‘যদি বেঁচে যাও এবারের মতো…জেনো বিজ্ঞান লড়েছিল একা, কোন মন্দির-মসজিদ নয়’ -কথাগুলো এর মধ্যে সবাই হয়তো দেখেছেন। এরই মধ্যে অনেকে এ নিয়ে লিখেছেনও। আমি এর মধ্য থেকে দুটো লেখা সাজেস্ট করবো। প্রথমটা, রাফান আহমেদের লেখা ‘করোনাভাইরাস আর বিজ্ঞানপূজো’। তিনি লেখায় বেশ কয়েকটা পয়েন্ট এনেছেন। যেমন বিজ্ঞানের ওপর দেবত্ব আরোপের অবৈজ্ঞানিক প্রবণতা, কথিত মুক্তমনাদের তর্কের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কমিউনিযমের নাস্তিক্যবাদী দর্শন কিংবা মুনাফাপূজারী ক্যাপিটালিযম দায়ী হওয়া, ইত্যাদি। তবে আমার পার্টিকুলারলি পছন্দ হয়েছে লেখার শুরুর অণুকাব্যগুলো। এই কয়েক লাইন পড়লেই ‘যদি বেঁচে যাও…’ আরগুমেন্টের পুরো ধাপ্পাবাজিটা ধরতে পারার কথা। মূল বিষয়টা বোঝার জন্য এটুকু যথেষ্ট। [১]
দ্বিতীয় লেখাটা মেহেদি হাসানের। তিনি একজন ডাক্তার। ঐসব মানুষদের একজন যারা সত্যিকার অর্থেই লড়ছেন। প্রিয়জনরা যেন আক্রান্ত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য মা, স্ত্রী, ছোট্ট মেয়ের কাছ থেকেও দূরে থাকতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে ইসলাম তাকে পথ দেখায়, সাহস ও অনুপ্রেরণা যোগায়, কিভাবে তাকে প্রতিকূলতার মুখে অটল রাখে, তা নিয়ে তিনি লিখেছেন। সত্যিকারভাবে অন দা গ্রাউন্ড কাজ করা মানুষজন আর ছবি আপলোড করা ‘বিজ্ঞানী’দের চিন্তাভাবনার পার্থক্য বোঝার জন্য উনার লেখাটা পারফেক্ট। [২]
লেখা দুটোর লিংক আমি স্ট্যাটাসের নিচে দিয়ে দিচ্ছি।
এখানে সংক্ষেপে নিজের কিছু কথা যোগ করি। ‘বিজ্ঞান লড়েছিল মসজিদ না’ এই কথাটা আসলে এক ধরণের লজিকাল ফ্যালাসি ব্যবহার করে। দুটো জিনিষকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন তারা অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিংবা সাংঘর্ষিক। যেন এই দুটো জিনিসের সহাবস্থান হতে পারে না, এবং এ দুটো অবস্থান ছাড়া তৃতীয় কোন অবস্থান হতে পারে না। এই ধরনের ফ্যালাসিকে বলা হয় ফলস ডিলেমা বা ফলস ডাইকোটমি।
নিচের বাক্যগুলো লক্ষ করুন –
‘যারা ভারতের দালালী করে না তারা সবাই রাজাকার’
‘বাবুল সরকারী চাকরি করে না, তার মানে ও মানুষটা সৎ’
‘তুমি শান্তভাবে আলোচনা করতে পারবে, নাকি তোমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া?’
‘তুই কি তোর বাবা-মার বৈধ সন্তান নাকি শাহবাগী?’
‘আপনি হয় ধর্মের পক্ষে অথবা বিজ্ঞানের পক্ষে’।
কথাগুলোর সমস্যা ধরতে পারছেন?
এমন অনেক মানুষ আছে যারা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতা করে আবার ৭১ এর যুদ্ধকে সঠিক মনে করে। এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধাও আছে যারা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতা করে। একইভাবে ব্রাম্মণবাড়িয়ার এমন অনেক মানুষ আছেন যারা খুবই অমায়িক, এবং নিপাট ভদ্রলোক। এমন অনেক ঘুষখোর আছে যারা সরকারী চাকরি করে না, আবার এমন কিছু সরকারী কর্মকর্তাও নিশ্চয় আছে যারা ঘুষ খান না। কিন্তু ওপরের বাক্যগুলো এমনভাবে তৈরি করা যা থেকে মনে হয় যে দুটো অবস্থানের কোন একটাকে বেছে নিতেই হবে। হয় এটা নাহয় ওটা। কেউ যদি ক না হয় তাহলে সে খ। এ দুয়ের মাঝখানে আর কিছু নেই। এই বাক্যগুলো এক ধরনের ফলস ডিলেমার উদাহরণ।
‘বিজ্ঞান লড়েছিল…’ টাইপ কথাবার্তাও বেইসিকালি এই ধরনের একটা ফলস ডিলেমা তৈরি করার চেষ্টা করে। হয় আমাদের ধর্মে বিশ্বাস করতে হবে অথবা বিজ্ঞানে। হয় মসজিদে গিয়ে সালাত আদায় করা কিংবা দুআ করার মাধ্যমে করোনা দূর হবে, অথবা বিজ্ঞানীরা কোন একটা সমাধান খুজে বের করবে। আপনি হয় ধর্মে বিশ্বাস করে দুয়া/প্রার্থনা করবেন, অথবা চিকিৎসা করবেন। হয় প্রার্থনা করবেন অথবা ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের চেষ্টা করবেন। হয় আপনি ধর্মের ওপর ভরসা করবেন অথবা বিজ্ঞানের ওপর। কিন্তু ধর্মে বিশ্বাস আর রোগের চিকিৎসা নেয়া পরস্পর সাংঘর্ষিক না। মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ না। দুআ করা আর কোন রোগের সমাধানের জন্য বায়োলজি কিংবা কেমিস্ট্রির ব্যবহারের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই।
