সাইদ বিন যুবাইর রাহিমাহুল্লাহ ছিলেন সায়্যিদিনা ইবনু আব্বাসের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু প্রবীণ সাথীদের অন্যতম। তাঁকে তাফসীর, ফিকহ ও অন্যান্য শাস্ত্রের ইমামদের একজন মনে করা হতো। হাজ্জায ইবন ইউসুফের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সাইদ সেনাপতি ইবনুল আশ’আসের সাথে যোগ দেন। বিদ্রোহ ব্যার্থ হবার পর সাইদ মক্কা পালিয়ে যান। দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করার পর মক্কার তৎকালীন গভর্নর খালিদ ইবন আব্দুল্লাহ আল-ক্বুসরি তাঁকে গ্রেফতার করেন, এবং একজন দূতসহ বন্দি সাইদকে হাজ্জাযের কাছে পাঠান।
তিনদিন ধরে দূত দেখলো, সাইদ তাঁর দিনগুলো কাটান সিয়ামে, আর রাত কাটান নামাযে। এক পর্যায়ে দূত তাঁকে বললো – “ওয়াল্লাহি, আমি আপনাকে এমন একজনের কাছে নিয়ে যাচ্ছি যে আপনাকে হত্যা করবে। আপনি এই মূহুর্তে এখান থেকে পালিয়ে যান।” যদি আগে কোন সংশয় থেকেও থাকে, এ কথার পর সাইদ নিশ্চিত হয়ে গেলেন তাঁর জন্য কী অপেক্ষা করছে। কিন্তু তিনি জবাবে বললেন – “তুমি যে আমাকে বন্দি করেছো নিশ্চিতভাবেই ও খবর হাজ্জাযের কাছে পৌছাবে। তুমি আমাকে ছেড়ে দিলে সে তোমাকে হত্যা করবে। তুমি বরং আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো।”
হাজ্জাযের সামনে সাইদকে আনা হল। হাজ্জায তাঁকে প্রশ্ন করলো –
“তোমার নাম কী?”
— “সাইদ ইবন যুবাইর।”
“না, বরং তুমি হলে শাক্বি ইবন কুসাইর”
শাব্দিকভাবে সাইদ ইবন যুবাইর অর্থ পরাক্রমশালী ব্যক্তির আনন্দিত পুত্র। হাজ্জায তাচ্ছিল্য করে তাঁকে “ভগ্ন ব্যক্তির দুর্দশাগ্রস্থ পুত্র” বলে সম্বোধন করলো। সাইদ রাহিমাহুল্লাহ জবাব দিলেন –
— “আমার মা আমার নাম সাইদ রেখেছেন।”
“তুমি দুর্ভাগা, তোমার মা-ও দুর্ভাগা।”
— “তুমি গ্বাইব জানো না, কেবল একজনই (আল্লাহ) জানেন।”
“আমি দুনিয়ার জীবন বদলে তোমাকে জাহান্নামে স্থান দেবো।”
— “তোমার এ সিদ্ধান্ত দেয়ার ক্ষমতা থাকলে তোমাকে ছাড়া আমি আর কোন ইলাহ গ্রহণ করতাম না।”
এবার হাজ্জায তাঁকে প্রশ্ন করলো –
“আল্লাহর রাসূলের ﷺ ব্যাপারে তুমি কী বলো? ”
— “আল্লাহর মনোনীত নবী – যারা আছেন এবং যারা গত হয়েছেন সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ।”
আবু বাকর আস-সিদ্দিকের ব্যাপারে তুমি কী বলো?
