১৮৮৮ সালে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে নাটক লেখে এক ফ্রেঞ্চ নাট্যকার। ঠিক করা হল নাটকের প্রদর্শনী হবে ফ্রান্সের প্রধান নাট্যমঞ্চে। কিছুদিনের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লো সারা বিশ্বে। উত্তাল হয়ে উঠলো আলজেরিয়া থেকে হিন্দুস্তান। উসমানী সুলতান দ্বিতীয় আব্দুলহামিদের পক্ষ থেকে একাধিকবার ফ্রেঞ্চদের ডেকে বলা হল, এই নাটক মঞ্চায়নের পরিণাম ভালো হবে না। শেষমেষ ১৮৮৯ এর শেষদিকে ফ্রেঞ্চ প্রধানমন্ত্রী এ নাটকের প্রদর্শনী বাতিল করার ঘোষণা দিলো।। এ ঘটনা বেশ বিখ্যাত। টার্কিশ একটা সিরিযে এ ঘটনার ড্র্যামাটাইযেইশান করা হয়েছে। বেশ কয়েক মাস আগে ভিডিওটা ফেইসবুকে ভালোরকমের সাড়াও ফেলেছিল।
ভিডিও লিঙ্ক – https://www.youtube.com/watch?v=d2vP54nTFbA&feature=emb_logo
এটা শুনে অনেকে হয়তো খিলাফাহর অনুপস্থিতি এবং উম্মাহর ঐক্যের অনুপস্থিতি নিয়ে আফসোস করতে শুরু করে দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে ইসলামী শাসন না থাকা, অনেক বড় দুর্বলতা। এ দুর্বলতার কারণে আমাদের অনেক দিক থেকে আক্রমনের শিকার হতে হচ্ছে। এটা ছাড়া এসব সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান আসবে না। কিন্তু খালিফাহ না থাকলে নবী ﷺ-এর অবমাননার বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিরোধ করা যাবে না, ব্যাপারটা এমন না।
ওপরের ঘটনার আরেকটা অধ্যায় আছে যেটা নিয়ে অতোটা কথা হয় না। ১৮৮৯ এর শেষদিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে নিয়ে আরেকটি মঞ্চনাটকের তোরজোর শুরু করে ব্রিটিশ অভিনেতা হেনরি আরভিং। এবার লন্ডনে। প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভে এবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় ভারতীয় মুসলিমরা। লিভারপুল মুসলিম অ্যাসোসিয়েশান, আঞ্জুমানে ইসলামী কলকাতাসহ বিভিন্ন ইংরেজ সমর্থক সংগঠনের পক্ষ থেকে ব্রিটিশ পত্রিকা, ভারতের তৎকালীন ভাইসরয়, ভারতের দায়িত্বে থাকা সেক্রেটারি অফ স্টেইট অনেকের কাছে চিঠি লেখা হয়। অন্যদিকে উলামাগণের নেতৃত্বে চলে মাঠ পর্যায়ে আন্দোলন। আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে বঙ্গ, পাঞ্জাব এবং যে অঞ্চল নিয়ে আজকের পাকিস্তান, সেটা। উত্তপ্ত হয়ে উঠে পুরো হিন্দুস্তান।
১৮৫৭ সালের বিপ্লবের স্মৃতি তখনো ফিরিঙ্গিদের মনে তাজা। ওরা ঝুঁকি নিতে চাইলো না। তৎকালীন ‘লর্ড চেম্বারলেইনের’ পক্ষ থেকে হেনরি আরভিংকে বলা হল, এ নাটক মঞ্চস্থ করার লাইসেন্স দেয়া হবে না। তাই নাটকের প্রস্তুতি বন্ধ করে দিলেই ভালো হবে। আরভিং সুবোধ বালকের মতো কথা শুনলো। যদিও এ সময় খিলাফাহ নামে হলেও ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ নাটকের মঞ্চায়ন বন্ধ করে দেয়ার মূল কৃতিত্ব ছিল ভারতীয় মুসলিমদের।
ইসলাম ও মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা ইউরোপিয়ানদের জন্য, বিশেষ করে ফ্রেঞ্চদের জন্য নতুন কিছু না। ১৮৮৯ এর আগেও ১৭৪১ সালে, এনলাইটেনমেন্টের পীরদের একজন, ভলতেয়ার নবী ﷺ-কে অবমাননা করে নাটক লিখেছিল। শত শত বছর ধরে এরা বিনা প্ররোচনায় ইসলাম, মুসলিম এবং বিশেষ করে নবী ﷺ-কে আক্রমনে করে আসছে।
আধুনিক সময়েও এমন অনেক উদাহরণ আছে। ১৯৯৭ সালে ইস্রায়েলি তাতিয়ানা সসকিনের আঁকা কার্টুন, ২০০১ সালে অ্যামেরিকান কার্টুন সিরিয সাউথ পার্ক, ২০০৩ সালে জার্মানিতে মোৎযার্টের অপেরা ইডোমিনিও-এর রেন্ডিশান, নেদারল্যান্ডসে থিও ভ্যান গ’র বানানো শর্টফিল্ম – এ লিস্ট অনেক লম্বা। আলজেরিয়াতে ফ্রান্স যা করেছে তা তো আছেই। তাই আজ ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয় মদদে নবী ﷺ এর যে অবমাননা চলছে, এর জন্য যারা মুসলিমদের দায়ী করে, তারা পশ্চিমের ইসলামবিদ্বেষের ইতিহাস জানে না। আর মিলিট্যান্ট সেক্যুলার ফ্রেঞ্চদের মনস্তত্বও বোঝে না। অথবা জেনেবুঝে এরা ইউরোপিয়ান ইসলামবিদ্বেষের অ্যাপলোজিস্ট হিসেবে কাজ করে।
