নারী, নারীবাদ এবং প্যারাডাইম


[১]

মানুষ শূন্যতার মাঝে বেড়ে ওঠে না। সমাজ, সংস্কৃতি, সময় ও পরিস্থিতি আমাদের চিন্তা, চেতনা, বিশ্বাসকে শুধু প্রভাবিতই করে না, বরং আমাদের পুরো চিন্তার কাঠামোও ঠিক করে দেয় এধরনের ফ্যাক্টরগুলো। আমরা পৃথিবীকে দেখতে শিখি একটা নির্দিষ্ট লেন্সের ভেতর দিয়ে, একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে। আর যেহেতু ছোটবেলা থেকেই এই লেন্সের ভেতর থেকে আমরা পৃথিবীকে দেখছি তাই কোথায় লেন্সের শেষ হয় আর কোথায় পৃথিবীর শুরু, সেটা আমরা বুঝে উঠতে পারি না। ব্যাপারটা এভাবে চিন্তা করা যায় –  জনবিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপে শৈশব থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা একদল কালারব্লাইন্ড মানুষের পৃথিবীর অদ্ভূত সুন্দর নানান রঙের বর্ণালী নিয়ে কোন ধারণা থাকবে না। কেউ এসে হরেক রকমের উজ্জ্বল রঙের কথা বলা শুরু করলে তারা নির্ঘাত সেই মানুষটাকে পাগল ঠাউরাবে। প্রথম প্রথম তো মানতে চাইবেই না, লম্বা সময় নিয়ে যুক্তি-প্রমান দিয়ে বোঝানোর পরও দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়তো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। কারণ তাদের কাছে এটাই বাস্তবতা। এটাই তাদের কাছে অবিসংবাদিত সত্য।

অথবা এমন একজন মানুষের চিন্তা করুন, যে জন্মের পর থেকে ছোট্ট একটা ঘরে বন্দী। ঘরের এক দেয়াল জুড়ে বিশাল জানালা। এই জানালা বাইরের দুনিয়ার সাথে তার সংস্পর্শের একমাত্র মাধ্যম। জানালার কাঁচটা নির্দিষ্ট একটা রঙকে বেশি ফুটিয়ে তোলে। ধরা যাক, এই নির্দিষ্ট রঙটা হল হলুদ। কুড়েঘরের এই বন্দী পৃথিবীকে দেখে হলুদ রঙ্গের এক আভায়। গাছ, পাতা, পাখি, ফুল, ঘাস, আকাশ, সাগর, সব কিছুকে সে দেখে হলুদ রঙ্গের ফিল্টারের মধ্য দিয়ে। সে ধরে নেবে বাইরের দুনিয়াটা হলদেটে। সমস্যাটা তার চোখে না। বায়োলজিকালি তার মস্তিষ্কেও কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা জানালার কাঁচে। হলুদ রঙের কাঁচ আমাদের এই বন্দীর চিন্তাকে আটকে ফেলেছে একটা নির্দিষ্ট রঙে। গ্রিক দার্শনিক প্লেইটোর বিখ্যাত ‘গুহার গল্প’-এ অনেকটা একই রকমের একটা উদাহরণ দেয়া আছে।

কথাগুলো বলার কারণ হল আমাদের বাস্তবতাটা বোঝা। আমাদের চোখেও একটা চশমা দেয়া থাকে। একটা ফিল্টার, একটা লেন্স থাকে। এর ভেতর দিয়ে আমরা বাস্তবতা দেখি। এই লেন্সের রঙে গড়ে ওঠে আমাদের চিন্তাচেতনা। আমরা নিজেদের চিন্তাচেতনাকে ‘আনবায়াসড’ ভাবতে পছন্দ করি, কিন্তু কর্তৃত্বশীল সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, দর্শন, মিডিয়া ইত্যাদির কারণে তৈরি হওয়া বায়াস আমাদের চিন্তায় থেকে যায়। এ বায়াস থেকে বের হতে হলে সচেতনভাবে একটা লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যদি আমরা এই বায়াস কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা না করি, তাহলে আমরা সব সময় বাস্তবতাকে দেখবো ওপরের কালারব্লাইন্ড কিংবা কুড়েঘরের বন্দীর মতো। এমনকি আমাদের চোখে যে লেন্স দেয়া আছে হয়তো এক জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরও সেটা আমরা বুঝতে উঠতে পারবো না।