— “তিনি ছিলেন গুহায় অবস্থানকারীদের দু’জনের মধ্যে দ্বিতীয়। তাঁর মাধ্যমে দ্বীনকে গৌরবান্বিত এবং বিভক্তির সময়ে ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছে।”
সাওর পর্বতে রাসূলুল্লাহর ﷺ সাথে আবু বাকর আস-সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু অবস্থান করেছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন – “ আল্লাহ তো তাকে সেই সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিয়েছিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল, যখন সে তার সঙ্গীকে বলছিল, ‘চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন’।” [সূরা আত-তাওবাহ, ৪০]
হাজায প্রশ্ন চালিয়ে গেলো –
“উমার ইবনুল খাত্তাবের ব্যাপারে তুমি কী বলো? ”
— “আল্লাহর ফারুক্ব। তাঁর সৃষ্টির অভিজাতদের একজন। আল্লাহর দ্বীনকে দুইজনের একজনের মাধ্যমে সম্মানিত করাকে পছন্দ করেছিলেন। সচ্চরিত্র এবং নৈতিকতার দিক দিয়ে তিনিই ছিলেন দুজনের মধ্যে যোগ্য।”
মক্কায় রাসূলুল্লাহ ﷺ দু’আ করেছিলেন, আল্লাহ যেন দুই ‘আমরের একজনেরর মাধ্যমে দ্বীনকে শক্তিশালী করেন। একজন ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব এবং অন্যজন ছিল আমর ইবন হিশাম, যাকে আমরা আবু জাহল নামে চিনি। আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল দ্বীন ইসলামের জন্য উমার ইবনুল খাত্তাবকেই পছন্দ করেছিলেন। এ ব্যাপারে হাদিস আছে মুসনাদ আহমাদ ও তিরমিযিতে।
এভাবে হাজ্জায একের পর এক খালিফাহর ব্যাপারে প্রশ্ন করতে থাকলো, এক সময় সে প্রশ্ন করলো –
আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ানের ব্যাপারে তুমি কী বলো?
— “যদি সে মুহসিন হয়ে থাকে তাহলে তাঁর সৎ কাজের প্রতিদান আল্লাহর কাছে। আর সে যদি অপরাধী হয়ে থাকে তবে আল্লাহর শাস্তি থেকে সে পালাতে পারবে না।”
“আমার ব্যাপারে তুমি কী বলো?”
সাইদ ইবন যুবাইরের রাহিমাহুল্লাহ সামনে একটি সুযোগ আসলো। হাজ্জাযের ব্যাপারে প্রশংসাসূচক কিছু কথা বলতেন হয়তো তিনি নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু অত্যাচারী শাসকের সামনে আপসের সুযোগ পাবার পর একজন হকপন্থি আলিমের সামনে কী অবস্থান নেয়া উচিৎ, তার এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত সাইদ ইবন যুবাইর স্থাপন করলেন। তিনি জবাব দিলেন –
— “নিজের ব্যাপারে আমার চেয়ে তুমিই ভালো জানো।”
“তুমি যতোটুকু জানো, আমাদের জানাও।”
— “আমরা কথা তোমাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ করবে।”
“বলো।”
— “ঠিক আছে। তুমি আল্লাহর নির্ধারিত সীমার লঙ্ঘন করেছো। আল্লাহর আওলিয়াদের হত্যার মাধ্যমে তুমি চরম ঔদ্ধত্য ও অবাধ্যতা দেখিয়েছো।”
এ কথার দ্বারা সাইদ ইবন যুবাইর রাহিমাহুল্লাহ নিজ মৃত্যুর সমন সই করলেন। নিশ্চিত মৃত্যুকে উপেক্ষা করে তিনি সত্য উচ্চারণ করলেন। নিজের জীবন তুচ্ছ করে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ক্রুদ্ধ হাজ্জায বললো –
“আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করবো।”
— “তাহলে তুমি আমার দুনিয়া ধ্বংস করবে, কিন্তু আমি তোমার আখিরাত ধ্বংস করবো। নিশ্চিতভাবেই তোমার কর্মফল তোমার দিকে আসছে।“
“আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্য ধ্বংস!”
— “ধ্বংস তো তার জন্য যাকে জান্নাত দেয়া হয়নি এবং জাহান্নামে প্রবেশ করানো হয়েছে।”
“একে নিয়ে যাও, এবং গর্দান উড়িয়ে দাও।”
— “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ তাঁর গোলাম ও রাসূল। পুনরুত্থানের দিন পরস্পরের মুখোমুখি হওয়া পর্যন্ত আমার এ সাক্ষ্য তোমার (হাজ্জায) কাছে আমানত রইলো।”
শিরচ্ছেদের জন্য সাইদকে নিয়ে যাবার সময় তিনি হাসছিলেন। হাজ্জায তাঁকে প্রশ্ন করলো –
“তুমি কী নিয়ে হাসছো? ”
— “আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল -এর প্রতি তোমার ঔদ্ধত্য দেখে।”
ক্রুদ্ধ হাজ্জায বললো –
“একে জবাইয়ের জন্য শোয়াও।”
সাইদ বললেন – “আমি একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর দিকে আমার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি যিনি আকাশমন্ডলী আর পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” [সূরা আল-আন’আম, ৭৯]
“এর মুখ ক্বিবলার দিক থেকে ঘুরিয়ে দাও! ”
— “পূর্ব পশ্চিম আল্লাহরই, সুতরাং তোমরা যে দিকেই মুখ কর না কেন, সেদিকেই আছে আল্লাহর চেহারা, আল্লাহ সুবিস্তৃত, সর্বজ্ঞ।” [আল-বাক্বারা,১১৫]
“উপুড় করে এর মুখ মাটিতে চেপে ধরো! ”
— “মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, মাটিতেই আমি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেব এবং মাটি থেকেই তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব।” [সূরা ত্ব-হা, ৫৫]
“একে যবেহ করো! ”
— “হে আল্লাহ আমার পর কারো ওপর তাকে শক্তি দিও না।”
সাইদ ইবন যুবাইরকে উপুড় করে পেছন থেকে জবাই করা হল। বলা হয়ে থাকে যখন আল হাসান আল-বাসরির রাহিমাহুল্লাহ কাছে এ খবর পৌছলো, তিনি বলেছিলেন – “হে আল্লাহ! হে পরাক্রমশালীদের চূর্ণ-বিচূর্ণকারী! তুমি হাজ্জাযকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করো!” এ ঘটনার পর হাজ্জায পেটের কীটজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী এ ঘটনার ১৫ দিন পর, কোন বর্ণনা অনুযায়ী ৪০ দিন পর এবং কোন বর্ণনা অনুযায়ী এ ঘটনার মাত্র তিনদিন পর হাজ্জাযের মৃত্যু হয়।
আমরা আজ খুব সহজেই আলিম ও দা’ঈদের ব্যাপারে “হকপন্থি”, “হক্বানি” “সত্যের পথে অবিচল” – এ জাতীয় বিশেষনগুলো ব্যবহার করি। তাওয়াগ্বিত ও কুফফারের সাথে আপস করা, তাদের প্রেসক্রিপশান অনুযায়ী দ্বীনকে পরিবর্তন করা, শাসকের ছত্রছায়ায় বসে ইলম বিক্রি করা লোকেরাও আমাদের কাছে আজ হক্বপন্থি, হক্কানি, “সালাফদের যোগ্য উত্তরসূরি” খেতাব পায়। সম্ভবত সত্যের সাথে আপস না করা, অত্যাচারীর সামনে মাথা নত না করার সংজ্ঞা পালটে গেছে। অথবা আমাদের স্ট্যান্ডার্ড খুব নিচে নেমে গেছে। সত্যিকারের দৃঢ়তা, অবিচলতা ও আপসহীনতার অর্থ আমরা ভুলতে বসেছি। “সালাফদের কাঠিন্যের” বদলে “খালাফদের কোমল নমনীয়তা”-কেই আমরা মানদন্ড হিসেবে বেঁচে নিয়েছি।
সূত্রঃ
ইবনু কাসির, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৯ম খন্ড
ইবনুল জাওযি, আল মুনতাযাম ফি তারিখুল মুলুকি ওয়াল উমাম, ৭/৮-৯