মজার ব্যাপার হল ১৮৮৯ আর ৯০ এর ঘটনার সময় ফ্রেঞ্চ এবং ব্রিটিশ প্রেসে এ নাটকগুলোর সমালোচনা করা হয়েছিল। ১৮৮৯ এর অক্টোবরে ফ্রেঞ্চ পত্রিকা লা প্রেসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের হেডলাইন ছিল – ‘মুসলিম বিক্ষোভ: অপরের প্রতি শ্রদ্ধা’। প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাকস্বাধীনতা এবং সকল ধর্মের প্রতি ফ্রান্সের অঙ্গীকার সত্ত্বেও, (এ নাটকের ব্যাপারে) মুসলিমদের পক্ষ থেকে যে আপত্তিগুলো জানানো হয়েছে সেগুলোর বৈধতা উপেক্ষা করা যায় না”।
ব্রিটিশ নাটকের ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন সেক্রেটারি অফ স্টেইট বলেছিল,
“এধরনের যেকোন নাটকের মঞ্চায়ন নিঃসন্দেহে সব মোহাম্মাদানদের (মুসলিমদের) প্রতি চরম অপমান হবে”। [১]
অবশ্য শুরুতেই একথাগুলো ওরা বলেনি। শুরুতে ওরা বাকস্বাধীনতা, শিল্প, ইত্যাদির কথা বলে অজুহাত দেয়ার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু যখন পরিষ্কার হয়ে গেলো, নাটক মঞ্চস্থ হলে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া থেকে শুরু করে নানান জায়গায় দখলদার ফ্রান্সকে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার মোকাবেলা করতে হবে, আবার উসমানীদের দিক থেকেও চাপ আসবে – তখন মুসলিমদের অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার ব্যাপারটা ফ্রেঞ্চ মিডিয়া রাতারাতি বুঝে ফেললো।
২০০৬ এ ডেনমার্কের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবমাননা মুসলিমদের জন্য কতো গুরুতর ব্যাপার প্রথমে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রীও সেটা ‘বুঝতে পারেনি’।
ডেনমার্কে নবী ﷺ-কে নিয়ে ব্যাঙ্গচিত্র প্রকাশিত হবার পর দশটা মুসলিম দেশের রাষ্ট্রদূত ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। তাদের ইচ্ছা ছিল প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে ড্যানিশ সরকার এই ব্যাঙ্গচিত্রগুলো সমর্থন করে না, এমন একটা বক্তব্য দিতে অনুরোধ করা। ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী তখন তাদের সাথে মিটিং-ই করেনি। সে প্রেসের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতার অজুহাত দিয়েছিল। কিন্তু সারা বিশ্বজুড়ে যখন প্রতিবাদ হল, দেশে দেশে ডেনমার্কের দূতাবাস ঘেরাও হল, ড্যানিশ পণ্য বর্জনের কারনে ওদের বিশাল লস হল – তখন প্রধানমন্ত্রী ঠিকই ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। ক্ষমা চাইলো।
ফ্রান্সের ব্যাপারটাও একই। করোনা ভাইরাস, অর্থনৈতিক সংকট, ইয়েলো ভেস্ট প্রটেস্ট, সব কিছু মিলিয়ে ম্যাখোর রাজনৈতিক অবস্থা এখন ভালো না। অন্য আরো অনেক পশ্চিমা রাজনীতিবিদের মতো ম্যাখোও তাই ইসলামবিদ্বেষকে পুঁজি করে অর্থনীতি, দারিদ্র্যের মতো বিষয়গুলো আড়াল করতে চাচ্ছে। ইউরোপে কট্টর ডানপন্থী সেন্টিমেট এবং ইসলামোফোবিয়ার রাজত্বের এ সময়ে কার্টুনের ইস্যু ব্যবহার করে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান শক্ত করতে চাচ্ছে ম্যাখো। তাই এখন ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত করার বিষয়টা ওরা বুঝতে পারছে না।
পাশাপাশি ওরা মনে করছে, ফ্রান্সের ভেতরে ওরা যা ইচ্ছে করবে, এর বড় কোন প্রভাব ওদের ওপর পড়বে না। কিন্তু যখন বিশ্ব জুড়ে ফ্রেঞ্চ দূতাবাসগুলো ঘেরাও হবে। ওদের পণ্য বর্জন করা হবে, তখন ফ্রেঞ্চরা বুঝবে ফ্রান্সে বসে নবী ﷺ-এর অবমাননা করলে সেটার চড়া মূল্য বিশ্বজুড়ে ওদের দিতে হবে। তখন ম্যাখো এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরাও সুবোধ বালকের মতো ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া’র বিষয়টা ‘বুঝতে পারবে’।
সোজাসাপ্টা কথা হল, ফ্রান্স লাভক্ষতির একটা হিসেব করে নিয়েছে। আমরা, মুসলিমরা কিছু না করে বসে থাকার অর্থ হল ঘটনাপ্রবাহ ওদের হিসেব মতো এগোতে দেয়া। অন্যদিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সামরিকভাবে চাপ প্রয়োগ করার অর্থ এমন চলক যুক্ত করা যা লাভক্ষতির সমীকরণকে বদলে দেবে। ফ্রান্সের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাকে ভারী করে দেবে। আর লাভক্ষতির এই হিসেবে স্থানকালপাত্র নির্বিশেষে সবাই বোঝে। ফ্রেঞ্চরা আরো ভালোভাবে বোঝে।
দুটো নাটক নিয়ে তথ্য Christopher B. Balme, 2014. The Theatrical Public Sphere, Chapter 4, থেকে নেয়া।