দুজন মানুষ। একজন দুইবেলা রুটিন করে মদ খান। তবে মদ খাওয়াকে হারাম মনে করেন। নিয়মিত একটি কবীরা গুনাহ করার অপরাধবোধ তার মধ্যে কাজ করে। তবে নিজের দুর্বলতা আর সদিচ্ছার অভাবে ছাড়তে পারেন না। এজন্য মাঝেমধ্যে মাতাল হয়ে কান্নাকাটিও করেন। আরেকজন জীবনে মদ ছুয়েও দেখেননি। বন্ধুদের আড্ডা কিংবা বিশেষ অকেশনে সবাই যখন একটু গলা ভেজায়, তখনো তিনি মদ ধরেন না। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, মদ খাওয়া বা না খাওয়া প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যার ভালো লাগবে খাবে, যার ইচ্ছে হবে না সে খাবে না। এ ব্যাপারে প্রতিটি ব্যক্তি স্বাধীন।
দুজনের মধ্যে মানুষ হিসেবে কে ভালো?
সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দ্বিতীয়জন প্রথমজনের চেয়ে ভালো। আমাদের অনেকের কাছেই হয়তো অবাক লাগতে পারে কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাপারটা উল্টো। কারন ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথমজন জেনেশুনে হারাম কাজ করছেন। কবীরা গুনাহ করছেন, যা হল ফিসক্ব। দ্বিতীয়জন যদিও হারাম কাজ করছেন না, কিন্তু তিনি এ কাজকে হারাম মনে করছেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, যে মদ খেতে চায় তার জন্য মদ খাওয়া হালাল। আল্লাহ যা স্পষ্টভাবে হারাম করেছেন তিনি সেটাকে ইচ্ছে সাপেক্ষে হালাল মনে করেন। আর এ ধরনের বিশ্বাস কুফর। আল্লাহ, তাঁর কিতাব ও তাঁর নাযিলকৃত শারীয়াহর উপর অবিশ্বাস।
দুঃখজনক ব্যাপার হল আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, সনাতন ধর্ম, প্রথা, কুসংস্কার ইত্যাদি মেলানো এক জগাখিচুড়ি। বিশুদ্ধ ইসলামী মূল্যবোধের সাথে এর ফারাক অনেক। অনেকক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক, যেমনটা উপরের উদাহরণে আমরা দেখলাম। সঠিক ইসলামী জ্ঞানের অভাবে আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই এ খিচুড়ি মূল্যবোধ নিয়ে বড় হয়ে ওঠেন। জীবন কাঁটিয়ে দেন। আর তাই অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক ইসলামী অবস্থান তুলে ধরা হলে আমাদের তা গ্রহন করতে কষ্ট হয়।
কিছুদিন আগে NowThisNews নামের অ্যামেরিকান ডিজিটাল নিউয কোম্পানি দুটো সংক্ষিপ্ত ভিডিও রিপোর্ট বের করে। প্রথমটি ছিল অ্যামেরিকান টিভি চ্যানেল Freeform এর একটি নতুন সিরিয নিয়ে। সিরিযে হিজাব পরিহিতা একজন মুসলিম লেসবিয়ান নারীকে দেখানো হয় যে একজন ফ্যাশন ফটোগ্রাফারও। সিরিযের মূল নারীচরিত্রগুলোর একটি যখন এই হিজাবির প্রেমে পড়ে তখন সে তাকে হিজাবের ব্যাপারে প্রশ্ন করে। কারন পশ্চিমা সমাজে অনেকেই হিজাবকে নারীর দাসত্বের সিম্বল মনে করে। হিজাবি লেসবিয়ান প্রশ্নের জবাবে বলে – I choose to wear the hijab – “হিজাব পরা আমার সিদ্ধান্ত”। তারপর এই ‘হিজাবি’ ব্যাখ্যা করে কেন তার হিজাব পরার সিদ্ধান্ত নারীদের ব্যাপারে পশ্চিমা সমাজের যে প্রচলিত ধারণা তার বিরুদ্ধে একটি প্রতীকি প্রতিবাদ। সে হিজাব পরে কারন সমাজ চায় নারী একটি নির্দিষ্টভাবে নিজেকে উপস্থাপন করুন। কিন্তু নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তৈরি করা এধারনা মানতে সে রাজি না। নারী নিজে সিদ্ধান্ত নেবে তার পোশাকের ব্যাপারে। অন্য কেউ না। হিজাবি লেসবিয়ানকে নিয়ে তৈরি করা এ ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়।