আচ্ছা বলুন তো এখানে যেটাকে ‘বিজ্ঞান’ বলা হচ্ছে সেটা আসলে কী? চিকিৎসা, সেবা দেয়া, ঔষধ কিংবা টীকা আবিষ্কার করা- তাই না? এই কাজগুলো মোটা দাগে মানবীয় চেষ্টাপ্রচেষ্টার (human endeavor) মধ্যে পড়ে। মানবীয় চেষ্টা যদি একটা সেট হয় তাহলে এগুলো হল তার বিভিন্ন এলিমেন্ট। প্রশ্ন হল, পৃথিবীর কোন ধর্ম মানবীয় চেষ্টাপ্রচেষ্টার প্রয়োজনকে নাকচ করে? এমন কোন ধর্ম নেই যেটা মানুষকে ঢালাওভাবে চিকিৎসা নিতে কিংবা চিকিৎসা খুজতে মানা করে। কোন ধর্ম বলে না নৌকার গলুই ফুটো হয়ে গেলে, ফুটো বন্ধ করার চেষ্টা না করে শুধু দুআ করতে হবে। কোন ধর্ম বলে না পানিতে পড়ে গেলে ভেসে থাকার চেষ্টা করা যাবে না। শুধু দুআ করতে হবে। বাড়িতে আগুন লাগলে বের করার চেষ্টা করা যাবে না। এক জায়গাতে বসে থেকে দুআ করতে হবে।
পৃথিবীর ৯৯% মানুষ এখানে কোন সাংঘর্ষিকতা দেখে না। কিন্তু এই বিচিত্র ধরনের বুদ্ধি প্রতিবন্ধীরা দেখে। তাদের কথা থেকে মনে হবে কেউ যদি স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয় তাহলে সে সাতরাতে পারবে না। নৌকার গুলুইয়ের ছিদ্র বন্ধ করার চেষ্টা করতে পারবে না। জ্বলন্ত আগুন থেকে বের হতে পারবে না। এই ধরনের অসংলগ্ন চিন্তা কেউই করে না। কিন্তু এই বিশেষ ধরনের মানুষরা ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের প্রপাগ্যান্ডার জন্য ধর্মের অবস্থানের একটা ক্যারিক্যাচার তৈরি করে সেটার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানকে দাড় করাতে চায়। এটা মুক্তমনা-নাস্তিকদের খুব পছন্দের একটা ট্যাকটিক।
এমন অনেক ডাক্তার, নার্স এবং বিজ্ঞানী আছেন যারা ধর্মে বিশ্বাসী। প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের অধিকাংশ ডাক্তার মুসলিম। করোনা রোগিদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া ড. মইন মুসলিম ছিলেন। এমনকি পশ্চিমা দেশেও যেসব ডাক্তার চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে তাদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম ছিলেন। অনেকে খ্রিষ্টান ছিল। তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের সাথে চিকিৎসা ও বিজ্ঞানের কোন দ্বন্দ্ব দেখেননি। এমন কোন নাস্তিকের কথাও শোনা যায়নি যে আস্তিক ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যারা এই কাব্য আওড়াচ্ছে জান বাঁচাতে হলে তারাও নির্দ্বিধায় আস্তিক ডাক্তার কিংবা নার্সের কাছ থেকে চিকিৎসা নেবে। কারণ বিশ্বাস আর চিকিৎসা কিংবা বিজ্ঞানের মধ্যে এক্ষেত্রে কোন দ্বন্দ্ব নেই। একটাকে ধরতে হলে অন্যটাকে ছাড়তে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
এরকম আরো অনেক ফ্যালাসি এবং বায়াস এই ধরনের আরগুমেন্টগুলোর ক্ষেত্রে দেখানো সম্ভব। আমি সময় পেলে চেষ্টা করবো আরো কয়েকটা দিক নিয়ে সংক্ষেপে লিখতে।
বাংলাদেশের মুক্তমনা/শাহবাগী গোষ্ঠীর মধ্যে আমি আজ পর্যন্ত ইন্টেলেকচুয়াল অনেস্টি এবং ইন্ট্রেগ্রিটি দেখতে পাইনি। তাদের সব আরগুমেন্ট ভুল তথ্য, ইচ্ছাকৃত ভুল উপস্থাপন, দরকারী তথ্য এড়িয়ে যাওয়া কিংবা লজিকাল ফ্যালাসির ওপর । বিজ্ঞান লড়া নিয়ে কাসুন্দিও ব্যতিক্রম না। এরা একটা ফ্রিঞ্জ মাইনরিটি। এরা মিডিয়াতে ওভার রিপ্রেযেন্টেড হলেও বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের ওপর তাদের তেমন কোন প্রভাব নেই। তাই এদের কথার জবাব দেয়ার প্রয়োজন দেখা দিলেও আমাদের উচিৎ সেই প্রয়োজনের মাত্রা যাচাই করা। এবং হিসেব করে দেখা যে অন্যান্য আলোচনাগুলোর তুলনায় এই ধরনের আলোচনা আদৌ অগ্রাধিকার পাওয়ার মতো কি না।
[১] ‘করোনাভাইরাস ও বিজ্ঞানপূজো’, রাফান আহমেদ – https://bit.ly/3btYM9W
[২] ‘বিজ্ঞান একা লড়ছে না, আমরা সবাই লড়ছি’, মেহেদি হাসান – https://bit.ly/2zfNEPx