সমকামী অধিকার বনাম ভ্যানিলা অধিকার


প্রাইড মান্থ নিয়ে বাংলাদেশের সেক্যুলারদের চিল্লাপাল্লার মধ্যে যে বিষয়টা কনসিসটেন্টলি মজার ছিল এবং আছে, সেটা হল দেশী লিবারেলদের ডিসকোর্সের লেভেল।

“সমকামীতা”, “সমকামী অধিকার”-এর পক্ষে যেসব যুক্তিতর্ক তারা নিয়ে এসেছে, তার একটা আরেকটার চেয়ে চমকপ্রদ। উদাহরণ দেই।

‘সমকামী অধিকার’ সমর্থন করার অর্থ কী, সেটা বোঝাতে গিয়ে একজন লিখেছে –

ধরুন একজন নাস্তিক মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছেন। হটাৎ আপনার সামনেই একজন এসে তাকে কোপানো শুরু করলো কারন সে নাকি সমকামী। আপনি ধর্মীয় কারণে সমকামীদের বিন্দুমাত্র সমর্থন করেন না। তারপরও আপনি যদি মনে করেন তাকে এভাবে বিনাবিচারে কোপানো ঠিক না, তাই আপনি তাতে বাধা দেন, তাহলে আপনি সেই নাস্তিক এবং সমকামীর মানবাধিকারকে (gay rights) সমর্থন করলেন। এটা সত্য যে বহু দেশ এর মাধ্যমে আরও অধিকার চাচ্ছে, সেগুলো দেওয়া না দেওয়া আমার হাতে না। আমি শুধু সেই ইংরেজি শব্দের যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের অংশটা, সেটকে বাকি সবের সাথে মিলিয়ে একই অর্থ বলার ভুল তুলে ধরেছি।

ফ্যাসিনেইটিং! ‘সমকামী’ হবার অভিযোগে কাউকে বিনাবিচারে নিজে নিজে কুপিয়ে মেরে ফেলা যাবে না। এটা বিশ্বাস করাই নাকি ‘সমকামী অধিকার’ সমর্থন করা। নতুন জিনিস শিখলাম।

ধরুন, বজলুর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ‘ক’ কাজ করার অভিযোগ উঠলো। শুধু অভিযোগের কারণে বিনাবিচারে, বিনা প্রমাণে বজলুকে মেরে ফেলা হবে, এটা আমি সমর্থন করি না। তার মানে আমি বজলুর ‘ক’ কাজ করার অধিকার সমর্থন করি।

আচ্ছা আমি যদি বিনাবিচারের শাস্তির বিরুদ্ধে হই কিন্তু বিচার সাপেক্ষে শাস্তির পক্ষে হই। তাহলে কী হবে? বিনা বিচারে শাস্তি দেয়া যাবে না, ঠিক আছে। কিন্তু বিচারের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলে কি শাস্তি দেয়া যাবে?

আমি যদি মনে করি, কোন পুরুষের বিরুদ্ধে অন্য পুরুষের সাথে পায়ুসঙ্গমের অভিযোগ প্রমাণিত হলে, যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ তাকে শাস্তি দিতে পারে, তাহলে কি সেটা ‘সমকামী অধিকার’ সমর্থন করা বলা যাবে?

ওপরের যুক্তি অনুযায়ী তো যাবার কথা। দেশী লিবারেলরা যে এধরণের ‘হোমোফোবিক’ কথা বলে বেড়াচ্ছে এটা কি ফিরিঙ্গি লিবারেলরা জানে? জানলে চাকরি থাকবে?

আচ্ছা এই প্রশ্ন বাদ। আরেকটা প্রশ্নের কথা চিন্তা করা যাক। এই নীতি কি অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যাবে?

ধরুন একজন লোক রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। আমার সামনেই কেউ এসে তাকে কোপানো শুরু করলো। সে নাকি মাদকব্যবসায়ী। বাঙ্গালী সংস্কৃতির প্রতি অবিচল বিশ্বাসের কারণে আমি মাদকব্যবহার বিন্দুমাত্র সমর্থন করি না। তবু আমার মতে এভাবে বিনা বিচারে কোপানো ঠিক না। আমি যদি এখন কোপাকুপিতে বাঁধা দেই তার মানে কি আমি মাদকব্যবসার অধিকার সমর্থন করি?

পাবলিক কোন চোরকে ধরলো। তারপর গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার উপক্রম করলো। আমি অভিয়াসলি চুরি সমর্থন করি না। কিন্তু এভাবে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলা মেনে নিতে পারলাম না। তাই বাঁধা দিতে গেলাম। তার মানে কি আমি চুরির অধিকার সমর্থন করি?

একজন ধর্ষক রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। কেউ এসে তাকে কোপানো শুরু করলো। আমি ধর্ষণ সমর্থক করি না। তবু আমি যদি এখন কোপাকুপিতে বাঁধা দেই, তার মানে কি আমি ধর্ষনের অধিকার সমর্থন করি?

