লিবারেলিসমের অসংলগ্নতা


কোন কিছুর মার্কেটিং আর ঐ জিনিসের বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য আছে। নীলক্ষেতের মোড়ে দাড়ানো ক্যানভাসার তার পণ্যের সব দোষগুণ ঠিকঠাক আপনার সামনে তুলে ধরবে না। আপনাকে তথ্য জানানো তার উদ্দেশ্য না। তার উদ্দেশ্য বিক্রি করা। সে কিছু চমকপ্রদ স্লোগান ব্যবহার করবে। কিছু নির্দিষ্ট দিকে ফোকাস করবে। একই কথা আদর্শ আর মতবাদগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কোন আদর্শের মার্কেটিং দেখে উপসংহার টানা যায় না। আদর্শের মার্কেটিং আর প্রকৃত আদর্শকে গুলিয়ে ফেলাও যায় না। কারণ আদর্শের ফেরিওয়ালা আপনার সামনে বাস্তবতা তুলে ধরবে না। সে আপনাকে কনভিন্স করতে চায়। সে তার আদর্শের পক্ষে সমর্থন করতে চায়।

অধিকাংশ মানুষ লিবারেলিসম বলতে যা বোঝে সেটা আসলে লিবারেলসিমের মার্কেটিং। লিবারেলিসম নিজেকে নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করে। লিবারেলিসম নিজের দাবিগুলোকে মৌলিক সত্য হিসেবে তুলে ধরে। নিজের অবস্থানগুলোকে গাণিতিক সত্যের মতো করে প্রচার করে। লিবারেলিসম সবসময় দাবি করে সে নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ, নির্জলা তথ্যনির্ভর। একারণে ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা বলেছিল লিবারেল-গণতন্ত্র অন্য দশটা মতবাদ কিংবা ব্যবস্থার মতো না। বরং এটা হল মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসের শিখর। লিবারেলিসম হল মানুষের আদর্শিক বিবর্তনের চূড়ান্ত উৎকর্ষ।

এটা লিবারেলিসমের মার্কেটিং ক্যাম্পেইনের অংশ। বাস্তবতা অবশ্যই ভিন্ন। লিবারেলিসম একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা মতবাদ। ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ এবং পশ্চিমা বিশ্বনিয়ন্ত্রিত ‘আন্তর্জাতিক’ বিশ্বব্যবস্থার মাধ্যমে যা আজ সারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। লিবারেলিসম নিরপেক্ষ না। নিরেট তথ্যনির্ভর না। বরং সে কিছু নির্দিষ্ট তথ্যকে নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ ব্যাখ্যা করে। লিবারেলিসমের মূল্যবোধগুলো মৌলিক কিংবা প্রাকৃতিক সত্য না। এগুলো ইউরোপের একটা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের ফসল। নারী ও পুরুষ সব দিক দিয়ে সমান, সমকামিতা স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক কিংবা গ্রহণযোগ্য, সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সুখ অর্জনেই কল্যাণ, ভালো ও মন্দের সংজ্ঞা পরিবর্তনশীল, মানুষ নিজেই তা ঠিক করে নেবে – এই ধরণের অবস্থানগুলো ধ্রুব সত্য না। তাছাড়া সব সময়ের, সব অঞ্চলের, সব মানুষ এগুলো সহজাত সত্য বলে স্বীকার করে না। বরং অধিকাংশ মানুষের কাছে এই ধরণের অবস্থানগুলো বিচিত্র, অযৌক্তিক এবং অস্বাভাবিক ঠেকে।

কিন্তু লিবারেলরা নিজেদের মূল্যবোধকে সার্বজনীন মনে করে। তারা বিশ্বাস করে যা তাদের কাছে ‘ভালো’ তা অবশ্যই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভালো। লিবারেলিসম শ্রেষ্ঠত্ববাদী। সে মনে করে তার মূল্যবোধ, তার আদর্শ, তার অবস্থান অন্য সব আদর্শ, বিশ্বাস, দর্শনের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ববাদী। আর নিজের মূল্যবোধকে সার্বজনীন মনে করা এবং শ্রেষ্ঠত্ববাদী হবার অবধারিত ফলাফল হল সেটা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া। লিবারেলিসম তাই করে। গত প্রায় ৪০০ বছর ধরে সে অন্যের ওপর নিজের মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে। আগে এটা হয়েছে ‘অসভ্য’, অশ্বেতাঙ্গদের ‘সভ্য বানানোর’ নামে। এখন হচ্ছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অধিকার রক্ষা আর হিউম্যানেটেরিয়ান ইন্টারভেনশানের নামে। পাইকারী হত্যা, চুরি, দখলদারিত্ব, ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র, স্যাংকশান, কূটনীতি, প্রক্সি ওয়ার, অভ্যুত্থান, ইকোনমিক হিটম্যানদের ব্যবহার – নানাভাবে লিবারেলিসম বিশ্বজুড়ে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বিরোধিতা দমন করেছে।

এটা একটা ঐতিহাসিক বাস্তবতা। যেকোন মানুষ যদি অ্যাকাডেমিকভাবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সৎ থাকতে চায় তাহলে তাকে এই সত্য স্বীকার করতেই হবে। মজার ব্যাপার হল, নাস্তিকরা, প্রগতিশীলরা, লিবারেল মিশনারীরা এবং তাদের পশ্চিমা প্রভুরা এ কথাগুলো স্বীকার করবে না। তারা তোতাপাখির মতো মুখস্থ কিছু কথা আউড়ে যাবে – ব্যক্তিস্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি।