আজ আমাদের চোখে সেটে থাকা লেন্সটা পশ্চিমা। এই লেন্সের মধ্য দিয়ে আমরা যখন ইসলামকে দেখি তখন অনেক কিছু মেনে নেয়া আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। ইসলামের অনেক কিছু আমাদের কাছে ‘যৌক্তিক’, ‘আধুনিক’ কিংবা ‘উপযুক্ত’ মনে হয় না। ইন ফ্যাক্ট, ইসলামের মধ্যে এমন অনেক কিছু আমরা দেখি যেগুলোকে মনে হয় ছোটবেলা থেকে মুখস্থ করা ধ্যানধারণাগুলোর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এ মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। ইসলামের প্যারাডাইম, পশ্চিমা প্যারাডাইমের চেয়ে আলাদা। ব্যাপকভাবে আলাদা। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বাস্তবতা, জ্ঞান এবং নৈতিকতার যে শিক্ষা আমরা পাই সেটা পশ্চিমের ব্যাখ্যার সাথে মেলে না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ দুটো অবস্থান সাংঘর্ষিক। এ সংঘাতের সমাধান না করা হলে দুটো বিপরীতধর্মী বিশ্বাস একসাথে ধারণ করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে তৈরি হয় কগনিটিভ ডিযোন্যান্স। এমন অবস্থায় কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কেউ চেষ্টা করে পশ্চিমের সাথে মিলিয়ে ইসলামের নতুন ব্যাখ্যা দিতে। আর যাদের ওপর আল্লাহ্‌ ‘আযযা ওয়া জাল রহমত করেছেন তারা পশ্চিমা লেন্সটা খুলে ফেলে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে শেখে আল্লাহর কাছে।

ইসলামের বিভিন্ন বিধান নিয়ে আজ যে আমরা ‘খটকায়’ থাকি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার কারণ হল এই দুই প্যারাডাইমের সংঘর্ষ। গোলমালটা লাগে পশ্চিমা প্যারাডাইমের ভেতর থেকে ইসলামকে বিচার করার চেষ্টা থেকে। কটকটা হলুদরঙ্গা লেন্সের ভেতর দিয়ে নীল সমুদ্রকে খুব একটা সুন্দর লাগার কথা না। চোখের সামনে থেকে এই লেন্স যে সরাতে পারবে না, সমুদ্রের সৌন্দর্য নিয়ে লেখা সব কবিতা, সব কথা সারাজীবন তার কাছে বেখাপ্পা কিংবা ভুল মনে হবে। মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে সমুদ্রের সৌন্দর্য এক ফোঁটা কমবে না। সমুদ্র যে সুন্দর, বদলাবে না এই সত্য।

এটা আশা করে বসে থাকা যাবে না যে কটকটা হলুদ লেন্সের মধ্যে দিয়েই সমুদ্রকে সুন্দর লাগতে হবে। তা না হলে সমুদ্র কুৎসিত।

সমুদ্রকে দেখতে হলে চোখের সামনে থেকে লেন্স সরাতে হবে।

[২]

বর্তমানে যে বিষয়গুলোকে ব্যবহার করে ইসলামকে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হল ‘নারীর প্রশ্ন’। নারীর অবস্থান, ভূমিকা, অধিকার, পর্দা, বহুবিবাহ ইত্যাদি নিয়ে আজ নানাভাবে আক্রমন করা হয় ইসলামকে। আমরা  মুসলিরাও এমন অনেক বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি। মুসলিম নারীকে কেন্দ্র করে ইসলামকে আক্রমণ করার অভ্যাস পশ্চিমের পুরনো। কলোনিয়াল যুগের ওরিয়েন্টালিস্টরা মুসলিম নারীকে চিত্রিত করেছে হারেমে বন্দী কামুক নর্তকী হিসেবে। ভিক্টোরিয়ান ওরিয়েন্টালিস্টদের কলমে মুসলিম নারী এক রহস্যময় যৌনবস্তু। একই সাথে অতৃপ্ত ও তৃষিত। পশ্চিমা রক্ষাকর্তাকে ‘সুখ’ দিতে উন্মুখ, উদগ্রীব। গত শতাব্দীতেও মুসলিমদের আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদাবোধ, এবং প্রতিরোধের স্পৃহা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আলজেরিয়াতে ঔপনিবেশিক ফ্রান্সের আক্রমনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পর্দা। আর আজ পশ্চিমের কাছে মুসলিম নারী মানে বন্দী, নির্যাতিতা। পর্দা তার দাসত্বের চিহ্ন। এই নারীকে মুক্ত করার জন্য পবিত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমা রক্ষাকর্তা। নিউইয়র্ক টাইমস আর ওয়াশিংটন পোস্টের মতো পত্রিকাগুলোতে তাই নিয়মিত বিরতিতে আফগানিস্তান কিংবা ইরাকের নারীদের নিয়ে প্রতিবেদন করে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘ওরা কতো নির্যাতিত। ওদের রক্ষার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কতোটা গুরুত্বপূর্ণ’।  