রাস্তা দিয়ে একটা ছেলে হেটে যাচ্ছে। কেউ এসে তাকে কোপানো (কিংবা তাকে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধ’?) শুরু করলো। সে নাকি জঙ্গি। আমি জঙ্গিবাদ সমর্থন করি না। কারণ লিবারেল গড বলেছে ভায়োলেন্সের মনোপলি শুধু রাষ্ট্রের হবে। এই মনোপলি ভাঙ্গার যে কোন চেষ্টা ব্লাসফেমি! লিবারেল গ’ডের পাঠানো অনেক নবীর মধ্যে এক নবী ম্যাক্স ওয়েবার আমাদের তা শিখিয়েছেন। তাই আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করি জঙ্গিরা সাধারণ মানুষের চেয়ে কয়েক ধাপ নিচের জীব। তবু এভাবে বিনাবিচারে তাদের কোপানো আমি সমর্থন করি না। আফটার অল, আমরা সভ্য মানুষ।

আমি যদি এখন কোপাকুপিতে বাঁধা দেই, তার মানে কি আমি জঙ্গীবাদের অধিকার সমর্থন করি?

সত্যি বলতে কি, আমি আগে জানতাম এগুলো আদৌ সমকামীতা, মাদকব্যবসা, ধর্ষন কিংবা চুরির ‘অধিকার’ সমর্থনের বিষয় না। বরং এগুলো বিচারিক প্রক্রিয়া, অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমান হওয়া (establishing guilt beyond a reasonable doubt) এবং শাস্তি কার্যকর করার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কে – তার প্রশ্ন।

কেউ এই কাজগুলোকে অন্যায় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করতে পারে। একইসাথে বিশ্বাস করতে পারে যে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমান হবার আগে কাউকে শাস্তি দেয়া হবে না।

কিন্তু না! দেশী লিবারেলদের যুক্তি অনুযায়ী বিনাবিচার হত্যা করার বিরোধিতা করতে হলে, আমার এই কাজগুলোকে বৈধ মনে করতে হবে। আরেকজন চাইলে এই কাজগুলো করতে পারে। আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, ইচ্ছে করলে যে কেউ মাদকব্যবসা, ধর্ষন, চুরি, কিংবা ‘সমকামীতা’ করতে পারবে। এটা তার নৈতিক অধিকার। তা না হলে জাতিসংঘ আর পশ্চিমের ঠিক করে দেয়া মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। কী সর্বনাশের কথা! এমন অলুক্ষুণে, ধর্মবিরোধী কথা তো চিন্তাও করা যায় না!

তো আমাদের এখন করণীয় কী? আমরা কি মাদকব্যবসা, চুরি, ধর্ষন ইত্যাদির অধিকার এখন সমর্থন করা শুরু করবো? মানবাধিকার যেহেতু?

আমি আসলে এধরণের আরগুমেন্ট দেখলে কনফিউসড হয়ে যাই। দেশী লিবারেলরা কি আসলেই এই লেভেলের ‘বুদ্ধিমান’? নাকি তারা অডিয়েন্সের কথা বিবেচনা করে কথাগুলো ডাম্ব-ডাউন করছে?

তাহলে প্রশ্ন আসে, নিজেদের টার্গেট অডিয়েন্সকে তারা কোন পর্যায়ের বোকা ভাবেন?

আরেকটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। একটা দেশে বছরের পর বছর বিনা বিচারে, বিনা প্রমাণে, হাজার হাজার মানুষকে গুম হয়। অনেককে গুম হয় শুধু অভিযোগের কারণে। অনেকে অভিযোগ ছাড়াই। এই মানুষগুলোর কি অধিকার নেই? গুম হওয়া মানুষদের মধ্যে অনেকে আবার মহা আনন্দে বন্দুকযুদ্ধ করতে গিয়ে মরে যায়। সবার অলক্ষে কবরে গিয়ে জমা হয়, তারপর পচে যায়, স্মৃতি থেকে মুছে যায়। তাদের জন্য বাঙ্গালকে মানবাধিকার শেখানোর কেউ নেই?

মানবাধিকারের ক্লাস নেয়া লোকেরা কি বিনা বিচারে এই মানুষগুলোকে মেরে ফেলা নিয়ে কখনো কিছু বলবে না? কোন সেলফ রাইচাস লম্বা ফেইসবুক পোস্ট হবে না? সুন্দর ইউটিউব ভিডিও হবে না? একটাও না? আধটাও না? না-মানুষদের জন্য অল্প একটু অধিকার মিলবে না? নাকি “মানবাধিকার” শুধু “সমকামীদের” জন্য?

কিন্তু আমাদের লিবারেল ক্লাস এখনো এই আলাপের এবিসিডির জন্যও প্রস্তুত না। অন্ধ অনুকরণের বাইরে গিয়ে যে কথাগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে মেনে নিতে শিখেছে, সেগুলোকে প্রশ্ন করতে তারা রাজি না। তাই অধিকার নিয়ে রেটোরিকের শেষ কোথায় তা সহজেই অনুমেয়।

The only rights worth fighting for are the rights endorsed by the west.


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *