ইসলাম কি পুরুষতান্ত্রিক?
প্রশ্নটার উত্তর অনেক ভাবে দেয়া যায়। তবে যেকোন ভালো উত্তরের প্রথম ধাপ হল ‘পুরুষতন্ত্র’ বলতে আসলে কী বোঝানো হচ্ছে তা স্পষ্ট করা।
পুরুষতন্ত্র শব্দটার একাধিক অর্থ আছে। নৃতাত্ত্বিক বা অ্যানথ্রোপলজিকাল একটা অর্থ আছে। আবার আছে নারীবাদের দেয়া একটা হাইলি স্পেসিফিক ব্যাখ্যা। প্রশ্নকর্তা আর উত্তরদাতা যদি দুটো আলাদা অর্থ ধরে কথা বলে, তাহলে আলোচনা থেকে তেমন কোন বেনিফিট আসবে না। তাই সংজ্ঞাগুলো স্পষ্ট করা জরুরী।
ইসলামী আইনে বংশপরিচয় নির্ধারিত হয় পিতৃপরিচয় দ্বারা। সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোর কর্তৃত্ব থাকে পুরুষের হাতে, সেটা গোত্রপতি, স্বামী, পিতা কিংবা অন্য কোনো পুরুষ হতে পারে। এছাড়া ইসলামে রাজনৈতিক নেতৃত্ব (ইমারাহ বা খিলাফাহ) পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট। ইবাদতের ক্ষেত্রে কিছু অবস্থানে (যেমন সালাতের ইমাম হওয়া) পুরুষকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
অ্যানথ্রোপোলজিকাল বা নৃতাত্ত্বিক অর্থে ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। এই অর্থে ইসলাম পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক, মাতৃতান্ত্রিক না।
কিন্তু নারীবাদীদের কাছে Patriarchy বা পুরুষতন্ত্র/পিতৃতন্ত্রের একটা নিজস্ব সংজ্ঞা আছে। নারীবাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরুর সময় থেকে একটা ধারণা বেশ প্রচার পেয়েছে। ধারণাটা সংক্ষেপে এ রকম–
“প্রত্যেক সমাজে কিছু ক্ষমতার সম্পর্ক এবং লেনদেন থাকে। বিভিন্ন আর্থসামাজিক শ্রেণি, বর্ণ এবং গোত্রের মতো দুই লিঙ্গের মধ্যেও থাকে ক্ষমতার বোঝাপড়া। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি এবং রাজনৈতিক শক্তি যেমন একে অপরের সাথে শক্তির জন্য প্রতিযোগিতা করে, তেমনি নারীপুরুষও শক্তির জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করে। আর এই ক্ষেত্রে প্রত্যেক সমাজে শক্তির একটা ভারসাম্যহীনতা আছে। প্রত্যেক সমাজে পুরুষ নারীর ওপর কর্তৃত্ব করে। নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বের এই কাঠামোটা হলো পুরুষতন্ত্র।
ড্যানিয়েল হাক্বিকাতযু, সংশয়বাদী, অধ্যায়: নারীবাদ
অর্থাৎ সুদূর অতীত থেকে পুরুষরা এমন এক বৈষম্যমূলক সামাজিক কাঠামো গড়ে তুলেছে এবং টিকিয়ে রেখেছে, যার উদ্দেশ্য নারীকে অধীন করা, শোষণ করা, নির্যাতন করা এবং তার ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা।.নারীবাদের ভাষ্য অনুযায়ী–পুরুষ যেসব সময় সচেতনভাবে নারীকে শোষণ করার চেষ্টা করছে, তা না। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। বর্তমানে এই কর্তৃত্ব অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রকাশ্য। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে এমন এক অনমনীয় কাঠামো তৈরি হয়েছে, যা নারীদের শোষণ করছে। তাই নারীবাদ বলে, এই পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”
প্রাগুক্ত
