো শুনেছে। বুঝেছে কিংবা বিশ্বাসও হয়তো করেছে। কিন্তু কেবল এটুকুর ভিত্তিতে সে কেন এতো বড় বড় পরিবর্তন আনবে? কেন সে এই দুর্বলভাবে সংজ্ঞায়িত বিপদের জন্য নিজের পুরো জীবন বদলে ফেলবে? কেন এমন এসোটেরিক একটা হুমকির কারণে নামাযে যাওয়া বন্ধ করবে? কেন পছন্দের একজন মানুষের জানাযায় যাবে না? যেখানে মানুষ ইসলামের ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষার চেয়ে আবেগ এবং সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে (এবং দিয়ে আসছে) সেখানে কিভাবে আশা করা যায় যে বিজ্ঞানের কিংবা সরকারের বক্তব্যের ক্ষেত্রে এমন হবে না? বিশেষ করে এর মধ্যে একজন যখন অনির্ভরযোগ্য হিসেবে কুখ্যাত।
আবারো বলছি, আমি এখানে ঠিক বা ভুল নিয়ে কথা বলছি না। আমার পয়েন্ট হল আমরা কি এই সম্ভাবনা ভেবে দেখেছি যে আমাদের সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে থ্রেট অ্যাসেসমেন্টের কিছু পার্থক্য রয়ে গেছে? এবং আমাদের মেসেজিং ঠিকঠাক হয়নি? আমরা কি এই সম্ভাবনাটা আদৌ চিন্তা করেছি যে অধিকাংশ মানুষের কাছে এই হুমকির ধরণটা পরিষ্কার না? এবং তা পরিষ্কার করার জন্য যথাযথ চেষ্টা দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে – রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় – করা হয়নি? কোয়ারেন্টিন, সেলফ-কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন – সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য এসব শব্দের সালাদ বানানোয় পরিস্থিতি আরো ঘোলা হয়েছে? আমরা কি এটা চিন্তা করেছি যে অনেকের মানুষের প্রেফারেন্স ফাংশান হয়তো আমার -আপনার চেয়ে আলাদা। হয়তো করোনার আপাত ঝুঁকি (তার অবস্থান থেকে) আর জানাযা কিংবা মসজিদে যাবার ঝুঁকির ওজন করে নিজের প্রেফারেন্স ফাংশান অনুযায়ী সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে?
এ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গিয়ে পাবলিককে গালি দেয়া সোজা। কঠিন কাজটা হল তাদের চিন্তাচেতনা, অবস্থান বুঝে এমনভাবে তাদের সামনে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা যাতে তারা ব্যাপারগুলো বুঝতে পারেন। দাওয়াহর একটা উসুল হল যাকে উদ্দেশ্য করে দাওয়াহ করা হচ্ছে তার প্রতি দরদ থাকা। তার উপযোগী করে কথা বলা। সে বোঝে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা। এবং ধৈর্য্যের সাথে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর জায়গা যদি রাগ, অভিযোগ আর বিরক্তি দখল করে নেয় তাহলে সেটা আর দাওয়াহ থাকে না।