NowThisNews এর দ্বিতীয় ভিডিওটি ছিল সম্প্রতি বাংলাদেশের সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি খবর নিয়ে। একজন নারী তার বিয়ের অনুষ্ঠানে কোন ধরনের মেইকআপ ছাড়া উপস্থিত হন। NowThisNews এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট করে এবং এ মহিলাকে নারীদের ব্যাপারে, বিয়ের কনের ব্যাপারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে স্টেরিওটাইপগুলো আছে তা ভাঙ্গার ক্ষেত্রে, নারীর ক্ষমতায়নের একজন অগ্রদূত হিসেবে উপস্থাপন করে। এ মজার ব্যাপার হল লেসবিয়ান ফ্যাশন ফটোগ্রাফারের মতো জাকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানে মেইকআপ না করে আসা এই অগ্রদূতও হিজাবী। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া ‘স্রোতের বিপরীতে দাড়ানো’ এই হিজাবী আইকনও পুরুষতন্ত্র নিয়ে বানানো তার অন্য এক ভিডিওতে বলেন, একজন নারী কী পরবেন, তিনি মাথায় কাপড় দেবেন কি না, সেটা একান্তই তার সিদ্ধান্ত। যখন আমরা ইয়োরোপের বুরকা-ব্যানের বিরুদ্ধে কথা বলি, কিন্তু আমাদের নিজেদের দেশের নারীদের মাথায় কাপড় দিতে বাধ্য করি তখন তা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। হিপোক্রিসি।
যারা লিবারেল পশ্চিমা আদর্শ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন তাদের কাছে এ কথাগুলো পরিচিত মনে হবার কথা। এটা স্ট্যান্ডার্ড লিবারেল-ফেমিনিস্ট রেটোরিক। যখন ফ্রান্স কিংবা ইয়োরোপের অন্যান্য জায়গায় বোরখা পরা নিষিদ্ধ করা হয়, তখন কিছু পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এর সমালোচনা করে। তারা মুসলিম নারীদের বোরখা পরার অধিকারের পক্ষে বলে। আমরা এটুকুতেই খুশি হয়ে যাই। আমরা মনে করি তারা পর্দার পক্ষে বলছে। কিন্তু তাদের কথাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খেয়াল করে শুনি না। তারা বলে – একজন নারীকে পর্দা খুলতে বাধ্য করা, একজন নারীকে পর্দা করতে বাধ্য করার মতোই অপরাধ। দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
একজন মুসলিম কখনোই একথা মেনে নিতে পারে না। পর্দা নারী স্বাধীনতার সিম্বল না, পর্দা স্টেরিওটাইপ ভাঙ্গার কোন উপকরণ না। পর্দা কোন ফ্যাশন স্টেইটমেন্ট না। পর্দা এস্টাবলিশমেন্টের বিরোধিতা করার জন্য কোন স্টান্ট না। পর্দা জাস্ট একটা ‘চয়েস’ না। পর্দা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ফরয বিধান, যা মানতে প্রত্যেক মুসলিম বাধ্য। অন্যদিকে পর্দা জোর করে খোলা আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার এবং আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করা। কোনভাবেই এদুটো এক হবার প্রশ্ন আসে না।
একজন মুসলিম নারী কোন অর্থহীন আদর্শ বা নিজের জন্য একটা আইডেন্টিটি তৈরি করার জন্য পর্দা করেন না। তিনি পর্দা করেন আল্লাহর ফরয বিধান মানার জন্য। এখানে আমাদের নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন সুযোগ নেই। প্রত্যেক মুসলিম নারী ও পুরুষ বাধ্য পর্দার বিধান মেনে চলতে ও বাস্তবায়ন করতে। এবং পশ্চিমা ইসলামবিদ্বেষীদের কথা আংশিকভাবে সঠিক। পর্দা নারীমুক্তির চিহ্ন না, পর্দা আত্মসমর্পন ও দাসত্বের চিহ্ন। তবে পুরুষতন্ত্র কিংবা অন্য কোন তন্ত্রের প্রতি না। পর্দা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ও তাঁর ইচ্ছের প্রতি, তাঁর দ্বীনের প্রতি, তাঁর নাযিলকৃত শারীয়াহর প্রতি আত্মসমর্পনের চিহ্ন। পর্দা হল আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা, তাক্বওয়াসম্পন্ন মুসলিম নারীর শালীনতা ও বিনীত হবার চিহ্ন। কিন্তু লিবারেল ওয়েস্ট আল্লাহ্র প্রতি নারীর আত্মসমর্পন ও দাসত্বের এ চিহ্নকে সম্পূর্ণভাবে উল্টে দিয়ে একে নারীমুক্তি, প্রথাবিরোধিতা, নারী অধিকার জাতীয় বিভিন্ন ধ্যানধারনার সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। এর পেছনে তাদের আন্ডারলাইয়িং দর্শন হল একটি কুফর বিশ্বাস যা বলে – “একজন নারীকে পর্দা খুলতে বাধ্য করা, একজন নারীকে পর্দা করতে বাধ্য করার মতোই অপরাধ। তারা আর তারা এ দর্শনকে প্রচার করার জন্য ব্যবহার করছে বিভিন্ন সেনসেইশেনাল হিজাবী আইকনকে”। আর সঠিক ইসলামী জ্ঞানের অভাবে, ইসলামে দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অজ্ঞ হবার কারনে আমরা অনেকেই তাদের আপাত সমর্থন দেখেই খুশি হয়ে যাচ্ছি। এধরনের ব্যক্তি ও ধ্যানধারণাকে প্রচার করছি।
দুজন মানুষ। একজন পর্দা করেন না। পারপার্শ্বিকতা, নিজের ইমানের দুর্বলতা ইত্যাদি কারনে তিনি পর্দা করেন না। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন পর্দা করা আল্লাহর ফরয বিধান যা মানতে প্রত্যেকে বাধ্য। অন্যজন হিজাব করেন। তিনি বিশ্বাস করেন হিজাব করা বা না করা প্রত্যেক নারীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এখানে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। বরং হিজাব হল নারীর স্বাধীনতা, তার মুক্তির, তার স্বতন্ত্র-স্বাধীন পরিচয়ের একটি চিহ্ন।
প্রথম জন আল্লাহর ফরয বিধান পালন না করা ও আল্লাহর অবাধ্য হবার কারনে ফিসক্ব করছেন। কিন্তু দ্বিতীয়জন হিজাব করা সত্ত্বেও কুফর করছে। যদি সে ধ্যানধারণা প্রচার করে তাহলে সে কুফর প্রচার করছে ও কুফরের দিকে আহবান করছে। নিঃসন্দেহে ইসলামের দৃষ্টিকোণ হিজাব না করা প্রথমজন, দ্বিতীয়জনের চেয়ে ভালো।
এটা ইসলামের সবগুলো বিধানের ক্ষেত্রেই সত্য। আল্লাহর উপর ঈমান না, ইসলামের ফরয বিধান পালন করা, মানবরচিত বিধিবিধান বাদ দিয়ে আল্লাহর আইন দিয়ে শাসন করা, কুফর-শিরক থেকে দূরে থাকা, হারাম বর্জন করা- এগুলো নিছক ‘চয়েস’- এর ব্যাপার না। এগুলো হল অনন্তকালের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়। ইসলাম কোন ব্যুফে না। ইসলাম আমাদের ভালোলাগা খারাপ-লাগার উপর নির্ভরশীল না। ইসলাম শাশ্বত। ইসলাম আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, খেয়াল-খুশি কিংবা সমাজের প্রচলিত প্রথা, ধ্যানধারণা মেনে চলতে বাধ্য না। বরং উল্টোটাই সত্য।
আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল বলেন –
আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারী উক্ত নির্দেশের ভিন্নতা করার কোন অধিকার রাখে না। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে অমান্য করে সে স্পষ্টতই সত্য পথ হতে দুরে সরে পড়ল। [আল আহযাব, ৩৬]