ক্রিশ্চিয়ানিটি থেকে সেক্যুলারিসমের দিকে পশ্চিমের যে পরিবর্তন, তার পেছনে বিভিন্ন ফ্যাক্টরের ভূমিকা ছিল। তবে এ বিষয় নিয়ে যারা আলোচনা করেছেন তাদের অধিকাংশের বিশ্লেষণে একটা ফ্যাক্টরের কথা উঠে এসেছে। বিভিন্ন ঘরানার বিশ্লেষক এ জায়গায় একমত। সেটা হল ধর্মের মৌলিক শিক্ষাকে বাদ দিয়ে ‘ভালো লাগা’-কে প্রাধান্য দেয়া।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অ্যামেরিকাতে ক্রিশ্চিয়ানিটির দুর্বল হবার বড় একটা কারণ হিসেবে যেমন ক্যাথলিক ঐতিহাসিক জেইমস হিচকক বলেছেন, ‘ফিলগুড’ ধর্মপ্রচারকদের কথা। এই ধরণের বক্তারা এমন কথা বলতো যা শুনতে ভালো। কিন্তু তাদের কথা ধর্ম কম, মোটেভেইশানাল বক্তব্য বেশি। এসব লোকের কথা শুনে মানুষ জানতো যে ধর্ম ভালো, বিশ্বাস ভালো – কিন্তু কেন ভালো তা জানতো না। তারা বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু কেন বিশ্বাস করছে তা জানতো না। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ‘ভালো লাগা’ কিংবা ‘বিবেক” চূড়ান্ত মাপকাঠি মনে করার প্রবণতাও।
আবার ভিক্টোরিয়ান আমলের পর ব্রিটেনের সমাজে ক্রিশ্চিয়ানিটির প্রভাব কমার পেছনে অন্যতম একটা ফ্যাক্টর হিসেবে সাংবাদিক, লেখক এবং গবেষক গ্র্যায়েম স্মিথ এনেছেন ‘এথিকস উইদআউট ডকট্রিন’ এর কথা। অর্থাৎ তারা খ্রিস্টীয় মূল্যবোধগুলো ধরে রাখে, কিন্তু আকিদাহকে দূরে সরিয়ে দেয়। আকিদাহ বলতে এখানে ধর্মের কাঠামোগত শিক্ষা, মূল টেক্সট ইত্যাদিকে লেখক বোঝাচ্ছেন। এর ফলাফল কী হয়েছে তা তো আজ আমরা দেখতেই পাচ্ছি।
বাংলাদেশের অনলাইন দাওয়ার ক্ষেত্রে গত বছর তিনেক ধরে, একই ধরণের একটা বিষয় হচ্ছে। আকিদাহ, দ্বীনের শিক্ষা, বিধানের মতো বিষয়গুলোর বদলে ‘ভালোলাগা’ – কে প্রাধান্য দেয়া। কুরআন ও সুন্নাহ পড়া ও মানার বদলে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে লেখকদের কথার ফুলঝুড়িকে। কেউ গুছিয়ে বাংলা লিখতে পারলেই সে ইসলাম নিয়ে লিখছে।
বুমিং প্রকাশনা শিল্পের কল্যাণে কেউ নিয়মিত লিখতে পারলে এবং গড়ে ২/৩০০ করে লাইক পেলেই তার বই বের হওয়া এখন মোটামুটি কনফার্ম বিষয়। প্রকাশকরা এখন ফেইসবুকে এসে লেখক খোজেন। সব ক্ষেত্রে এটা হয়তো সমস্যা না। সমস্যা হল, যা লেখা হচ্ছে তার বিশাল একটা অংশের সাথে ইসলামের মূল শিক্ষার কোন সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন গল্পগুজব জাতীয় কথাবার্তা। ফিলগুড স্টোরিস। মোটিভেইশানাল গল্পগাঁথা।
তারচেয়ে বড় কথা অনেক সময় এসব লেখায় ভুল তথ্য থাকছে, সরাসরি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয় চলে আসছে। কিন্তু যখন এ ভুলগুলো সংশোধনের চেষ্টা করা হচ্ছে তখন লেখকসংসদ (এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশকরাও) ডিফেন্সিভ হয়ে যাচ্ছে। কেউ শার’ঈ সম্পাদনার বিরোধিতা করছে। কেউ বাকস্বাধীনতার হযবরল যুক্তি নিয়ে আসছে। এই ধরণের প্রবণতা শেষ পর্যন্ত খুব দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি নিয়ে আসে। কিছু বাক্য সুন্দর করে সাজিয়ে লিখতে পাওয়া প্রত্যেক যদুমধু মনের মাধুরী মিশিয়ে দ্বীনের ব্যাখ্যা করতে শুরু করলে, নিজের ‘ভালোলাগা’ অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ বনে বসলে সেটা অনেক বড় সমস্যা।
দ্বীনের কাজ করতে হলে সেটা দ্বীনের নিয়মেই করতে হবে। আমার ভালোলাগা, আমার মন্দলাগা, আমার বুঝকে মাপকাঠি বানিয়ে যা ইচ্ছে করতে শুরু করলে হবে না। এই কাজটা যে অনেক বড় একটা দায়িত্ব, এই বোধ থাকতে হবে। আল্লাহর দ্বীনের ভুল উপস্থাপন কিংবা ব্যাখ্যার কারণে যে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে তা মনে রাখতে হবে।
এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে না পারলে, প্রেমের গল্প, থ্রিলার কিংবা সামাজিক-অ্যাকশনধর্মী রোমান্টিক বই লিখুন। ইসলাম নিয়ে লেখালেখি করার দরকার নেই। বাংলাদেশে ইসলামের বিজয় একজন দ্বীনি হুমায়ুন আহমেদের জন্য আটকে আছে, ব্যাপারটা এমন না। অনেক লেখক তৈরি হলে ইসলামের অনেক উপকার হবে, এমনও না। উল্টোটা হবার শক্ত সম্ভাবনা আছে। এবং অর্ধেক জানা বক্তা, রুয়াইবিদাহ-র মতো ব্যাপারগুলোর ব্যাপারে সতর্কতাবাণী হাদীসেই এসেছে।
সেক্যুলার ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে পড়াশোনা করে যারা দ্বীনে এসেছেন এবং এখন লেখালেখি করছেন তাদের একটা জিনিস খুব ভালো করে বোঝা দরকার। আমাদের কাজ হল উলামায়ে কেরাম (তাঁরা – হানাফি/সালাফি – যে ঘরানার হোন) এবং ইসলামী জ্ঞানের সাথে শহুরে সমাজের এবং নতুন প্রজন্মের যে প্রজন্মতগত, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক দূরন্ত্ব আছে সেটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা। আমাদের কাজ হল ব্রিজ হিসেবে কাজ করা। নিজেরা ব্যাখ্যাকারী বনে যাওয়া না। যে ছেলেটা দ্বীন সম্পর্কে একেবারে বেখেয়াল, আমাদের কাজ আল্লাহর ইচ্ছায় তাকে দ্বীন সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলা, এবং আলিমদের দরজা পর্যন্ত পৌছে দেয়া। নিজেরা আলিম সেজে বসা, উস্তাদ বনে যাওয়া কিংবা সবজান্তা হওয়া আমাদের কাজ না।