কমিউনিসমের শ্রেনীতত্ত্বের সাথে পরিচিতরা ‘প্রলেতারিয়েতের’ জায়গায় ‘নারী’ এবং ‘বুর্জোয়া পুঁজিপতির’ জায়গায় ‘পুরুষ’ বসিয়েও ভাবতে পারেন। পুঁজিবাদ যেমন প্রলেতারিয়েত ওপর বুর্জোয়া পুঁজিপতির কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা, তেমনিভাবে নারীবাদের চোখে পুরুষতন্ত্র হল, নারীর ওপর পুরুষের কতৃত্বের টিকিয়ে রাখার জন্য গড়ে তোলা ব্যবস্থা।
পুরুষতন্ত্রের এই নারীবাদী তত্ত্বকে ইসলাম স্বীকার করে না। কেবল নারীদের অধীনস্ত করে রাখার জন্য পুরুষরা একটা বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি করেছে ও টিকিয়ে রেখেছে–ইসলামে এ দাবি গ্রহণ করা হয় না। মহান আল্লাহই নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি আদমকে (আলাইহিস সালাম) প্রথমে সৃষ্টি করেছেন, এবং প্রথম রাসূল বানিয়েছেন। মানবজাতিকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন বনী আদম নামে।
“সবক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের জন্য হুবহু একই বিধান তিনি দেননি। “নারী ও পুরুষকে তিনি একই বৈশিষ্ট্য দেননি, একই দায়িত্বও দেননি। আল্লাহ্ বিভিন্ন ধরনের সৃষ্টি তৈরি করেছেন–জিন, ফেরেশতা, মেঘ, পাহাড়, পশু ইত্যাদি। প্রত্যেক সৃষ্টির নির্ধারিত করেছেন অবস্থান ও ভূমিকা। একইভাবে আল্লাহ্ নারী ও পুরুষকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যদিও তারা ‘একে অপরের অংশ’। আর মধ্যে পরিবার, সমাজ ও শাসনে আল্লাহ পুরুষকে কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব দিয়েছেন”।
প্রাগুক্ত
তাই ইসলামের অবস্থান থেকে ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক। সমাজ, পরিবার, শাসনে কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব পুরুষের। যদিও এই পুরুষতান্ত্রিকতা আর নারীবাদের দেয়া ‘পুরুষতন্ত্র তত্ত্ব’ এক জিনিস না। .অন্যদিকে নারীবাদের অবস্থান থেকেও, ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক। নারীবাদের অবস্থানকে সত্য ধরে নিয়ে বিচার করলে, নারীবাদের মানদণ্ড অনুযায়ী ইসলামকে “পুরুষতান্ত্রিক” বলতে হবে।
ইসলামের এমন অনেক অকাট্য অবস্থান আছে যা কোনভাবেই নারীবাদের মানদণ্ডে জাস্টিফাই করা সম্ভব না। যে ধরণের ‘সাম্যের’ কথা নারীবাদ বলে, ইসলাম সেটা স্বীকার করে না। কুরআন এবং হাদীস থেকে এমন অনেক, অনেক অবস্থান দেখানো সম্ভব যা নারীবাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী “পুরুষতান্ত্রিক”। সালাফুস সালিহিনের অবস্থানের কথা না হয় বাদই দিলাম।
‘মুসলিম ফেমিনিস্ট’রা যতোই ত্যানা প্যাঁচাক না কেন, নারীবাদের লেন্সে ইসলামের অবস্থানকে জাস্টিফাই করা ইসলামের লেন্সের নারীবাদকে জাস্টিফাই করার মতোই অসম্ভব।
একইসাথে এটাও মাথায় রাখা দরকার যে উপমহাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অনেক প্রথা-প্রচলন, ধ্যানধারণা ছিল এবং আছে যা নারীর সাথে যুলুমকে ধর্ম এবং ট্র্যাডিশানের দোহাই দিয়ে জাস্টিফাই করে। এমন অনেক আচার-ব্যবহার এখনো আমাদের দেশে প্রচলিত। এই না-ইনসাফী, যুলুম এবং জাহিলি সংস্কৃতির বৈধতা ইসলাম দেয় না। ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক হবার মানে এই না যে ইসলাম আমার এলাকার ক, খ, গ – প্রচলনকে বৈধতা দেয়।