এ ধরনের চিন্তা আমাদের প্রভাবিত করে। দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবিত করে আসছে। এধরনের চিন্তাকে আমাদের সমাজে ‘ডিফল্ট পযিশান’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে অনেক আগেই। পাতায় পাতায় স্পষ্ট কুফরি বক্তব্যের তুবড়ি ছুটিয়ে যাওয়া রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা আমাদের মুখস্থ করানো হচ্ছে স্কুলে থাকতে। জমিদারবাড়িতে জন্ম নেয়া আর লুটেরা ব্রিটিশের অধীনে চাকরি করা বাদামী ম্যাজিস্ট্রেট বাবুর বউ হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেয়া এই মহিলাকে উপস্থাপন করা হচ্ছে গ্রামবাংলার নারীদের জন্য অনুসরণীয় হিসেবে। নারীমুক্তির পথিকৃৎ হিসেবে। মুক্তির অর্থ যে আরো বেশি করে ‘পশ্চিমা’ হয়ে ওঠা!

এনজিও, মিডিয়া এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্রমাগত সরাসরি বা ইঙ্গিতে বলা হচ্ছে নারীর ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান ‘অমানবিক’, ‘বর্বর’, ‘ব্যাকডেইটেড’। পর্দাকে তাবু বলা হচ্ছে হাসতে হাসতে। ইসলামের বিধানকে তুচ্ছ করা হচ্ছে কারণ সেটা বাঙ্গালী সংস্কৃতি নামক কোন একটা একটা জোড়াতালি দিয়ে চাপিয়ে দেয়া বিষয়ের সাথে মেলে না। অন্যদিকে পপুলার কালচার (সেটা বাংলা টিভি, গান, ঢালিউড, বলিউড, হলিউড যাই হোক না কেন) নারী ও পুরুষের সম্পর্ক, মেলামেশা, ঘনিষ্ঠতার এমন একটা ছবি তুলে ধরছে যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। আমরা দেখছি সমাজ, সংস্কৃতি, মিডিয়া এক স্রোতে আগাচ্ছে, আর ইসলাম বলছে সম্পূর্ণ আলাদা কথা। এ সবকিছুর প্রভাব পড়ছে আমাদের চিন্তা ওপর। নারীর প্রশ্নে, আমরা পশ্চিমের কাছ থেকে কলকাতার রুট হয়ে আসা চিন্তার এ কাঠামোটা ধ্রুব সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নিচ্ছি। অনেকে বুঝেশুনে, অনেকে নিজের অজান্তে। আর এই কাঠামো আর লেন্স নিয়ে যখন আমরা কুরআন-সুন্নাহ পড়তে যাচ্ছি তখন মেনে নিতে পারছি না ওয়াহির বক্তব্য। পশ্চিমা লেন্সের ভেতর দিয়ে দেখার পর আল্লাহর কথা আর ‘ভালো লাগছে না’।

[৩]

এমন অবস্থায় কয়েক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একটা হল উগ্র ‘নারীবাদী’ অবস্থান। যারা মোটাদাগে বাংলাদেশের শাহবাগী-‘মুক্তমনা’ ক্যাম্পের অংশ। এই ক্যাম্পের লোকজন অনবরত ইসলামকে আক্রমণ করে যায়। তাদের মতে সমাধান হল জীবনের সব বলয় থেকে ইসলামকে সরিয়ে দেয়া।

দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়াটা সম্ভবত অধিকাংশ বাঙ্গালীর অবস্থান। এই বাঙ্গালী ইসলামের বিরোধিতা করে না। ধর্মভীরু মুসলিম বলে নিজের পরিচয় দেয়। কিন্তু নারীর সাথে যুক্ত ইসলামের অধিকাংশ বিধিবিধান সে মানে না। বাঙ্গালী কালচার, সমাজের ধারা, কিংবা অন্য কিছুর অজুহাত দিয়ে সে পিছলে বেরিয়ে যেতে চায়। সে ইসলামও মানে আবার পুরোপুরি ‘মুক্তমনা’ও না। সে দুটোর সুবিধাবী মিশ্রণ। এ ধরনের মানুষের কাছ থেকেই শোনা যায়, ‘মনের পর্দা বড় পর্দা’, ‘ইসলাম তো অতো কঠিন না’, ‘বিশ্বাস, ভক্তি তো অন্তরের বিষয়,’ ‘আমি প্রেম করছি কিন্তু আমার মন পরিষ্কার’, অথবা ‘বোরখা করে অমুক অমুক জায়গায় অমুক অমুক অপরাধ করা হয়েছে, এর চেয়ে বরং আমরাই ভালো আছি বাবা!’।

দীর্ঘ একটা সময় জুড়ে এ দুটোই ছিল প্রধান অবস্থান। কিন্তু বর্তমানে, গত প্রায় পনেরো-বিশ বছর ধরে অ্যামেরিকার ‘মডারেট ইসলাম’ প্রকল্পের ফসল হিসেবে তৃতীয় এক ধরনের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ প্রতিক্রিয়াটা হল রিভিশনিস্ট, রিফর্মিস্ট এবং ‘মুসলিম’ ফেমিনিস্টদের অবস্থান। মর্ডানিস্ট এবং অ্যামেরিকার পছন্দের ‘মডারেট’ মুসলিমদের অবস্থান। সহজ ভাষায় এ অবস্থানটা হল পশ্চিমের সাথে খাপ খাওয়ানোর। নারীর ব্যাপারে ইসলামের যে অবস্থানটা পশ্চিমের সাথে সাংঘর্ষিক সেটাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার। এই ‘ব্যাখ্যার’ তোড়ে হিজাব হয়ে যাচ্ছে ‘ব্যাক্তি স্বাধীনতা’,  নারীর ঘরের বাইরে অবস্থান সংক্রান্ত পুরো ফিকহ হয়ে যাচ্ছে ‘ইজতিহাদি’ এবং ‘ইখতিলাফি’। আর পশ্চিমা ধাঁচের নারীর ক্ষমতায়ন আর নারী মুক্তির উদাহরণ খোঁজা হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সীরাহ-তে।

যেমন ‘ক্যারিয়ার ওম্যান’-এর উদাহরণ হিসেবে খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর উদাহরণ দেয়া হয়। তিনি সিইও ছিলেন আন্ট্রাপ্রনোর ছিলেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। মা খাদিজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর উদাহরণ আজকের যুগে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে আদৌ প্রযোজ্য কি না সেটা নিয়ে লম্বা আলোচনা করা সম্ভব। কিন্তু সে আলোচনা যদি আমরা বাদও দেই তাহলেও প্রশ্ন থাকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোট ১১ জন স্ত্রী ছিলেন। বাকি ১০ জন তো ব্যবসা করেননি। চাকরি করেননি। তাঁরা ঘরের ভেতরে জীবন কাটিয়েছেন। কেন ১০ জনকে ছেড়ে ১ জনের নবুওয়্যাতের জীবনের আগের উদাহরণকে এতো শক্ত করে আকড়ে ধরা?

আবার ইসলাম নারীর ক্ষমতায়ন করেছে, এটা প্রমাণ করতে গিয়ে অনেকে ইসলামের ইতিহাসের নারী আলিমদের কথা বলেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁদেরকে দাড় করিয়ে বলেন আজ মুসলিম নারীদের উচিৎ দলে দলে ঘর থেকে কর্মক্ষেত্রে বেরিয়ে আসা। কিন্তু এই আলিমাগণ কি মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসের অধিকাংশ নারীর অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করেন? প্রায় সাড়ে চৌদ্দশো বছরের ইতিহাসে কতো শতাংশ মুসলিম নারী আলিম হবার চেষ্টা করেছেন, আর কতো শতাংশ মা ও স্ত্রী হিসেবে ঘরে সময় দিয়েছেন? নাম না জানা যে কোটি কোটি মুসলিমাহ শরীয়াহর বিধান অনুযায়ী মা ও স্ত্রী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। উলামা ও মুজাহিদিন জন্ম দিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন –  তাঁরা কি সবাই ব্যর্থ? নির্যাতিত? পুরুষতন্ত্রের শিকার? এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয় না।

পশ্চিমা অর্থে ‘নারী শিক্ষা’র উদাহরণ হিসেবে আ’ইশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এবং ইসলামী ইতিহাসের অন্যান্য মুহাদ্দিসাদের (হাদীস বিশারদ) কথা বলা হয়। যে মহান নারীদের উদাহরণ দেয়া হচ্ছে তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাঁরা ইলম অর্জন করেছিলেন। ইলম আর আজ ‘শিক্ষা’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা এক না। দুটোর মধ্যে আছে অনেক, অনেক পার্থক্য। এই ইলম অর্জনের কাজটা তাঁরা করেছিলেন পর্দা, মাহরাম, ঘরের ভেতরের দায়িত্ব, নারী পুরুষের মেলামশা সংক্রান্ত ইসলামের সব বিধান মেনে। সেটা আজ সম্ভব কি না, তা নিয়ে কিন্তু কথা বলা হয় না। আ’ইশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাঁর স্বামী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে শোনা হাদীস বর্ণনা করেছেন। এর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশিওলজি পড়া, কিংবা হায়ার স্টাডিসের জন্য অস্ট্রেলিয়া কিংবা অ্যামেরিকা যাওয়ার ক্বিয়াস সূস্থ মস্তিষ্কে কিভাবে করা যায় না সেটাও খুব কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

সীরাহ এবং ইসলামী ইতিহাস থেকে বেছে বেছে কিছু তথ্য নিয়ে মুখস্থ অংকের উত্তর মেলানোর জন্য সেগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে তুলে ধরা হয়। ইসলামকে ব্যাখ্যা করা হয় পশ্চিমা ছাঁচে। এভাবে ইসলামকে ‘রক্ষা’ করতে গিয়ে বিকৃত করা হয় ইসলামকে। প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়, পশ্চিম যে নারী শিক্ষা আর ক্ষমতায়নের কথা বলছে সেটা ইসলামে আরো আগে থেকেই আছে। অথচ বাস্তবতা হল পশ্চিমা প্যারাডাইম যেভাবে নারীর পরিচয় ও ভূমিকাকে সংজ্ঞায়িত করে, ইসলাম সেভাবে করে না। ইসলামে নারীর মূল দায়িত্ব, ভূমিকা এবং অবস্থান তাঁর ঘরে। পশ্চিমা নারীবাদের অবস্থান থেকে কোন ভাবেই এটাকে মেনে নেয়া সম্ভব না।  ইসলামে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা ভূমিকা ঠিক করে দেয়া হয়েছে। তাঁরা একে অপরের প্রতিযোগী না, তাঁরা একে অপরের সমান না, বরং তাঁরা একে অপরের পরিপূরক।

এভাবে এক দল ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করছে, আরেক দল মুসলিম হবার কথা বললেও ইসলামের কিছু বিধিবিধান সারাজীবন উপেক্ষা করে যাচ্ছে, আরেক দল ইসলামের নতুন ব্যাখ্য তৈরি করছে পশ্চিমের আদলে। এ তিন প্রতিক্রিয়ার পেছনে মূল কারণ নারীর প্রশ্নে ইসলামের অবস্থানকে মেনে নিতে না পারা। তিন প্রতিক্রিয়াই চোখে শক্ত করে আঁটা পশ্চিমা লেন্সের ফসল।

[৪]

পশ্চিমা লেন্সের মতো আরো একটা লেন্স আছে যা নারীর প্রশ্নে আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। সেটা হল ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে গভীর শেকড় গেড়ে থাকা ‘হিন্দুয়ানি’ চিন্তা, আচার, প্রথা আর কুসংস্কারের লেন্স। আমরা যতো আধুনিকতার দাবি করি না কেন, এই লেন্সের খপ্পর থেকে এখনো আমরা বের হতে পারিনি। এ লেন্সের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপারটা হয়। ইসলামের ওপর আমরা এই লেন্সকে প্রাধান্য দেই। যখন কোন বিধান পছন্দ হয় না, তখন সেটাকে রাঙিয়ে দেই এই লেন্সের রঙে।

এটা যে শুধু মোটাদাগে বৃহত্তর সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা না। যারা ইসলাম বোঝার ও মানার দাবি করেন তাঁদের বড় একটা অংশ এই বক্স থেকে বের হতে পারেন না। যেমন, স্বামীর পিতামাতার প্রতি স্ত্রী-র দায়িত্বের সীমানা কতোটুকু, কোনটা নারীর আবশ্যিক দায়িত্ব কোনটা তাঁর ইহসান, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্বগুলো কী কী – এসব প্রসঙ্গে ফকিহদের বক্তব্য আনলে অনেক ইসলাম মাননেওয়ালাও খেপে যান। এর পেছনে আবিষ্কার করেন নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন নিজের পছন্দের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠা করতে।

বাস্তবতা হল, ইসলাম নারীকে যে অধিকার দিয়েছে, যে ভূমিকা ঠিক করে দিয়েছে আমরা সেগুলো সামাজিকভাবে বাস্তবায়ন করিনি। আবার ‘ধর্মের দোহাই’ দিয়ে এমন অনেক কিছু নারীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছি যেগুলোর সাথে সনাতন ধর্মের লেনদেন থাকলেও, ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা এক ধরনের ‘ট্র্যাডিশানালিযম’ এর মধ্যে আছি যা বিভিন্ন হিন্দুয়ানি আচার, প্রথা এবং বিদআহর মিশ্রণ।

আমরা হয় ধর্মের নামে হিন্দু সংস্কৃতি ও সংস্কার প্রভাবিত ট্র্যাডিশানালিযম আকড়ে থাকি, অথবা পশ্চিমা ছকে আঁকি নারী মুক্তির নকশা। এ দুই লেন্সের ফাঁদে পড়ে জীবন কেটে যায়। এ অবস্থানের কারণে সমাজে জিইয়ে থাকে নারীর প্রতি নির্যাতন এবং যুলুম। সেই যুলুমের পেছনের কারণ ও সমাধান নিয়ে আমরা খোলাখুলি আলোচনা করি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা ইসলামের অবস্থান থেকে এ সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি না। বরং নানানভাবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি ‘উপমহাদেশীয় ট্র্যাডিশানালিযম’ কিংবা ‘অর্থোডক্সি’-কে। যার কারণে স্বাভাবিকভাবে থেকে যাচ্ছে অসন্তোষ ও ক্ষোভের একটা জায়গা। এ কাজে লাগিয়ে পশ্চিমা নারী স্বাধীনতা, নারী মুক্তি আর নারীবাদ ফেরি করে যাচ এনজিও, মিডিয়া, নকশা, অধুনা কিংবা একেক যুগের ‘বেগম’ রোকেয়ারা।

ক্ষোভ ও অসন্তোষের পেছনের যৌক্তিক কারণগুলোর সমাধান ইসলামের অবস্থান থেকে না করা পর্যন্ত পশ্চিমের এ আগ্রাসন মোকাবেলা করা সম্ভব না। আমরা যতোই নারীবাদী কিংবা ‘মুসলিম’ ফেমিনিস্টদের নিয়ে অভিযোগ করি না কেন, বাস্তবতা হল তারা তাদের বিষ ফেরি করার সুযোগ পায় কারণ আমরা তাদের সে জায়গা দিয়ে রেখেছি। আমাদের সমাজ তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে রেডিমেইড গ্রাহক শ্রেণী। তাই রোগের চিকিৎসা না করে উপশম নিয়ে হাকডাক করে খুব একটা লাভ হবে না।

অনেকের হয়তো মেনে নিতে কষ্ট হবে। সেটা হতে পারে পশ্চিমা লেন্সের জায়গা থেকে কিংবা হিন্দুয়ানী কালচার প্রভাবিত ট্র্যাডিশানালিযমের জায়গা থেকে। এই কষ্টটুকু হওয়া স্বাভাবিক, এবং চিন্তার যে বক্সের মধ্যে আমরা আটকে গেছি সেখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য এ কষ্টটুকু করা আবশ্যিক। তবে যদি নিচের আয়াত দুটির বক্তব্য যদি আমরা মাথায় রাখি, তাহলে ইন শা আল্লাহ্‌, সত্যটাকে মেনে নেয়া খুব একটা কঠিন হবে না।

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

তরজমা – আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী উক্ত নির্দেশের ভিন্নতা করার কোন অধিকার রাখে না। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে সে স্পষ্টতই সত্য পথ হতে দুরে সরে পড়ল। [সূরা আল-আহযাব, ৩৬]

এবং তিনি বলেন,

তরজমা – মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি এ মর্মে আহ্বান করা হয় যে, তিনি তাদের মধ্যে বিচার, মীমাংসা করবেন, তাদের কথা তো এই হয় যে, তখন তারা বলে: ‘আমরা শুনলাম ও আনুগত্য করলাম’ – আর তারা-ই সফলকাম। [তরজমা, সূরা আন্-নূর, ২৫] ৫১)

15/02/2020, 19:56