কারণ, লিবারেলিসমের ব্যাপারে এই সত্য স্বীকার করে নেয়া মাত্র সে হেরে বসবে। এতোদিন ধরে যেভাবে সে নিজের অবস্থানের পক্ষে কথা বলে এসেছে, তার পুরো কাঠামো ধসে যাবে। এর দুটো কারণ আছে।
প্রথমত, কেউ যখন মেনে নেবে লিবারেলিস অন্য দশটা মতবাদের মতো আরেকটা মতবাদ, তখন তাকে লিবারেলিসমের প্রাথমিক মূলনীতিগুলোকে, মূল্যবোধগুলোকে ডিফেন্ড করতে হবে। লিবারেলিসমের ফার্স্ট প্রিন্সিপালগুলোর ভিত্তি কী? সেগুলোর প্রমান কী? কেন সেগুলো সঠিক? এগুলো বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়া যাবে না। প্রাকৃতিক, মৌলিক কিংবা ধ্রুব সত্য মনে করা যাবে না। বরং এগুলোর যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হবে। এবং লিবারেলরা সেটা করতে পারবে না। অধিকাংশ নাস্তিক, লিবারেল মিশনারী এবং সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রিটিরা এই ধরণের আলোচনা করার সামর্থ্যই রাখে না। তাদের দৌড় ‘৫ মিনিটে সমকামিতা’ পর্যন্তই।

দ্বিতীয়ত, লিবারেলিসম যে অন্যের ওপর নিজের অবস্থান চাপিয়ে দেয়, এটা মেনে নিলে লিবারেলিসমের পুরো কাঠামো অসংলগ্ন হয়ে যায়। কারণ লিবারেলিসমের মূল দাবিই হল ‘লিবারেলিসম শ্রেষ্ঠ, কারণ তা সবার জন্য স্বাধীনতা দেয়, সমতা দেয়’। আবার এই একই লিবারেলিসম অন্য মতবাদে বিশ্বাসী মানুষের ওপর নানানভাবে শক্তি প্রয়োগ করে লিবারেলিসম চাপিয়ে দেয়। কাউকে জোর করে কীভাবে স্বাধীন করা যায়? স্বাধীনতা আর সমতা কীভাবে চাপিয়ে দেয়া যায়? যাকে জোর করা হচ্ছে সে স্বাধীন কীভাবে হল? জোর করা, চাপিয়ে দেয়া তো স্বাধীনতার বিপরীত। লিবারেলিসম একদিকে নিজেকে উদার ও সহিষ্ণু দাবি করবে। কিন্তু কেউ পর্যাপ্ত পরিমানে ‘উদার ও সহিষ্ণু’ না হলে তাকে বোমা মেরে কিংবা উপোস করে উদার ও সহিষ্ণু বানানো কেমন উদারতা, কেমন পরমতসহিষ্ণুতা? এমন অবস্থানকে যৌক্তিকভাবে সঠিক প্রমাণ করা যায় না। এটা অসংল্গনতা।

এসব কারণে লিবারেলিসম যে একটা শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতবাদ, যা নিজের অবস্থান ধ্রুব সত্য মনে করে বলপ্রয়োগে অন্যের ওপর তা চাপিয়ে দেয় – একথা নাস্তিক, প্রগতিশীল এবং লিবারেল মিশনারীরা স্বীকার করবে না। দুঃখজনক বিষয় হল, তাদের সাথে তর্কবিতর্কের সময়, ইসলামকে ডিফেন্ড করার সময় আমরা এই দিকগুলো এড়িয়ে যাই। আমরাই অযথাই ডিফেন্সিভ হয়ে যাই। পাশাপাশি ক্রিটিকাল থিংকিং, সূক্ষ বুঝ ইত্যাদি নিয়ে কিছু মানুষের কাছ থেকে আমরা অনেক ধরণের বয়ান শুনি। তারা ক্রিটিকাল থিংকিং আর সুক্ষ বুঝ বলতে বোঝেন-

ক) লিবারেল ছকের ভেতরে থেকে ইসলামকে “সংস্কার/পুনঃব্যাখ্যা/শরীয়াহর ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন” (অর্থাৎ বিকৃত) করা,

খ) আর মুসলিমদের বিশেষ করে উলামায়ে কেরামের সমালোচনা করা। কারণ তাঁরা ‘প্রাচীন’ ধ্যানধারনা আকড়ে আছেন। লিবারেল বিশ্বব্যবস্থাকে বুঝে সেটা অনুযায়ী ইসলামকে ‘আপডেট’ করার চেষ্টা করছেন না।

কিন্তু আমরা কখনো তাদেরকে লিবারেলিসমের মূল ভিত্তিকে প্রশ্ন করতে দেখিনা। লিবারেলিসমের দাবিগুলোকে ক্রিটিকালি অ্যানালাইয করতেও দেখি না। একজন ওরিয়েন্টালিস্ট আর মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কী পার্থক্য থাকা দরকার, সেটাই এরা বোঝে না, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের মুখস্থ চিন্তা আওড়ে যায়। একজন ওরিয়েন্টালিস্ট তার শেকড় জানে। তার শত্রু চেনে। তাই সে নিজের আদর্শের জায়গা থেকে ইসলাম নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ইসলামের সংস্কারের কথা বলে। আর এরা নিজেদের আত্মপরিচয় সম্পর্কেও নিশ্চিত না, আর শত্রুকেও চেনে না। তাই পশ্চিমের ক্রিটিক করার বদলে ওরিয়েন্টালিস্ট যা বলে সেটাই সে কিছুটা ধুয়েমুছে, ফিকহ আর শার’ঈ পরিভাষার পোশাক পরিয়ে উপস্থাপন করে।

মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিৎ ছিল ইসলামকে ডাউট না করে লিবারেলিসমকে ডাউট করা। ইসলামের বিধানের ব্যাপারে প্রশ্ন না তুলে লিবারেলিসমের দাবিগুলোর ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা। কিন্তু সেটা করা হয় না।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *