ফেমিনিযম – বেশ আলোচিত-সমালোচিত বিষয়। রিসেন্টলি নানা তর্ক-বিতর্ক এবং লেখালেখির কারণে এটা নিয়ে অনেক লেখা, মন্তব্য, ঝগড়া চোখে পড়ছে। তবে এ সংক্রান্ত আলোচনায় – ইসলামিস্টদের আলোচনায় – দুটো মৌলিক ভুল থেকে যাচ্ছে।
প্রথম ভুলটাকে এক ধরণের বায়াসড স্যাম্পল ফ্যালাসি বলা যায়। আমাদের সমাজে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক চিন্তা, বিশ্বাস ও কাজ ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে যাবার কারণে, সত্যিকারভাবে ইসলাম পালন শুরু করলে মানুষকে মূলধারা (সংখ্যাধিক্যের দিক থেকে) থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হতেই হয়। এটার প্রয়োজন উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এর কিছু সমস্যাও আছে। একটি সমস্যা হল আমরা অনেক সময় নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে করতে একটা একো-চেইম্বারে আটকে ফেলি। আমরা বেশিরভাগ সময় সমমনাদের কথাই শুনি, তাদের সাথেই কথা বলি। তাদের জীবনই দেখি, এবং তাদের কথা মাথায় রেখেই চিন্তা করি। ঘুরেফিরে আমাদের চিন্তা ও কথা একটা নির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
ফেমিনিযম নিয়ে কথা ও বিশ্লেষনের সময় আমরা তাই “প্র্যাকটিসিং”-দের মধ্যে প্রচলিত “ইসলামি ফেমিনিযম” অথবা “প্র্যাকটিসিংদের যেসব সমস্যা বা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় সেটার ওপর বেশি ফোকাস করি। নানা কারণে এটা প্রবলেম্যাটিক। এভাবে সঠিক বিশ্লেষন ও পর্যালোচনা সম্ভব না, এবং এ প্রবণতা বিপজ্জনক। কারণ দাওয়াহর মূল উদ্দেশ্য শুধু “প্র্যাকটিসিং”-দের অ্যাড্রেস করা না। বরং কাফির ও নন-প্র্যাকটিসিংদের ক) “প্র্যাকটিসিং” বানানো, খ) সঠিক ইসলামী অবস্থানের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। যদি আমরা নির্দিষ্ট একটা বলয়কে নিয়ে সবসময় চিন্তা করি তাহলে আমাদের আদর্শের প্রসার হবে না বরং আমরা আরো বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো।
দ্বিতীয় ভুলটা হল কার্যকরনের দিকে যথাযথ মনোযোগ না দেয়া। রোগ এবং উপসর্গের মধ্যে পার্থক্য না করা। উপসর্গের দিকে নজর দিতে গিয়ে রোগের চিকিৎসা না করা, এবং/অথবা রোগ ডায়াগনোস করতে ভুল করা। এর অর্থ কী?
“ইসলামি ফেমিনিযম” নামে অক্সিমোরোনিক যে চিন্তাভাবনা আমরা দেখি সেটা একটা উপসর্গ। এবং এটা যতোটা না অ্যাকচুয়াল ফেমিনিযমের ফসল তার চেয়ে বেশি একটা বিশেষ ধরণের “দাওয়াহ”-র ফসল। আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, গোঁড়া ক্বওমি, আহলে হাদিস, তাবলীগি এবং সালাফিদের (এখানে গোঁড়া বলতে শুধু বাহ্যিক কাজ না বরং চিন্তা/দর্শনের কথাও বলছি) মধ্যে আপনি “ইসলামি ফেমিনিযম” অনেক, অনেক কম পাবেন। যদিও এ স্কুল অফ থটগুলোর নিজেদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য আছে।
অন্যদিকে যারা “ইসলামি ফেমিনিযমের” সবচেয়ে সক্রিয়, সরব কিংবা উত্তেজিত প্রচারক তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৮০% এর বেশি হয় জামায়াতে ইসলামি অথবা পশ্চিমা দা’ইদের প্রচার করা চিন্তাধারার হবার কথা, অথবা এমন কেউ যিনি আগে ইসলাম পালন করতেন না, এখন করেন, কিন্তু জাহেলিয়্যাহর ব্যাগেজ এখনো ছাড়তে পারেননি। এটা সিলেবাসের সমস্যা। “ইসলামি ফেমিনিযম” পশ্চিমা সেক্যুলার ফেমিনিযম আর ইসলামের মডারেট ও মর্ডানিস্ট ব্যাখ্যা জারজ সন্তান। ইসলামি ফেমিনিযম হল উপসর্গ, রোগ হল ইসলামের মডারেট-মর্ডানিস্ট ব্যাখ্যায়।
এছাড়া বহুবিবাহ বিরোধিতা, শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যাপারে মনোভাব ইত্যাদির মতো কিছুকে বিষয়কে আমরা অনেকে ফেমিনিযম বলি, যেগুলো আদতে ফেমিনিযমের সাথে সম্পর্কিত না, যদিও কিছুকিছু দিক থেকে এ অবস্থানগুলো ফেমিনিস্ট রেটোরিক কিংবা অ্যাপ্রোচের সাথে মিলে যায়।
সমস্যা হল, আমরা যদি প্রথম ভুলটা করি – অর্থাৎ মূল মনোযোগ ফেমিনিযমের বদলে “ইসলামি ফেমিনিযমের” দিকে দেই, এবং দ্বিতীয় ভুলটাও করি – অর্থাৎ মডারেট-মর্ডানিস্ট আদর্শ ও এর প্রচারকদের দিকে মনোযাগ না দেই, তাদের ভুলগুলো সরাসরি অ্যাড্রেস না করি – তাহলে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিবর্তন আশা করা কঠিন হয়ে যাবে। আমরা হয়তো নিজেদের বলয়ের মধ্যে জনপ্রিয়তার বিচারে উত্তীর্ণ কিছু লেখা পাবো, কিন্তু সেগুলো দিয়ে বৃহত্তর সমাজের ফেমিনিযমের সমস্যা এবং আমাদের নিজেদের ভেতরের “ইসলামি ফেমিনিযমের” সমস্যা কোনটারই মোকাবেলা ও খন্ডন হবে না।